ঢাবি শিক্ষকদের কাণ্ড: আট পৃষ্ঠার গবেষণার পাঁচ পৃষ্ঠাই 'চুরি'!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান এবং অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের বেশ কয়েকটি গবেষণা নিবন্ধে চুরির প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি। এ ঘটনাটি লজ্জায় ফেলেছে পুরো দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকেই ...
পৃথিবীর যে কোনো উন্নত দেশের দিকে আপনি যদি তাকান, দেখবেন- তারা সবসময়েই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার দিকে নজর দিচ্ছে। চায়না এত উন্নতি করছে কীভাবে, আমেরিকার ছেলেমেয়েরা কেন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে চৌকষ হচ্ছে, অথবা এত দূরের উদাহরণ পছন্দ না হলে পাশের দেশ ভারতের দিকেই তাকান। শিক্ষাকে তারা কতটা গুরুত্ব দিয়েই না ভাবছে! ভারতের ছেলেমেয়েরা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলছে! অথচ আমাদের দেশের দিকে একটু তাকান। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের 'নিষ্ফলা মাঠের কৃষক' বইটা যদি হাতের কাছে থাকে, একটু হাতে নিয়ে পড়েন। আমি হলফ করে বলতে পারি, আপনি কষ্ট পাবেন। হতাশ হবেন। এছাড়া কিছুই করার থাকবে না আপনার। করার নেই আমাদেরও।
একটি দেশের শিক্ষাঙ্গন এত কলুষিত হবে কেন? শিক্ষার্থীরা গবেষণা বাদ দিয়ে 'ভাই' এর পেছনে পেছনে চামচামি করবে কেন? গবেষণার বদলে 'চোথা' পড়ে অর্জন করা সিজিপিএ নিয়ে কেন বড়াই হবে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর নেই। তাছাড়া ঢালাওভাবে শুধু শিক্ষার্থীদের দোষ দেইও বা কীভাবে? শিক্ষক যারা আছেন, তাদের মধ্যে কয়জন জবাবদিহিতার নিরাপত্তার ভিত্তিতে ক্লাস করান? কয়জন গবেষণা করেন? কয়জন ক্লাসে আসেন শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের জন্যে? কয়জন শিক্ষকতাকে টাকা কামানোর পেশা হিসেবে বেছে নেন নি? এ প্রশ্নগুলোও খুবই প্রাসঙ্গিক।
সম্প্রতি জানা গেলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান এবং অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের বেশ কয়েকটি গবেষণা নিবন্ধে চুরির প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি। আমি পাঠকদের 'চুরি' শব্দটির উপর একটু বিশেষভাবে নজর দিতে বলবো। একজন শিক্ষকের মৌলিক গবেষণাপত্রে 'চুরি'র ট্যাগ লাগা আসলে খুব লজ্জার এক বিষয়। জানতে পারলাম, ২০১৬ সালে তাদের যৌথভাবে লেখা ‘এ নিউ ডাইমেনশন অব কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার : এ কেস স্ট্যাডি অব দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’ নামের আট পৃষ্ঠার একটি গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউ’ নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ১৯৮২ সালের শিকাগো ইউনিভার্সিটির জার্নাল ‘ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি’তে প্রকাশিত ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ নামের একটি প্রবন্ধের প্রায় পাঁচ পৃষ্ঠা হুবহু মিলে যায় তাদের আট পৃষ্ঠার গবেষণা প্রবন্ধের সাথে।
২০১৭ সালের দিকে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করে। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্তে উঠে আসে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। মিশেল ফুকো ছাড়াও এডওয়ার্ড সাঈদের 'কালচার অ্যাণ্ড ইমপেরিয়ালিজম' বইয়ের অজস্র লাইন হুবহু তারা তুলে দিয়েছেন তাদের প্রবন্ধে
শুধু যে তারা চুরিই করেছেন বিদেশি প্রবন্ধ থেকে তা না৷ তারা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে তদন্ত কাজকে বিভিন্নভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টাও করেছেন! সামিয়া রহমান অনেকদিন টিভি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত। তিনি নানা সোর্স'কে ব্যবহার করে এই তদন্তকাজকে ভন্ডুল করতে চেয়েছেন। সব মিলিয়ে টানা তিন বছর ধরে তদন্ত কাজ চলার পরে সম্প্রতি তদন্ত কমিটি তাদের সিদ্ধান্ত দিয়েছে এবং তারা যে 'চুরি' করেছেন, সেটি প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশের আর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা নাহয় বাদই দিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানের দুইজন শিক্ষক আট পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধে পাঁচ পাতাই হুবহু তুলে এনেছেন অন্যের প্রবন্ধ থেকে, এটা বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হয়। কিন্তু এটিই বাস্তব। এটিই ঘটেছে। একজন শিক্ষক, তিনি গবেষণার নামে চুরি করছেন, তার চুরির কথা বিদেশের প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হচ্ছে, এটি আসলে দেশের জন্যে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্যে কতটা লজ্জার, অপমানের... আমি তা বলে বোঝাতে পারবো না। আমি শিক্ষার্থীদের কী দোষ দেবো, যেখানে আমাদের শিক্ষকদেরই এই দৈন্যদশা!
আপনি, আমি হয়তো এই ঘটনাটিকে বিচ্ছিন্ন কিছু ভাবছি। কিন্তু, বিশ্বাস করুন, বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই এটি হচ্ছে। এ দেশে গবেষণা করা হয় নিজের সিভি ভারী করার জন্যে, বিদেশে পড়াশোনা এবং স্কলারশিপের জন্যে যে আবেদন করতে হয়, সেটার সাথে যুক্ত করার জন্যে। জানার জন্যে গবেষণা ক'জন করে? কেনই বা করবে? এ দেশ গবেষকদের উৎসাহ দিয়েছেই বা কবে? সামিয়া- মাহফুজুল এই পঁচে যাওয়া সিস্টেমের এক দগদগে ঘা হিসেবে আমাদের চোখে হয়তো পড়েছে। অথচ আপনি যদি আরেকটু ভালো করে লক্ষ্য করেন, দেখবেন- এরকম দগদগে ঘা একটি না, একাধিক। অগুনতি৷ এবং সেগুলো ক্রমশই বাড়ছে।
কেন বাড়ছে? সে প্রশ্ন আমারও। কিন্তু উত্তর মিলবে কোথায়, সেটি অনিশ্চিত।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন