ইকোনো - আমাদের শৈশবের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। নাইন্টিজের ছেলেমেয়ের সাথে এই কলমের সম্পর্ক পুরোদস্তুর নস্টালজিয়ারও। সময় গড়িয়ে এত বছর চলে যাওয়ার পরেও নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হই এখনো। আচ্ছা, কেন হারিয়ে গেল ইকোনো?

নব্বইয়ের দশক। সকাল বেলা। অজ্ঞাত কোনো এক স্কুলের কাঠের বেঞ্চ-টেবিলের অল্প একটুখানি ক্লাসরুম। সাদা শার্ট, কালো হাফপ্যান্ট, সাদা মোজা, সাদা কেডস পরা একঝাঁক ছেলেমেয়ে গোল হয়ে মারামারি দেখছে। মারামারি করছে তাদেরই সহপাঠী দুইজন। মারামারির কারণটাও অদ্ভুত। একজনের কলম নাকি নিয়ে গিয়েছে আরেকজন। সেই নিয়ে তর্কাতর্কি, হাতাহাতি, অবশেষে মারামারি। মল্লযুদ্ধরত দুই শিশুর একজন ছিলাম আমি। আমার কলম নিখোঁজে লিপ্ত হয়েছিলাম সহিংস সংগ্রামে।

শৈশব আসলে একটুকরো হাওয়াই মিঠাই এর মতন। কখন যে থাকে আর কখনই যে উবে যায়, বুঝে উঠতে পারিনা। তবে ভেতরে একটা রেশ তো রয়েই যায়, সেটাই বেঁচে থাকার একমাত্র তারাবাতি। মিটমিটে জোনাকিপোকা। জামার ভাঁজের ন্যাপথালিন। 

শৈশবে কলম বলতে চিনতামই "ইকোনো ডিএক্স"। পেন্সিল আর ইরেজারে রুলটানা খাতা ছেড়ে যখন একটু বড় হলাম, এই কলমের সাথেই তখন বিস্তর টুকরো টুকরো গল্প। নাইন্টিজ এর ছেলেমেয়ের সাথে এই কলমের সম্পর্ক পুরোদস্তুর নস্টালজিয়ারও। কলম দিয়ে লেখালেখি তো ছোট একটা অংশ। বেঞ্চের উপরে গ্রুপ করে কলম দিয়ে "কলম-যুদ্ধ", কলম গলিয়ে ফুঁ দিয়ে বেলুন বানানো, উত্তাপে কলম গলিয়ে গলিত অংশ দিয়ে পিঁপড়ের ঘরে আক্রমণ, দুটি কলম একত্রে করে একসাথে চেপে ধরে আঠার মত লাগিয়ে দেয়া, সাদা জামার বুকপকেট অকস্মাৎ বিব্রত করা একপশলা কালি... শৈশবের অনেকটা অংশকেই একগুঁয়ে, জেদি শিশুর মত জবরদখল করে রেখেছে এই " ইকোনো ডিএক্স" কলম। দেখতে ওরকম আহামরি না, দাগও মোটা মোটা , হুট করে হয়তো ভিজিয়ে ফেললো ভাঁজখোলা প্যান্ট। বহু ইউনিফর্মকে অবসরে পাঠানোর ষড়যন্ত্রকারী এই কলমে আর কিছু থাকুক বা না থাকুক, ছিলো একখণ্ড আবেগ, নিখাদ আবেগ।

এখনো মাঝেমধ্যে খুঁজি "ইকোনো ডিএক্স।" কিছু জায়গায় এখনো সন্ধান মেলে। কিন্তু আগের সেই জৌলুশটাই নেই। অবশ্য চাকচিক্য কোন কলমেরই বা আছে আর! কিবোর্ড, স্মার্টফোন, পেপারলেস মোটিভেশনের এই যুগে কারই বা জামার বুকপকেট আঁকড়ে থাকে একটুখানি কালির বাহন! কারই বা সাদা শার্টে রোদের ফোটার মতন লেগে থাকে একটু কালো ছোপ?

ইকোনো
ইকোনো ডিএক্স

কেন হারিয়ে গেলো ইকোনো ডিএক্স?

সবার মত এ প্রশ্ন তো আমারো। GQ ব্রান্ড প্রথমে আনে "ইকোনো" কলম, এরপর ইকোনো ডিএক্স। এই কলমগুলো একচেটিয়া্ভাবে বাজার দখল করে নেয় অনেকটা দিন ধরে। যদিও সারাবছর "ইকোনো ডিএক্স" দিয়ে লেখালেখি করে পরীক্ষার আগে স্বার্থপরের মতন কিনে নিতাম "রেড লিফ" কলম। কারণ, রেড লিফ কলমে লেখা দ্রুত হয়। যাক সে ভিন্ন গল্প। ইকোনো ডিএক্স ছিলো আমাদের ছোটবেলার হাতিয়ার, শুধু লেখালেখিরই না। এ হাতিয়ার মারামারির, দস্যিপনার অথবা বিবিধ কুকর্মেরও। এভাবেই সব চলছিলো। হেসেখেলেই। কিন্তু ১৯৯৮ সালের দিকে যখন ম্যাটোডোর, অলিম্পিক চলে আসে দৃশ্যপটে, ইকোনো'র একচেটিয়া বাজারটা হুট করেই পড়ে যায়। বাংলাদেশের এক নম্বর ব্রাণ্ড থেকে একসময়ে অদৃশ্যই হয়ে যায় এই "নস্টালজিয়া"টি।

