রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পরেই ডা. রুহুল আবিদ ভাবলেন, পোশাক শ্রমিকদের কল্যানের জন্যে কিছু একটা করা দরকার, গড়ে তুললেন হায়েফা। যে সংস্থা সমাজের নিম্নস্তরের মানুষগুলোর জন্যে কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর...

নোবেল শান্তি পুরষ্কারের উপর এমনিতেই আমাদের খুব একটা ভরসা নেই। কারণ বিগত অতীতে এই পুরষ্কারটি যে পরিমাণে বিতর্ক ছড়িয়েছে, তা বর্ণনারও অতীত। সে বিতর্ক যে কমেছে, এমনটা মোটেও বলা যাবে না। বরং এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নমিনেশন দিয়ে বিতর্ক আবারও উসকে দিয়েছে নোবেল পুরস্কার কমিটি। তবে এ বছরে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যে মনোনয়ন পাওয়া ২১১ জনের মধ্যে রয়েছেন এক বাংলাদেশি- মার্কিন চিকিৎসক। যার নাম; রুহুল আবিদ। যিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে স্নাতক পড়াশোনা শেষ করে যান জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে মোলিকুলার বায়োলজি ও জৈব রসায়নে পিএইচডি অর্জন করেন তিনি। এরপর হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল থেকে ফেলোশিপ শেষ করেন। এই জ্ঞানী মানুষটি এবং তার অলাভজনক সংস্থা হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ফর অল (হায়েফা) কে রাখা হয়েছে এবারে নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়নের তালিকায়।

হায়েফা সমাজের তৃনমূল মানুষদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে অনেকদিন ধরেই। সুবিধাবঞ্চিতদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্যে নিচ্ছে তারা বিভিন্ন সব উদ্যোগও। ২০১৩ সালের রানা প্লাজার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে সবার? সেই রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পরপরেই ডা. রুহুল আবিদ ভাবেন পোশাকশ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবার কথা। গড়ে তোলেন 'হায়েফা'। গত তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ত্রিশ হাজার পোশাক শ্রমিককে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়েছে। এর পাশাপাশি, নয় হাজারের কাছাকাছি নারী ও পোশাক শ্রমিকের জরায়ু ক্যানসার স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা সেবা দিয়েছে হায়েফা। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও বজায় আছে তাদের কাজকর্ম।

বেশ কয়েক বছর আগে হায়েফা নিয়ে আসে 'নিরোগ' নামের একটি ডিজিটাল উদ্যোগ। সৌর বিদ্যুৎ পরিচালিত, অফলাইনে ব্যবহার করা যায় এমন মোবাইল ইলেকট্রনিক মেডিকেল রেকর্ড (ইএমআর) সিস্টেম। এই সিস্টেমের সাহায্যে দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমনঃ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি, অপুষ্টিজনিত জটিলতা, জরায়ুর ক্যান্সারে ভুগছেন এমন রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব হয়েছে। শুধু এখানেই থেমে থাকেনি নিরোগ।  প্রতিটি রোগীর জন্য আলাদা বারকোডসহ একটি ডিজিটাল হেলথ কার্ড সিস্টেম চালু করেছে তারা। রোগীদের বিশাল এক ডাটাবেজও গড়ে তুলেছে হায়েফার 'নিরোগ।'

এই বছরের শুরুর দিকে এসে ব্রাউন ইউনিভার্সিটি আর আন্তজার্তিক স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা হোপ এর সাথে মিলে কাজ শুরু করেছে হায়েফা। করোনা মোকাবেলায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে তারা। এ পর্যন্ত তারা দেড়হাজারেরও বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এছাড়াও পিপিই, কেএন-৯৫ মাস্ক, পালস অক্সিমিটার ও ইনহেলার সংগ্রহ করতেও কাজ করেছে হায়েফা। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ডা. আবিদ এবং হায়েফা ২০১৮ সালে গ্র্যান্ড চ্যালেঞ্জস কানাডার ‘স্টারস ইন গ্লোবাল হেলথ’ পুরষ্কারও পেয়েছে।

আমাদের জানা নেই, ড. রুহুল আবিদ নোবেল পুরস্কার পাবেন কী না। বহুচলকের রাজনীতি চলে এই পুরস্কারকে কেন্দ্র করে। আমরা এটাও বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে জন্মগ্রহনকারী এই মানুষটিও ভাবেন না নোবেল পুরস্কার নিয়ে। মানুষের জন্যে তিনি কাজ করতে চেয়েছেন, সেটিই করে যাচ্ছেন নিজের মত করে। এই কাজে তিনি নেন না এক পয়সার বেতনও। অনেকটা ঘরের খেয়েই বনের মোষ তাড়িয়ে যাওয়ার কাজটি করে যাচ্ছেন তিনি।

রোহিঙ্গা শিবিরে ঘুরে ঘুরে কাজের তদারকি করছেন ডা. রুহুল আবিদ 

নোবেল কমিটিকে একটু ধন্যবাদ জানানো যেতে পারে এজন্যেই যে, এই মানুষটিকে আমরা অনেকেই চিনতাম না। তাদের মনোনয়ন তালিকার বদৌলতে হলেও আমরা তাকে এখন চিনছি। এও বা কম কী!  এরকম ভালো মানুষদের না চিনতে পারার আমাদের যে ব্যর্থতা, সে ব্যর্থতা কিছুটা হলেও মোচন হয়েছে আমাদের।

ড. রুহুল আবিদ তাঁর মহৎ উদ্যোগ নিয়ে ক্রমশই সামনে এগোবেন, এটাই কামনা আমাদের। মানুষের শান্তির জন্যে তাঁর যে প্রচেষ্টা, সেটাও বজায় থাকবে নিরন্তরই, এটা আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি।

শুভকামনা রইলো তাঁর জন্যে এবং তাঁর গোটা  দলের জন্যে। স্রোতের প্রতিকূলে যে এগিয়ে চলা তাদের, সেটি সার্থক হোক। সাফল্যমণ্ডিত হোক।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা