প্রথম আলোর এক রিপোর্টে অদ্ভুত একটা ব্যাপার আসলো- 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গত বছরের (২০১৯-২০ অর্থবছর) বাজেটে গবেষণাখাতে মোট বরাদ্দের পুরো টাকা ব্যয় করতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷' অথচ শিক্ষার্থীরা গবেষণা ফান্ড পায় না; ল্যাব নির্মাণ আর যন্ত্রপাতি ক্রয় ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ফান্ডের বাকি অংশ তাহলে কোথায় যায়?
নাহিয়ান বিন খালেদ:
দেশের তথাকথিত 'সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিবেচনায় সবচেয়ে পুরনো। সাম্প্রতিক দশ বছরে এখানের সামগ্রিক রাজনৈতিক মেরুদন্ড নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ঘটনাপ্রবাহ ও সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের মনোভাবকে প্রতিনিধিত্ব করে।
এই যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট। এই বাজেটে প্রতি বছর প্রশাসনিক অবকাঠামো বানানো হয়- সেই অবকাঠামোরও যা ছিরি! রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে গেলে মনে হবে, আঠারো শতকের কোন এক অফিসে চলে এসেছি। ভাস্কর্য আর বাসভবন নির্মাণের নামে ঠিকাদারের রাজনীতি চলে। নামকাওয়াস্তে সাফল্য প্রদর্শনের নামে অবকাঠামোবিহীন ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়। সবই চলছে। এইসব খাতে প্রতি বছর বাজেটের ভাগ বাড়ে। কমে শুধু গবেষণায়।
প্রথম আলোর এক রিপোর্টে অদ্ভুত একটা ব্যাপার আসলো- 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গতবছরের (২০১৯-২০ অর্থবছর) বাজেটে গবেষণাখাতে মোট বরাদ্দ ছিল ৪০ কোটি ৮০ লাখ ৭০ হাজার টাকা৷ কিন্তু সংশোধিত বাজেটে গবেষণাখাতে মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩৭ কোটি ৭২ লাখ ৮৭ হাজার টাকা৷ অর্থাৎ, গবেষণা-বরাদ্দের পুরো টাকা ব্যয় করতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷'
প্রথম আলো আরও বলছে, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৮১০ কোটি ৪২ লাখ টাকা৷ সেখানে গবেষণায় মোট বরাদ্দ ছিল ৪০ কোটি ৮০ লাখ ৭০ হাজার টাকা, যা ছিল বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ৷ এর আগের অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল বাজেটের ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ৷ অর্থাৎ, সর্বশেষ দুই অর্থবছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় বরাদ্দ ক্রমাগত কমেছে৷ ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে গবেষণাখাতে মোট বরাদ্দ করা হয়েছে ৪০ কোটি ৯১ লাখ টাকা৷ শতাংশের হিসাবে এই বরাদ্দ মোট বাজেটের ৪.৭ ভাগ।'
যা বরাদ্দ আছে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এত বয়স্ক একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত মানসম্মত জার্নাল নেই কেন?
আমি অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম। বলাইবাহুল্য, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গবেষণার সুযোগ এখানে নেই। আমার বিভাগে যে শিক্ষকবৃন্দ গবেষণা করেন (এবং যারা করেন, তাঁরা বেশ নিয়মিতই করেন), তাদের তা করতে হয় নিজের উদ্যোগে ফান্ড এনে অথবা অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত হয়ে। সুযোগ থাকলে শিক্ষার্থীরা তাঁদের সাথে যুক্ত হতে পারেন। জার্নালে ছাপানোর সদিচ্ছায় কখনো ফান্ড ছাড়াই নেমে পড়তে হয় তাঁদের।
আমি নিশ্চিত, বহু ডিপার্টমেন্টেই এভাবে নিজ তাগিদে গবেষণা করতে হয়। গবেষণার তাগিদ যাদের আছে, তাঁদের এ ছাড়া উপায় কী? শিক্ষার্থীদের কাছে গবেষণার ফান্ড আসার দূর চিন্তা বাদই দেই।
ল্যাব নির্মাণ আর যন্ত্রপাতি ক্রয় ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার ফান্ডের বাকি অংশ তাহলে কোথায় যায়?
এত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য প্রতিযোগিতামূলক 'গ্র্যান্ট মানি' থাকার কথা না? গবেষকরা আবেদন করবে টাকার জন্য। সেরা প্রস্তাবগুলোকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে। সেটা নিয়ে গবেষকেরা ভালো জার্নালে পাবলিশ করবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা একটা সংস্কৃতির মতো। প্রতিযোগিতামূলক গ্র্যান্ট মানি, ভালো জার্নাল ছাপানোর চেষ্টা করা, বিদেশি গবেষক- শিক্ষকদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো, নিয়মিত সম্মেলন আয়োজন করা, শিক্ষার্থীদের রিসার্চ-এসিস্ট্যান্টশিপ করানো- এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে করা না হলে এই সংস্কৃতি তৈরি হয় না। ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু সংগঠক- শিক্ষক-শিক্ষার্থী কিছুদিন চেষ্টা করতে পারেন বড়জোর। এভাবে বেশিদিন টানা সম্ভব না।
এই সংস্কৃতি তৈরির জন্য অর্থ প্রয়োজন। অর্থের বরাদ্দের নমুনা দেখানোর জন্য শতাংশের হিসেবে দিয়ে দিচ্ছি বাজেটে গবেষণার অংশের বছরওয়ারি ট্রেন্ড। বোঝাই যাচ্ছে, রাষ্ট্রের বাজেটে যেহেতু গবেষণার তাগিদ নেই, রাষ্ট্রের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে থাকারও কোন কারণ নেই।
কি যে বলছি! গবেষণায় এত অর্থ চলে গেলে ওই রাজনৈতিক ঠিকাদাররা কী খাবে? ওদের খাওয়া-পরার দায়িত্ব তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই!
-
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে