একজন আইনজীবীর চোখে 'বিয়ের প্রলোভনে' ধর্ষণের অভিযোগ ও ছাত্রলীগের অতি উৎসাহ
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মামলার বাদী নূরের বিরুদ্ধে ধর্ষনের ক্ষেত্রে সহযোগিতার যে অভিযোগ এনেছেন সেটি কতটা হাস্যকর এটা বলে বোঝাতে পারা যাবে কিনা জানিনা, কিন্তু একজন আইনজীবী হিসেবে আমার কাছে হাস্যকর লেগেছে এটা বলতে পারি নিঃসন্দেহে...
রাজু ভাষ্কর্যের সামনে বিয়ে বাড়ির মত প্যান্ডেল টাঙ্গিয়ে অনশনে বসে থাকা ফাতেমা আক্তার বিথীর পুরো ঘটনা নিয়ে খুব যৌক্তিক কারনে আমি চুপ ছিলাম।
আমি জানি আওয়ামী ঘরানার অনেকেই আমার এই লেখাটিকে পছন্দ করবেন না কিন্তু আমার মনে হয় নিজের ভাবনার সাথে মিথ্যাচার করবার কোনো মানেই হতে পারেনা।
আমি আওয়ামী সমর্থক হলেও আওয়ামী কর্মী নই ফলে শত্রুর সাথে অন্যায় হলেও আমার মনে হয় সেটি নিয়ে উচ্চকিত হওয়ার দরকার রয়েছে এবং সেটা স্পস্ট করে বলাটা ভালো।
মিস বীথির এই ধর্ষন অভিযোগ একেবারে শুরু থেকেই ছিলো আমার কাছে সন্দেহের এবং পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনায় এই ধর্ষনের অভিযোগটিকে আমার কাছে নিতান্তই প্রতিশোধপরায়ন কিংবা পেছন থেকে কেউ উষ্কে দিচ্ছে ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।
সবচাইতে হাস্যকর লেগেছে এই মামলায় মৌলবাদি বান্ধব নুরুল হক নুরুকে আসামী করা হয়েছে দেখে। নূরুর রাজনৈতিক স্টান্টবাজি, নুরুর মিথ্যাচার, ছাত্রদের আবেগের সুযোগ নিয়ে নুরুর নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডাকে যুক্তি দিয়ে খান খান করে দেবার মত শত যুক্তি আমার কাছে রয়েছে। আমার কাছে এও তথ্য রয়েছে যে নুরু লন্ডনের ডানপন্থী অংশগুলো থেকে কি করে অর্থ পেয়ে থাকে কিংবা কি করে তার রাজনৈতিক চক্রটি ঘুরছে।
কিন্তু একটি হাস্যকর মামলায় নুরুর নামটি ধর্ষকের সহযোগী হিসেবে চাউর করে এক ধরনের কনুই মেরে ফেলে দেবার যে চেষ্টা বর্তমানে চলছে সেটিতে কোথাও যেন এক ধরনের ক্লান্তি রয়েছে এবং বিলো দা বেল্টে খেলবার এই প্রচেষ্টা আমার কাছে অসহনীয় লাগে। ইনফ্যাক্ট আমার মনে হয়, এই মামলায় নুরু জয়ী হয়ে যখন ফিরে আসবে তখন এই বিলো দা বেল্টের খেলোয়াররা সেদিন টের পাবেন যে কি ভুল তারা করেছিলেন।
বিথী 'বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষন'-এর যে অভিযোগ এনেছেন সেটিকে আমি এক বাক্যেই খারিজ করে দিতে চাইনা। এই মামলায় বীথি নিজেকে ভুক্তভোগী ভাবছেন, তিনি নিজেকে ধর্ষিত ভাবছেন ফলে দেশের প্রচলিত আইনে তিনি অভিযোগ করতেই পারেন। কিন্তু একজন আইনজীবি হিসেবে না হলেও দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার মতামতটা খুব সম্ভবত দেবার অধিকার আমি রাখি।
বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষন, এই জাতীয় অভিযোগের ব্যাপারটিতেই কেমন যেন এক ধরনের নির্মমতা রয়েছে। শুনলেই মনে হয় একটা বিয়ে করবার বক্তব্যে রাজী হয়ে এক ব্যাক্তি নাচতে নাচতে কোলে এসে বসেছে এবং তারপর অন্য ব্যাক্তি তাঁর মত পাল্টাবার কারনে সেটিকে ধর্ষন হিসেবে চালিয়ে দিয়ে তার সমস্ত রাগ আর ক্রোধ ঢেলে দিচ্ছেন সেই মত পালটানো মানুষের উপর।
আমার কাছে মনে হয় আমাদের দেশে নারীদের নানা ক্ষেত্রে যতটা লাঞ্চিত, অপমানিত আর অবহেলিত হতে হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে এই 'বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষন' একটি বড় অপমান জনক বাক্য।
বাক্যটি শুনলেই মনে হয় মেয়েটি বিয়ে করবার অন্য পক্ষের ইচ্ছেটিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখেছে এবং শারিরীক সম্পর্ক করেছে, পরে মতামত পালটে যাওয়াতে সেটিকে ধর্ষন হিসেবে জায়েজ করবার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই বাক্যে নারী ইনফ্যাক্ট নারীকেই কতটা পণ্য, কতটা সস্তা আর কতটা খেলো করে দিচ্ছেন সেটি কি এই অভিযোগকারীরা বুঝতে পারেন না?
একজন নারী এবং একজন পুরুষ যদি নিজেদের ভেতর তাঁদের সম্পর্কটিকে বিয়েতে রূপদান করতে চান এবং সেটি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন তাহলে বলা যেতে পারে এটি দুজনের যৌথ সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত একবারেই আজীবনের জন্য নয়। এটা আবসলিউট কোনো ব্যাপার নয়। সিদ্ধান্তের ৫ মিনিট পরেও যে কোনো ব্যাক্তি তাঁর মতামত পাল্টাবার ক্ষমতা রাখেন। এটা ব্যাক্তির একান্ত নিজের সিদ্ধান্ত এবং এটা ব্যাক্তির স্বাধীনতা। এই সিদ্ধান্ত পাল্টালে এখানে অন্যপক্ষের আইনত আদৌ কি সুযোগ রয়েছে যে ব্যক্তি প্রতারণা করেছেন কিংবা ধর্ষন করেছেন এমনটা বলা?
মিস বীথির ক্ষেত্রেও বিয়ের সিদ্ধান্ত তাঁর তৎকালীন ছেলে বন্ধুর একার নয় বরং এই সিদ্ধান্ত একান্তই দু;জনের। এই সিদ্ধান্ত পরবর্তী সময়ে যদি দুই ব্যাক্তির মধ্যে যে কোনো ধরনের শারিরীক সম্পর্ক হয় তবে সেটিও দুইজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক ব্যাক্তির একদম নিজেদের সিদ্ধান্ত।
'তুমি বিয়ে করবা আর সে কারনেই আমি শারিরীক সম্পর্কে তোমার সাথে রাজী হয়েছি', এর থেকে ভেইগ, হাস্যকর কিংবা ফাতরা জাতীয় কোনো যুক্তি আর হতেই পারেনা। ধর্ষন হতে হলে অবশ্যই যিনি ধর্ষিত হয়েছেন বলে দাবী করছেন তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে হতে হবে এবং সেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে 'একচুয়াল পেনিট্রেশন' হতে হবে। এগুলো আইনী টার্ম। আমি সেদিকে যাচ্ছিনা।
কিন্তু মিস বীথি আর তাঁর বয়ফ্রেন্ডের মধ্যে শারিরীক সম্পর্ক কি দুজনের একজনেরও অসম্মতিতে হয়েছে? উত্তর হচ্ছে, না হয়নি। দু'জন প্রাপ্ত বয়ষ্ক ব্যাক্তি একে অপরকে জেনে-বুঝে এবং একদম নিজেদের ইচ্ছেতেই শারিরীক সম্পর্কের ভেতর দিয়ে গেছে। ফলে এখানে ধর্ষনের এলিমেন্ট ঠিক কোথায়, এটি আমার বোধগম্য নয় একেবারেই।
মিস বিথী নুরের বিরুদ্ধে যে ধর্ষনের ক্ষেত্রে সহযোগিতার অভিযোগ এনেছেন সেটি ঠিক কতটা হাস্যকর এটা বলে বোঝাতে পারা যাবে কিনা আমি জানিনা কিন্তু একজন আইনজীবি হিসেবে আমার কাছে হাস্যকর লেগেছে এটা বলতে পারি নিঃসন্দেহে।
নূরের কাছে বীথি যদি এই পুরো ঘটনার বিচার চাইতে যান এবং নূর যদি সেই বিচার না করেন, তাহলে আইনত তিনি সঠিক কাজটাই করেছেন। নূর বিচারক নন এবং এমন কোনো ডিউটি এখানে ঔ করেনা যেখানে নূরকে মিস বীথির অভিযোগের ফয়সালা করতে হবে।
নূর যদি মেয়েটিকে হুমকি দিয়ে থাকে, ধমক দিয়ে থাকে কিংবা তার নানাবিধ ব্যাক্তিগত ভিডিও ভাইরাল করে দেবে কিংবা তাকে পতিতা আখ্যা দিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে দেবে এগুলো বলে থাকে তাহলে কিংবা তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা, তাহলে অবশ্যই এসবের বিচার হওয়া উচিৎ। কিন্তু মূল যে অভিযোগ সেটিকে আমার এতই খোঁড়া আর পলিটিকাল মনে হয়েছে, যার ফলে এই মেয়েটির ব্যাপারে আমার শুরু থেকেই আগ্রহ মরে গেছে।
মিস বীথির এইসব ঘটনায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ কিংবা আওয়ামীলীগের নেতা আর কর্মীদের যে উৎসাহ আর উদ্দীপনা আমি দেখছি সেটিকে আমার পুরোটাই পলিটিকাল মনে হয়েছে। নূরকে দুই হাত দেখে নেবার জন্য বীথির প্যান্ডেলের নীচে এই সময় নষ্ট করাকে আমি অসম্ভব রকমের ইম্ম্যাচিউর মুভ মনে করি। ইনফ্যাক্ট ছাত্রলীগের এই এতটা উৎসাহের কারনে সাধারণ মানুষ বীথির পুরো ব্যাপারটিকে আরো বেশী পলিটিকাল মনে করছে ফলে বীথি আজ দুই থেকে তিন সপ্তাহ প্যান্ডেলের নীচে বসে থাকলেও নন পলিটাকাল কোনো ব্যাক্তি এই পুরো ব্যাপারটিতে আগ্রহ দেখান নি। সুতরাং 'মানুষ কেন এই ব্যাপারটিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেনা' এই বলে হাহাকার করাটাও আমার মনে হয় শুধুই সময় নষ্ট বৈ অনু কিছু নয়।
আমার মনে হয় ছাত্রলীগের, যুবলীগের বা আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীদের উচিৎ এই বীথিকে দিয়ে নূরকে টাইট দেবার পরিকল্পনা থেকে সরে আসা। নূরের পলিটিকাল চিন্তা, তার রাজনৈতিক অবস্থান, তার অর্থের সংস্থান এসব কে চ্যালেঞ্জ করুক ছাত্রলীগের যারা মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে তাঁরা। কথার শানিত যুক্তি দিয়ে বিরোধী মতকে ট্যাকেল করতে শিখুক ছাত্রলীগ-আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরা।
বরং বীথিকে তারা পরামর্শ দিক তিনি যাতে একজন ভালো আইনজীবি নিয়োগ দেন তার মামলার ব্যাপারে এবং আদালতেই সেটির ফয়সালা করুক।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন