বঞ্চনা আর প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা থেকে যে ক্লাবের জন্ম হয়েছিল, পূর্ব বঙ্গের মানুষের ফুটবলীয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক সেই ইস্ট বেঙ্গল খুব অল্প সময়েই নিজেদের ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ফুটবল ক্লাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, মোহনবাগানের সঙ্গে তাদের দ্বৈরথটা তো পরিণত হয়েছে কাল্ট ক্ল্যাসিকে...

ব্রিটিশ আমলে ফুটবল খেলায় পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়েই ছিল। যেমন ১৯১১ সালে যখন মোহনবাগান ইংরেজদের দল ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতল, সেখানে কিন্তু তথাকথিত 'বাঙাল'-দের অবদানই ছিল বেশি। কারণ মোহনবাগান দলে খেলেছিল একজন নয়, দুজন নয়, আট-আটজন পূর্ববঙ্গীয় ফুটবলার। তাই তো সেদিন শিল্ড ফাইনালের ম্যাচটি দেখতে ঢাকা শহর থেকে প্রচুর সমর্থক গিয়েছিল কলকাতায়। 

কিন্তু তারপরও, পূর্ববঙ্গীয়দের ফুটবল দক্ষতা তার প্রাপ্য মূল্যায়নটা কখনোই সেভাবে পায়নি। বরং তাদেরকে হতে হয়েছে বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার। এমন এক বৈষম্যের জবাব দিতে গিয়েই জন্ম হয় ইস্ট বেঙ্গল ফুটবল ক্লাবের। 

চলুন ফিরে যাই ১০০ বছর আগে। ১৯২০ সালের ২৮ জুলাই। কুচবিহার কাপে সেদিন মোহনবাগানের প্রতিপক্ষ জোড়াবাগান। কিন্তু সেদিনের ম্যাচে জোড়াবাগানের স্কোয়াড থেকে অন্যায়ভাবে বাদ দেয়া হয় স্টার হাফব্যাক শৈলেশ বসু ও নাশা সিংকে। জোড়াবাগানের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চেয়ারম্যান সুরেশ চন্দ্র চৌধুরী বারবার অনুরোধ করলেও, তার সেই অনুরোধ কানে তোলা হয়নি। তাই রাগে-দুঃখে-অভিমানে সেদিনই ক্লাবের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন সুরেশ।

এখানে জানিয়ে রাখা দরকার, জোড়াবাগানের স্কোয়াড থেকে সেদিন বাদ পড়া দুজনই ছিলেন বাংলার পূর্বাংশ হতে আগত। এবং সুরেশও ছিলেন পূর্ববঙ্গেরই এক ধনাঢ্য ব্যক্তি, যিনি ব্যবসার কারণে কলকাতায় থাকতেন। তাই সেদিন তাকে খুব বেশি সময় ব্যয় করতে হয়নি দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে যে কেন পূর্ববঙ্গের দুজন ফুটবলারকে দলে রাখা হলো না। তাই তিনি মনস্থির করলেন, নিজেই একটি নতুন ফুটবল দল গঠন করবেন।

এভাবেই মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে, ১৯২০ সালের ১ আগস্ট জন্ম লাভ করল ইস্ট বেঙ্গল নামের নতুন একটি ক্লাব। সেই ক্লাবে শৈলেশ, নাশা ছাড়াও ছিলেন শ্রী তৈত ভূষণ রায়, মন্মথ রায় চৌধুরী, অরবিন্দ ঘোষদের মতো ফুটবলাররা।

ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের লোগো

লাল-হলুদ জার্সির নতুন ক্লাবটিকে সাফল্যের জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ওই আগস্টেই তারা হারকিউলিস কাপ নামের সাতদলীয় একটি টুর্নামেন্ট জিতে নেয়। ক্লাব কর্তৃপক্ষ এমন অভাবনীয় সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। আরো বড় স্বপ্নের বীজ বুনতে শুরু করে তারা। পূর্ববঙ্গীয় সেরা ফুটবলারদের প্রতি আহ্বান জানায় যেন তাদের দলে নাম লেখান, এবং তাদের সেই আহ্বানে অনেকে সাড়াও দেন।

খুব শীঘ্রই ইস্ট বেঙ্গল ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আইএফএ)-এর অধিভুক্ত হয়ে যায়, এবং সেকেন্ড ডিভিশনে খেলতে শুরু করে। ইস্ট বেঙ্গলকে এত বড় সুযোগ করে দেয়ার নেপথ্যে ছিলেন সন্তোষের মহারাজা মন্মথ নাথ। এখন যে সন্তোষ ট্রফি খেলা হয়ে থাকে, সেটি তার নামেই নামাঙ্কিত।

মোহনবাগানের সাথে ইস্ট বেঙ্গলের রেষারেষির সূচনাটা হয় ১৯২২ সালে। মোহনবাগানের গ্রাউন্ড পার্টনার ছিল বেহালার ন্যাশনাল এসি, কিন্তু ততদিনে তাদের অংশীদারিত্বের মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। ইস্ট বেঙ্গল সুযোগটি লুফে নেয়, এবং মোহনবাগান কর্তৃপক্ষের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তারা বেহালার ওই মাঠের সহ-অংশীদার বনে যায়।

১৯২৪ সালে আবার ইস্ট বেঙ্গলের বিরোধিতা করে মোহনবাগান। সে বছর ক্যামেরুন বি দলের সাথে যৌথভাবে সেকেন্ড ডিভিশন শিরোপা জেতে ইস্ট বেঙ্গল। কিন্তু ক্যামেরুনের এ দল যেহেতু ইতোমধ্যেই ফার্স্ট ডিভিশনে খেলছিল, তাই ক্যামেরুন বি-র পক্ষে ফার্স্ট ডিভিশনে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব ছিল না। হিসেব মতো তাই ইস্ট বেঙ্গলেরই ফার্স্ট ডিভিশনে ওঠার কথা। 

কিন্তু সমস্যা হলো, তখনকার দিনে মাত্র দুইটি ভারতীয় দল ফার্স্ট ডিভিশনে খেলতে পারত, এবং ইতোমধ্যেই সেই কোটা পূরণ করে ফেলেছিল মোহনবাগান ও এরিয়ান ক্লাব। ইস্ট বেঙ্গলকে ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য নিয়ম পরিবর্তনের প্রস্তাব রাখে আইএফএ। পরিহাসের বিষয়, অন্য সব দল এতে সায় দিলেও, বিরোধিতা করেছিল ওই দুই ভারতীয় ক্লাব মোহনবাগান আর এরিয়ানই। তারপরও, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে ফার্স্ট ডিভিশনে উঠে যায় ইস্ট বেঙ্গল।

শীর্ষ লিগে খেলার সুযোগ পাওয়ার পর ইস্ট বেঙ্গলকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। পরের বছরই তারা মোহনবাগানের মুখোমুখি হয় প্রথম কলকাতা ডার্বিতে। এবং স্টেডিয়ামে উপস্থিত ৫০,০০০ মোহনবাগান সমর্থককে স্তব্ধ করে দিয়ে, সেই ম্যাচটি ১-০ ব্যবধানে জিতে নেয় ইস্ট বেঙ্গল। ম্যাচের একমাত্র গোলটি আসে নেপাল চক্রবর্তীর পা থেকে। 

শতবর্ষে পা রেখেছে ইস্ট বেঙ্গল

প্রথম লিগ শিরোপা জয়ের জন্য অবশ্য ইস্ট বেঙ্গলকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। পরের বছরই তারা জিতে নেয় আইএফএ শিল্ডও। এবং ১৯৪৫ সালে তারা লিগ শিরোপা ও আইএফএ শিল্ড দুই-ই জিতে ডাবল পূরণ করে। এছাড়া ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে তিনবার আইএফএ শিল্ড জয় করে ক্লাবটি। তাই তো ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের অ্যানুয়াল অ্যালমানাকও ইস্ট বেঙ্গলকে ১৯৫১-৫২ সালের সেরা ভারতীয় ফুটবল দলের স্বীকৃতি দেয়।

এরপর গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে, তবে লাল-হলুদ জার্সিধারীরা সবসময়ই আলোচনায় থেকেছে ভারতের সবচেয়ে বড় ক্লাবগুলোর একটি হিসেবে। মোহনবাগানের সাথে তাদের দ্বৈরথ কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে, এবং এখন পর্যন্ত সেখানে তাদের পাল্লাই ভারি। ভারতীয় ফুটবলের শ্রেষ্ঠতম খেলোয়াড়রা, যেমন তুলসিদাস বলরাম, আহমেদ খান, বাইচুং ভুটিয়া, সুদীপ চ্যাটার্জি, পিটার থঙ্গরাজরা খেলেছেন এই ক্লাবের হয়ে।

তবে একজন মানুষের উল্লেখ ছাড়া ইস্ট বেঙ্গলের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি হলেন পিকে ব্যানার্জি। সেই মানুষটি ক্লাব ম্যানেজার হিসেবে ইস্ট বেঙ্গলকে ৩০টি ট্রফি জিতিয়েছেন, এবং যার কারণে ৭০-এর দশকে তারা ভারতময় দাপিয়ে বেড়িয়েছে। 

প্রতিষ্ঠার ১০০ বছরে ইস্ট বেঙ্গলে আইএফএ শিল্ড জিতেছে রেকর্ড ২৯ বার। ক্যালকাটা ফুটবল লিগ জিতেছে রেকর্ড ৩৯ বার। এছাড়া তিনবার ন্যাশনাল ফুটবল লিগ, আটবার ফেডারেশন কাপ জিতেছে তারা। কলকাতায় এশিয়ান কাপ উইনার্স কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ইরাকের আল জাওয়ারাকে ৬-০ ব্যবধানে হারিয়েছে তারা। ২০০৩ সালে জাকার্তায় টেরো সাসানাকে হারিয়ে জিতেছে আসিয়ান কাপ। এএফসি কাপেও তারা অংশ নিয়েছে তিনবার। এর মধ্যে ২০০৪ সালে কোয়ার্টারফাইনালে খেলা তাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন।

কিন্তু এক সময়ে বিজয় মালিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় 'কিংফিশার ইস্ট বেঙ্গল'-এ পরিণত হওয়া ক্লাবটির অবস্থা এই মুহূর্তে একদমই জৌলুসহীন। মোহনবাগান যেখানে পরিণত হয়েছে এটিকে মোহনবাগান এফসিতে, সেখানে ২০২০-২১ বর্ষে কোনো স্পনসর এখনো পায়নি ইস্ট বেঙ্গল। অথচ ফুটবল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আগামী মৌসুমে ১০টি দলকে চূড়ান্ত করেছে তারা। অর্থাৎ স্পনসরহীন ইস্টবেঙ্গলের আইএসএল খেলা যে কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ছে, শতবর্ষেও বদলায়নি সেই চিত্র।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা