দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে ম্যাচিউর দর্শকের পরিমাণ কম। যতদিন বাংলাদেশের মানুষ দর্শক হিসেবে এই অপরিণতমনস্কতাগুলো কাটিয়ে উঠে সত্যিকারের ম্যাচিউর হয়ে উঠতে পারবে না, ততদিন আমাদের নাটকেরও শতভাগ ম্যাচিউরিটি অর্জন সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশের নাটক যে ভালো করছে না, তা কিন্তু না। খারাপের ছড়াছড়ির মাঝেও কিছু ভালো কাজ সবসময়ই হতো। এবং এবারের ঈদেও বেশ কিছু অসাধারণ কাজ হয়েছে। তবে এরকম ভালো কাজ আরো বেশি ও ধারাবাহিকভাবে হওয়ার জন্য দর্শকদের ম্যাচিউরিটির কোনো বিকল্প নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে ম্যাচিউর দর্শকের পরিমাণ কম। আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণে এদেশের দর্শকদের ম্যাচিউরিটি কম হওয়ার কিছু কারণ হলো:

১. কিছু তারকার (আজকাল অভিনেতাদের পাশাপাশি কয়েকজন নির্মাতাও তারকাখ্যাতি পাচ্ছে) অন্ধ ভক্ত হওয়া, এবং তারা যা-ই বানাক না কেন, সেটাকে 'মাস্টারপিস' আখ্যা দিয়ে দেওয়া। এটা খুব বাজে একটা প্রবণতা। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এমন কোনো তারকাই নেই, যার সবগুলো কাজ ভালো হয়, নিখুঁত হয়। শ্রেষ্ঠ তারকাদেরও কাজ হয় ভালো-খারাপ মিলিয়ে। এখন আমাদের উচিৎ ভালো কাজগুলোকে এপ্রেশিয়েট করার বিপরীতে খারাপ কাজগুলোর গঠনমূলক সমালোচনা করা। তার বদলে যদি ঢালাওভাবে প্রিয় তারকার সব কাজকে আকাশে তোলা হয়, সেক্ষেত্রে যারা নতুন দর্শক, তারা যদি শুরুতেই ওই তারকার অপেক্ষাকৃত খারাপ কাজটি দেখে তাহলে সামগ্রিকভাবেই বাংলা নাটকের প্রতি নেতিবাচক ধারণা পায়। তারা ভাবে, বাংলাদেশের সেরা কাজগুলোই যদি এমন হয়, গড়পড়তা বা খারাপগুলো না জানি কী!

ফলে তারা পরে আর বাংলা নাটক দেখার উৎসাহ পায় না। এদিকে শ্রেষ্ঠ তারকারাও যদি দেখে যে তাদের ভালো কাজ আর খারাপ কাজ সবেরই সমান মূল্যায়ন হচ্ছে, দর্শক সবগুলোকেই প্রশংসার জোয়ারে ভাসাচ্ছে, তাহলে তারা অহেতুক আত্মতুষ্টিতে ভুগতে থাকে। আরো ভয়ংকর ব্যাপার, ভালো কাজগুলো আরো বেশি করে করা আর খারাপগুলো এরপর থেকে এড়িয়ে চলার উপলব্ধি তাদের মধ্যে তৈরি হয় না। দর্শক যেহেতু সবেতেই খুশি, তাই তারা সব ধরনের কাজই সমানতালে করে যায়। এর ফলস্বরূপ অভিনেতা কিংবা নির্মাতা হিসেবে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত গিয়েই তারা থেমে যায়। মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও, সেগুলোর পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ তারা ঘটাতে পারে না। 

২. নাটককে ভিউ দিয়ে বিচার করা। নাটকের গ্রুপগুলোতে ঢুকলেই দেখা যায়, কোন নাটক কত ভিউ পেল এটা নিয়ে বেশিরভাগ মানুষের মাতামাতি। অথচ ভিউ দেখে কোনো নাটককে মূল্যায়ন করাটা খুবই অযৌক্তিক একটা বিষয়। অনেক আজেবাজে, ভাঁড়ামোপূর্ণ নাটকই রিলিজের এক-দেড় দিনে মিলিয়ন ভিউ পার করে ফেলে। আবার অনেক ভালো নাটক কয়েক দিনেও এক লাখ ভিউ ছাড়াতে পারে না। এর পেছনে কারণ খুব স্বাভাবিক : ভালো জিনিস গ্রহণ করার মতো রুচিশীলতা বা পরিপক্বতা এখনো খুব বিরল। অথচ এই সহজ সত্যিকে না দেখার ভান করে ভিউ নিয়ে মাতামাতির ফলেই, অনেক ভালো কাজ হারিয়ে যায়। একে তো ভিউ পায় না, এদিকে দর্শকের পজিটিভ ফিডব্যাকও পর্যাপ্ত না পাওয়ায়, অনেক তরুণ, প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় নির্মাতাই আর প্রযোজক-পৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে দ্বিতীয়বার সুযোগ পায় না তাদের কাজ দেখানোর। 

৩. দর্শকের খুব সহজেই আবেগাক্রান্ত হয়ে যাওয়া। এই পয়েন্টটা অনেকেরই হয়তো পছন্দ হবে না। কিন্তু এটা নিয়ে কথা না বললেই নয়। আমাদের দেশের দর্শক এখনো অনেক বেশি আবেগী। তাই কোনো নাটকের ক্লাইম্যাক্স যদি ইমোশনাল হয়, তাহলেই তাদের কাছে ওই নাটক মহামূল্যবান কিছু একটা হিসেবে বিবেচিত হয়। আমি বলছি না ক্লাইম্যাক্স ইমোশনাল হওয়া মানেই কোনো নাটক খারাপ। বরং যদি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা নাটকের কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ, গান, আবহসঙ্গীত, ক্যামেরার কাজ, সেট ডিজাইন, পোশাক পরিকল্পনা ভালো হয়, তাহলে ওই নাটকের হ্যাপি এন্ডিংই হোক কিংবা বিয়োগান্তক সমাপ্তি, সেটাকে ভালো বলে মেনে নিতে আমরা সবাই বাধ্য।

কিন্তু যদি দেখা যায় একটা নাটকের ৯০ শতাংশ অংশজুড়েই সবকিছু খাপছাড়া, কিন্তু শেষ ১০ শতাংশ অংশে খুব ইমোশনাল কিছু দেখানো হলো, আর তাতেই দর্শক আবেগের জোয়ারে ভেসে গিয়ে সেটাকে সেরার তকমা দিয়ে দিলো, তবে তা খুবই চিন্তার বিষয়। আমি নির্দিষ্ট কোনো নাটক বা নির্দিষ্ট কোনো নির্মাতাকে ইঙ্গিত করছি না। সামগ্রিকভাবেই এটা আজকাল একটা কমন ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তেমন শক্তপোক্ত কাহিনী ছাড়াই, শুধু শেষাংশে দর্শককে কাঁদানোর মতো কিছু সিচুয়েশন তৈরি করা হচ্ছে। এবং দর্শকও সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে। শেষটা অপ্রত্যাশিত কিংবা বেদনাদায়ক হওয়ার কারণেই তারা একটা কাজকে খুব অসাধারণ কিছু ভেবে বসছে। এসবের ভিড়ে তুলনামূলক অনেক ভালো কাজও আলোচনায় আসছে না।

৪. এদেশের মানুষের সেন্স অফ হিউমারের অবস্থা কতটা শোচনীয়, তার প্রমাণ মেলে হাসির নাটকের নামে ভাঁড়ামোগুলো দেখলে। বছরের পর বছর ধরে এসব শহুরে কিংবা গ্রাম্য ভাঁড়ামো চলে আসছে, তার কারণ দর্শক এগুলো দেখছে। কেন দর্শক এগুলো দেখছে? নামে হাসির নাটক হলেও, সেগুলোতে অতি স্থূল রঙ্গ-রসিকতা করা হলেও কেন দর্শক তাতে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে? কারণ জাতিগতভাবেই আমাদের সেন্স অফ হিউমার নিম্নগামী। আগে আমরা হুমায়ূন আহমেদের হাসির নাটক দেখতাম, তার বই পড়তাম। কিংবা শুধু তিনিই কেন! আমাদের গোটা সাহিত্যে ছিল শিল্পমানসমৃদ্ধ রসের ছড়াছড়ি। আমরা শিবরামের লেখা পড়তাম, মুজতবা আলির লেখা পড়তাম। জসীমউদদীনের লেখা গ্রামীণ হাস্যরসসম্পন্ন লেখা পড়তাম। আমাদের ছোটবেলার একটা বড় অংশজুড়ে ছিল টেনিদা, ঘনাদা কিংবা গোপাল ভাঁড়, বীরবলরা। ফেলুদার কাহিনীতে জটায়ুর মুখে ভুলভাল ইংরেজি, তার সীমিত জ্ঞান অথবা তিন গোয়েন্দায় মুসা আমানের মুখে 'খাইছে' ইত্যাদিও আমাদের হাসির খোরাক জোগাতো।

সেখানে আজকাল আমাদের বিনোদনের প্রধান রসদ হলো ফেসবুকের সস্তা ট্রল, মিম, ফানি ভিডিও। এগুলোকেই আমরা ভাইরাল করি, হিট বানাই। হিরো আলম, রিপন ভিডিও কিংবা অপু ভাইদের পচাতে গিয়ে তাদেরকে সুপারস্টার বানিয়ে দিই। ওই সমপর্যায়ের সেন্স অফ হিউমার নিয়ে আমরা যে ভাঁড়ামো নাটকগুলোকেও মিলিয়ন ভিউ পাইয়ে দেব, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে! আশ্চর্য বরং সেদিনই হবো, যেদিন আমাদের নাটকে চরিত্রদের মুখে ইন্টেলিজেন্ট সংলাপ শোনা যাবে, যেগুলো শুনে আমরা হেসে গড়াগড়ি খাব না ঠিকই, কিন্তু ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি লেগে থাকবে লম্বা সময় ধরে।

৫. পাঠকের প্রাথমিক কাজ পড়া হতে পারে, দর্শকের কাজ দেখা হতে পারে। কিন্তু কোনো সৃজনশীল গল্প-উপন্যাস পড়লেই হয় না। নাটক-সিনেমা দেখলেই হয় না। পাঠক-দর্শকরা দুই বছরের শিশু না যে সব তাদের মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া হবে। পাঠক-দর্শকদের একটা কিছু পড়া বা দেখার পর সেগুলো নিয়ে নিজেদের ভাবাও দরকার। কিন্তু আমাদের দেশের পাঠক-দর্শক কেউই ভাবতে চায় না। তারা চায় নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে। তাদের চাহিদা, যেকোনো বিষয় তাদের সামনে শতভাগ সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হবে। যখনই সেটা করা হয় না, তারা খেই হারিয়ে ফেলে, চোখে অন্ধকার দেখে। আবার যারা নিজেরা চিন্তা করতে চায়, তাদের মধ্যেও বেশিরভাগই এটা জানে না যে কোনটা নিয়ে তাদের চিন্তা করা উচিৎ। তাই তারা ভুল বিষয় নিয়ে চিন্তা করে।

উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি আশফাক নিপুণের 'ভিকটিম' টেলিফিল্মটার কথা। ওপেন-এন্ডেড ফিনিশিং ছিল সেটার। তাই অনেককেই অভিযোগ করতে দেখলাম, শেষ পর্যন্ত কী হলো তারা বোঝেনি। অথচ বোঝার চেষ্টাটুকুও তাদের নেই। এদিকে আরেক দল আছে, তারা চেষ্টা করছে বটে। কিন্তু তাদের চিন্তার বিষয়, নিশোর চরিত্রটা দোষী নাকি নির্দোষ। অথচ নাটকের নামই কিন্তু 'ভিকটিম'। অর্থাৎ নির্মাতার মূলবক্তব্য ছিল ভিকটিম কে সেটা সূক্ষ্মভাবে বোঝানো। সেই "ভিকটিম কে" প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা হয়েছে বটে, কিন্তু তা নিশো দোষী না নির্দোষের চেয়ে অনেক কম।

এছাড়াও খুবই হতাশার বিষয় হলো, শতকরা ৯০ ভাগ দর্শকের কাছেই ফিকশন মানে স্রেফ ফিকশন। বিদেশে যেমন কোনো ফিকশনের মাধ্যমে একটা জিনিস প্রথম তুলে ধরা হলে সবাই মেতে ওঠে সেটা নিয়ে আরো গভীর আলোচনায়, বিশ্লেষকরা চেষ্টা করে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-নৃতাত্ত্বিক নানা আঙ্গিক থেকে সেটাকে ব্যবচ্ছেদ করায়, আমাদের দেশে তা হয় না। এই যে আশফাক নিপুণ একটা মেসেজ দেয়ার চেষ্টা করলেন 'ভিকটিম'-এ, তা নিয়ে কারো কোনো হেলদোল আছে বলে মনে হয় না। সবাই ব্যস্ত কাহিনী বুঝতে। যেন দর্শক হিসেবে সেটাতেই তাদের সব সার্থকতা নিহিত। একটা ভালো কাজ দেখে সেটার আলোয় আলোকিত হওয়া, সেটা নিয়ে কনভার্সেশনের মাধ্যমে বিষয়টার আরো গভীরে পৌঁছে যাওয়া, নিজেদের অনুভূতিশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে আরো পাকাপোক্ত করা, এ ধরনের সদিচ্ছা কারো মাঝে দেখি না।

৬. এদেশের দর্শকের অতিরিক্ত রক্ষণশীল মানসিকতাও নাটক-সিনেমার উন্নতির পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায়। যে দর্শকরা বলে বাংলাদেশে প্রেম-ভালোবাসা কিংবা ভাঁড়ামো ব্যতীত আর কোনো বিষয়ে কাজ হয় না, তাদেরই অনেকে কিন্তু আবার ভিন্ন ঘরানার কোনো কাজ এলে সবার আগে 'গেল গেল' রব তোলে। আমি এটা বলতে চাই না যে বাংলাদেশি নাটক-সিনেমা পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ করুক। আমাদের নাটক-সিনেমা করবে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব। আমাদের সমাজবাস্তবতার প্রতিফলন তারা ঘটাবে। কিন্তু সেই নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতির চিত্রায়ণও অনেক দর্শকই মেনে নিতে পারে না। তাদের বোঝা দরকার, নাটক-সিনেমা হলো সমাজের আয়না। আর আয়নায় কিন্তু শুধু সুন্দরের প্রতিবিম্বই ওঠে না, অসুন্দরের প্রতিবিম্বও ওঠে। তাহলে সমাজবাস্তবতা তুলে ধরতে গিয়েও শুধু ভালোটুকুই দেখাতে হবে, খারাপটুকুকে অস্বীকার করতে হবে, এমন মানসিকতা পোষণ করলে তো হবে না। 

যতদিন বাংলাদেশের মানুষ দর্শক হিসেবেই উপরের অপরিণতমনস্কতাগুলো কাটিয়ে উঠে সত্যিকারের ম্যাচিউর হয়ে উঠতে পারবে না, ততদিন আমাদের নাটকেরও শতভাগ ম্যাচিউরিটি অর্জন সম্ভব হবে না।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা