মোবাইলে ডাক্তারের ভিজিট নেয়া বনাম হলুদ সাংবাদিকতার নোংরামি
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কেউ যদি চিকিৎসা বা পরামর্শের বিনিময়ে ভিজিট নিতে না চান, সেটার তার মহত্বের ব্যাপার, তাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্ত যিনি চিকিৎসার বিনিময়ে ভিজিট নেবেন, তাকে কেন টার্গেট করা হবে? এভাবে পার্সোনাল অ্যাটাক কেন করা হবে?
গত দুই তিনদিন ধরে নিউজফিডে একদমই অপরিচিত কিছু ওয়েব পোর্টালের একটা খবর চোখে পড়ছে। সিলেটের এক চিকিৎসক নাকি বিকাশের মাধ্যমে ভিজিট নিয়ে তারপর ফোনে রোগীর সমস্যার কথা শুনছেন, ঔষধ বা করণীয় বাতলে দিচ্ছেন। সেই খবর পড়ে যা বুঝলাম, সিলেটের জনৈক ড. নাদিরা বেগম নামের সেই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মোটামুটি আঁটঘাট বেঁধে নেমেছেন কেউ, ভুইফোঁড় পোর্টালে ঘৃণা উদ্রেককারী খবর ছেপেছেন, সেটাকে আবার টাকা খরচ করে বুস্টের মাধ্যমে মানুষের নজরে আনারও প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জাতীয় পর্যায়ের দুয়েকটি মিডিয়াও এই স্রোতে গা ভাসিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই, সেই ভুঁইফোঁড় পোর্টালের খবর কপি-পেস্ট করেই নিউজ করে ফেলেছে তারা!
প্রথমত, একজন ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের জন্যে মোবাইলে চিকিৎসা পদ্ধতি বাতলে দেয়া বা সেটার বিনিময়ে টাকা নেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশে কোন আইন আছে কিনা আমার জানা নেই। এই ব্যাপারটা নিষিদ্ধ কিছু নয়, অন্যায় নয়, অনৈতিকও নয়। করোনার এই ক্রান্তিকালে যখন পুরো দুনিয়া ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ এ ডুবে গেছে, সেখানে একজন চিকিৎসকও নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে ঘরে বসে মোবাইলে রোগীদের যথাসাধ্য সেবা করতে পারেন, সেটার বিনিময়ে ভিজিটও নিতে পারেন। এখানে অন্যায়টা কোথায় হচ্ছে, আমার চোখে পড়লো না।
বিকাশে ৮২০ টাকা না পাঠালে সেই ভদ্রমহিলা চিকিৎসা দিচ্ছেন না- এমন অভিযোগ করে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, এই ঘটনায় নাকি সিলেট শহরজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে! শব্দচয়নের ব্যবহার দেখে স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া উপায় রইলো না। করোনায় মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে, শ্রমজীবি মানুষের পেটে খাবার নেই, পকেটে টাকা নেই, চাকরিজীবিদের চাকরি আগামীকাল থাকবে কিনা সেটার নিশ্চয়তা নেই- আর শহরে নাকি তোলপাড় চলছে কে বিকাশে ভিজিট নিয়ে রোগী দেখছে- এই নিয়ে! বাপরে বাপ!
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. প্রেমানন্দ মণ্ডলের বক্তব্যও নিয়েছে ওয়েব পোর্টালগুলো। সিভিল সার্জন বলেছেন- “অনলাইনে বা মোবাইলে শতভাগ চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া যায় না। এভাবে চিকিৎসা দিয়ে পরামর্শ ফি নিতে আগে কখনো শুনিনি। আমরাও সারাজীবন সেবা দিয়ে আসছি, অনেকে তো মোবাইল ফোনে সেবা নিয়েছেন। কখনও তো টাকা নেইনি।” এখন সিভিল সার্জন মহোদয় জীবনে যেটা করেননি, সেটা অন্য কেউ করতে পারবেন না- এরকম কোন আইন কি আছে দেশে? আমার অন্তত জানা নেই।
ডা. নাদিরা, বা অন্য যে কোন ডাক্তার- তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ডাক্তারী পড়েছেন, শ্রম আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই ডিগ্রিগুলো নিয়েছেন, তাদের অনেক বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম মিশে আছে আজকের এই অবস্থানের পেছনে। সেটা কেউ উপহার হিসেবে দেয়নি তাদের। কেউ যদি চিকিৎসা বা পরামর্শের বিনিময়ে ভিজিট নিতে না চান, সেটার তার মহত্বের ব্যাপার, তাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্ত যিনি চিকিৎসার বিনিময়ে ভিজিট নেবেন, তাকে কেন টার্গেট করা হবে? এভাবে পার্সোনাল অ্যাটাক কেন করা হবে?
অনেকে বলবেন, বিকাশে এভাবে ভিজিট নেয়াটা অন্যায় না হলেও, অনৈতিক তো বটেই। তা অনৈতিক কাজের সংজ্ঞাটা কি? এই দেশে তো পার্কে দুটো ছেলে মেয়ে হাত ধরাধরি করে বসে থাকলে সেটাও অনেকের কাছে অনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে মনে হয়! অনৈতিকতার সহজপাঠ কি কিনতে পাওয়া যায় বাজারে? ভার্সিটিতে কোন কোর্স করানো হয় এর ওপরে? বাসায় বসে অফিসের কাজ করে বেতন নেয়াটা যদি অনৈতিক না হয়, ফোনে চিকিৎসার পরামর্শ বাতলে দিয়ে ভিজিট নেয়াটা কেন অনৈতিক হবে?
এরই ফাঁকে ভুঁইফোঁড় নিউজ পোর্টালগুলোর অন্যান্য খবরের ওপর নজর বুলিয়ে নিলাম একপাক। সেখানে ‘ভার্জিন মেয়ে’ চেনার এতটি উপায় বাতলে দেয়া হয়েছে, সিনেমায় সঙ্গমের দৃশ্যের রগরগে বর্ণনা আছে, আছে তারকাদের নামে বানোয়াট সুড়সুড়িমূলক গালগল্পও। এসব পোর্টালকে ব্যবহার করে যখন কারো পেছনে আঁটঘাট বেঁধে নামা হয়, তখন পেছনের নোংরা উদ্দেশ্যগুলো বোঝা যায় সহজেই। সচেতনতা তৈরি করা বা মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা এখানে লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিকে অপমান করা, একটা পেশাকে কলঙ্কিত করা। সেই চেষ্টায় একটা পক্ষ আদাজল খেয়ে নেমেছে, তা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট।
*
প্রিয় পাঠক, করোনার এই দিনগুলিতে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হতেই পারেন আপনি। সেটা হতে পারে অর্থনৈতিক, মানসিক- বা অন্য কিছু। আপনার সমস্যার কথা জানান আমাদের, আমরা চেষ্টা করব সেটা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অবহিত করার, যাতে বেরিয়ে আসে সমাধানের পথ।