কেন হারিয়ে গেলো "ইকোনো", তার প্রথম কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, চটকদার বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন ও মার্কেট স্ট্রাটেজিতে অনেকটাই এগিয়ে থাকতো ম্যাটাডোর সহ অন্যান্য কোম্পানিগুলো। সেই হিসেবে "ইকোনো" র পেছনে জ্বালানী ছিলো শুধুমাত্র আমাদের পক্ষপাতিত্ব আর সাদাসিধে কিছু বিজ্ঞাপন। সে দিয়ে খুব বেশিদূর যাওয়া যায়না আসলে।

দ্বিতীয়ত, যেখানে কলমের সব ব্রাণ্ডই তাদের কলমের আকৃতি, কালি, ফিনিশিং সবকিছু নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছে, ভোক্তাদের কেমন জিনিস পছন্দ তা নিয়ে স্টাডি করেছে নিয়মিতই, সেখানে ইকোনো পড়ে ছিলো আগের মডেলেই। খুব বেশি পরিবর্তন তারা আনেনি। তাই মোটা কালি ও একই ডিজাইন দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে তারা খুব বেশি টানতে পারেনি।

তৃতীয় কারণ, সময় ফুরিয়ে গিয়েছিলো এই ব্রান্ডটির৷ যেকোনো জিনিসেরই একটা নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল থাকে। ইকোনো'র জন্যে সে সময়টা এসে পড়েছিলো খুব তাড়াতাড়িই। ক্রমশ পিছিয়ে গিয়ে হারিয়ে যাওয়াই তাই ছিলো একমাত্র নিয়তি।

তবুও পরে আবার চেষ্টা করেছিলো "ইকোনো" ফিরে আসার। নষ্টালজিক বিজ্ঞাপন, টেকনোলজি, ডিজাইন ও গ্রিপ পরিবর্তন করে আধুনিক হতেও চেয়েছিলো। মানুষের পালস ধরতে চেয়েছিলো আবার। "ইকোনো এফএক্স" নামে আরেকটি কলম বেরি‍য়েছিলো পরে। যেটা বেশ পছন্দও করেছিলো সবাই। কিন্তু তাও সাময়িক। ওভাবে ফিরে আসাটা আর হয়নি। অথবা ফিরে এলেও সেভাবে ফিরে আসা হয়নি, যেভাবে ফিরে এলে মনে রাখা যায়।

আরো অনেক কারণ হয়তো বলা যাবে "ইকোনো ডিএক্স" এর হারিয়ে যাওয়ার পেছনে। না বলি বরং। জীবনানন্দ দাশ তো বলেই গিয়েছেন- কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!" তবে এখনো কোনো স্টেশনারী দোকানে গিয়ে যখন চোখ আটকে যায় শেলফের কোনো কলমদানিতে পড়ে থাকা আটপৌরে ইকোনো ডিএক্স এর দিকে, মস্তিষ্কে তখন জট পাকিয়ে আসে। অনেকগুলো শৈশব হুড়মুড় করে এসে ট্রাফিক জ্যাম লাগিয়ে দেয়। আক্ষেপ তো আছেই। সে সাথে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস, যেখানে মিশে থাকে সুখস্মৃতি আর হতাশার দলাপাকানো প্যাকেজ। তিন টাকা দামের সেই কলম হয়ে ওঠে আমাদের কাছে টাইম মেশিন, যেটাতে একটু স্পর্শ করলেই চলে আসে বিগত অতীত, যে অতীত ছিলো গল্পের বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোর ঘ্রাণের মতন, ঘোরলাগা। 

"ইকোনো ডিএক্স" এর বেশ বিখ্যাত এক শ্লোগান ছিলো-

"ইকোনো লেখে চমৎকার এক কলমে মাইল পার"

মাইলের পর মাইল তো পেরিয়ে গিয়েছিই আমরা। সময়ের বিভিন্ন স্টেশনে এসে মানুষ হারিয়েছি ঢের, মানুষ জুটিয়েছিও ঢের। ফেলে রেখে আসতে হয়েছে অনেককিছুই। পথে পেয়েছিও অনেককিছুই। তবে পাওয়ার তুলনায় হারিয়ে ফেলার তালিকা অনেক তীব্র। সে তালিকার লিস্টি করতে বসলে প্রথম দিকেই আসবে "ইকোনো ডিএক্স" এর নাম। যে নাম গলায় বিঁধে থেকে কাঁটার মতন অস্বস্তি বাড়ায়। স্বস্তি দেয় না। একসাথে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলার শূন্য, বিমূর্ত কিছু অনুভূতি দেয়। কলম হয়ে যায় "সময়ের বায়োস্কোপ", হয়ে যায় "অতীতের ফেরিওয়ালা"।

এই যান্ত্রিক বেঁচে থাকার মধ্যে একটা কলমই হয়ে যায় আমাদের অন্ধের যষ্টি। সময় গড়িয়ে এত বছর চলে যাওয়ার পরেও আমরা তাই মাঝেমধ্যেই ফিরে যাই সেই সময়ে। সময়ের টানেলে বিষণ্ণ বিকেলে হেঁটে বেড়াই একটা কলমকে সাথে নিয়েই।

_

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা