দুই সন্তানকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করছিলো তাদের চাচা। নিরূপায় হয়ে তারা আসে একাত্তর জার্নালের কাছে। এখানে আসার পর থেকে দৃশ্যপট যেভাবে উল্টে যেতে থাকে, সে গল্প অনুপ্রেরণার, সিনেম্যাটিক ও মন ভালো করে দেয়ার...

যে ঘটনাটি নিয়ে লিখছি, এটিকে আপনি বাংলা সিনেমার স্ক্রিপ্ট ভাবলেও ভাবতে পারেন। সিনেমার স্ক্রিপ্টের মতনই নাটকীয় পুরো ঘটনাটি। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল কে এস নবী কে অনেকেই চেনেন। ধানমন্ডিতে তার একটি বাড়ি আছে। আমাদের গল্প এই বাড়ি নিয়েই। যে বাড়িতে তার দুই ছেলে থাকতো। সময়ের পরিক্রমায় ছোট ছেলে, বড় ছেলে দুইজনেই বিয়ে করে৷ তাদের সন্তানও আছে। ছোট ছেলে সিরাতুন নবীর পরিবারে দুটি ছেলে। ভালোই কাটছিলো। তবে সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। প্রাক্তন স্ত্রী'র সাথে  সিরাতুন নবীর বিবাহ বিচ্ছেদ হয় বেশ কিছুদিন আগে। মা, বিচ্ছেদের পরে  চলে যায় অন্য কোথাও। বাবার সাথেই ধানমন্ডির এই বাড়িতে থাকে  সন্তান দুটি।  বেশ কিছুদিন আগে বাবাও মারা যান। সন্তান দুটি একলা হয়ে যায়। সন্তান দুটি ক্রমশ হতাশাগ্রস্তও হয়ে পড়ে।

একদিন ওরা ভাবে, মায়ের সাথে দেখা করে আসবে ওরা। যদি মন ভালো হয়, তাই।  মায়ের কাছে যায়ও ওরা। গতকাল মায়ের কাছ থেকে বাবার বাড়িতে ফেরত আসতে গিয়ে দেখে কম্পাউন্ড খোলা আছে কিন্তু মেইন সিঁড়ি লক করা। ওরা দরজা খোলার জন্যে বলে কিন্তু কেউ দরজা খোলেনা। দিশেহারা হয়ে শিশুদুটি চলে যায় ওদের ফুপুর কাছে। ফুপু এরপর সন্তান দুটির বড় চাচা ব্যারিস্টার রেহান নবী (যিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং যিনিই বাড়িটি আটকে রেখেছেন) কে কল করেন। রেহান নবী প্রথমে ফোন ধরেন না। এরপর গার্ডের মাধ্যমে অনুরোধ করে ফোন ধরানো হয় তাকে৷ উনি বলেন, তিনি অসুস্থ। আজ গেট খুলতে পারবেন না। কাল আসতে বলেন ছেলেদুটিকে৷

ফুপু এরপর ধানমন্ডি থানা কে ইনফর্ম করেন এ বিষয়ে। পুলিশ যোগাযোগ করে রেহান নবীর সাথে। দরজা খোলার রিকোয়েস্ট করে তারাও। কিন্তু উত্তর একই থাকে৷ রেহান নবী দরজা খুলতে অপারগতা জানায়। এরপর থানার ওসির সাথে তার কী যেন কথা হয়;  পুলিশ দুই সন্তানসহ ফুপুকে বলেন, আপনারা আজ যান। কাল বাচ্চারা বাসায় ঢুকতে পারবে। আমরা কথা দিচ্ছি। পুলিশের কথায় আশ্বস্ত হয়ে তারা বাসায় চলে যান।

পরদিন সকালে এসে তারা দেখে, গোটা কম্পাউন্ডটাই লক। মেইন গেটে তালা। কুকুর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সিকিউরিটি গার্ড জানায়, স্যারের অর্ডার নেই, ভেতরে যেতে পারবে না কেউ। তবু বাচ্চারা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রোদের মধ্যে। পুলিশকে ইনফর্ম করা হলে, পুলিশও সুর বদলে ফেলে। বলে আমরা কিছু করতে পারবো না। আপনারা আদালতের আশ্রয় নেন। আমাদের কিছু করার নেই, উপরমহল থেকে চাপ আসছে আমাদের উপর।

বোঝাই যাচ্ছিলো, সম্পত্তিজনিত জটিলতা নিয়ে এ নাটকীয়তা৷ বাড়িটা প্রয়াত এ্যাটর্নি কে এস নবীর প্রোপার্টি ছিলো৷ যেহেতু তিনি প্রয়াত হয়েছেন, এখন তার দুই সন্তান এই বাড়ির মালিক হবে, এটাই আইন। এবং ছোট সন্তানও যেহেতু মারা গিয়েছেন, তার দুই শিশু ছেলে এই বাড়ির অংশীদার। চাচা রেহান নবীর আপত্তি এখানেই। তিনি তাই ছলেবলে কৌশলে এই দুই বাচ্চাকে সরিয়ে পুরো বাড়ি ও সম্পত্তি নিজে হাত করার তালে ছিলেন। তিনি শুধু এখানেই থামেননি, এই দুই বাচ্চার বাবা অর্থাৎ তাঁর ছোট ভাই সিরাতুন নবীর যে ব্যাংক ব্যালেন্স আছে, সেগুলো থেকেও কেউ যাতে টাকা উঠাতে না পারে, সে জন্যেও নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন তিনি, নিজের প্রভাব খাটিয়ে!

নিরুপায় দুই বাচ্চা, তাদের ফুপুর সাথে আবার গেলেন থানায়।  অভিযোগ দায়ের করার জন্যে। পুলিশ অভিযোগ তো নিলেনই না। বরং বললেন, উপরের থেকে চাপ আছে, এই মামলা না নেয়ার জন্যে। তারা কিছুই আর পারবে না। এদিকে রেহান নবীও হুমকি দিয়ে রেখেছেন, কোর্ট এ দেখা হবে। এই বাড়ির গেট আর খুলবে না।

ফুপু ও দুই সন্তান এভাবেই দেশবাসীর সহায়তার জন্যে অনুরোধ জানান! 

পরবর্তীতে এই অসহায় মানুষগুলো মিডিয়ার আশ্রয় নেয়। 'একাত্তর জার্নাল' এ আসেন তারা। শোনান তাদের গল্প। ফারজানা রূপার উপস্থাপনায় এই গল্প শোনে পুরো দেশবাসী। এরপরেই হয় এক অসাধারণ চমৎকারিত্বের দৃশ্যায়ন। মাঝরাতে হাইকোর্ট স্যুয়োমুটো রুল জারি করে। এই শব্দটির একটু বিশ্লেষণ প্রয়োজন আছে। Suo Moto এই শব্দদ্বয় এসেছে ল্যাটিন sua sponte থেকে। যার অর্থ- নিজের ইচ্ছেয়। সাধারণত আদালত নিজের ইচ্ছেয় কিছু করে না। যখন কোনো পক্ষ কোনো একটি বিষয় নিয়ে আদালতের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন করে, তখন আদালত এই বিষয়টির সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে আবেদনটি আমলে নেয়। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে। আদালত চাইলে কোনো পক্ষের আনুষ্ঠানিক আবেদন ছাড়াও নিজের ইচ্ছেয় কোনো আবেদন আমলে নিয়ে প্রতিকার দেয়ার কাজ শুরু করে দিতে পারে। এটিকেই Suo Moto বলে। এক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। হাইকোর্ট স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে আদেশ দেন, রাতের মধ্যেই পুলিশ ব্যবস্থা নিয়ে এই দুই বাচ্চাকে তাদের বাবার বাড়িতে সসম্মানে এবং নিরাপদে পৌঁছানোর সর্বাত্মক ব্যবস্থা করবে। এবং পরদিন সকালে গিয়ে কোর্টের কাছে রিপোর্ট করবে, যে, তারা আদালতের নির্দেশমত ব্যবস্থা করেছে।

অসম্ভব মন ভালো করে দেয়ার এই ঘটনাটির কয়েকটি দিক আছে। প্রথম দিক, মানুষের বর্বরতার দিক। সম্পত্তির জন্যে মানুষ মানুষকে আঘাত করে, মারামারি করে, খুন করে। কিন্তু দুটি বাচ্চার মুখের সামনে তাদের ঘরে যাওয়ার দরজা বন্ধ করে দেয়া যে কতটা অমানবিক, তা ভুক্তভোগী নন যারা, তাদের বোঝানো খুব শক্ত। মানুষ কতটা অমানুষ হলে এরকমটা করতে পারে, জানা নেই। যিনি এই কাজটি করলেন তিনি কিন্তু শিক্ষিতও, তিনি ব্যারিস্টার, আইনজীবী। হাইকোর্টের একজন সভ্য সে। এরকম 'সভ্য' মানুষের অসভ্য আচরণ আসলে আমাদের বিস্মিত করে ক্ষণেক্ষণেই।

দ্বিতীয় বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়ার দিক। পরীমণি রাতে কোন ড্রেস গায়ে দিয়ে ঘুমালেন, মিন্নি আদালতে যাওয়ার আগে মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছেন কী না... মিডিয়া আসলে এতটা স্বস্তা হওয়ার কথা ছিলো না কখনোই। মিডিয়ার হওয়ার কথা ছিলো দুর্বলদের আশ্রয়বিন্দু। মানুষের ভরসার জায়গা। সে জায়গাটি থেকে অনেকটাই সরে এসেছে তারা৷ ইয়েলো জার্নালিজম, অশিক্ষিত-রুচিহীন'দের ক্রমাগত পদচারণায় একসময়ের সম্মানিত মাধ্যমটি আজ অনেকটাই ফিকে, ক্লেদাক্ত। সেখানে 'একাত্তর জার্নাল' এর এই ঘটনা যেন ফিরিয়ে আনলো অনেক আগের সেই সুদিন'কে। বাকিরা যদি একাত্তর টিভির এই ঘটনাটি দেখেও ছিটেফোঁটাও শেখে, সেটাই স্বস্তির। আমাদের প্রত্যাশা সেখানেই।

তৃতীয় বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নানা কারণে-অকারণে 'আইন' আমাদের কাছে বাংলা সিনেমার শেষদৃশ্যের চটকদার পরিসমাপ্তি ছাড়া আর কিছুই না। মানুষ আইন জানে না, আইন মানে না, আইনকে ভরসা করে না। অথচ বিচার বিভাগের হওয়ার কথা ছিলো মহীরূহ। এই বটবৃক্ষের নীচে আশ্রয় হওয়া উচিত ছিলো প্রত্যেক মানুষের। সেটি হয়নি। না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। সেসব নিয়ে অন্য আরেকদিন বলবো নাহয়। তবে এই দুই বাচ্চার মানবিক গল্প শুনে সঙ্গেসঙ্গে সাড়া দিয়ে যে দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করলেন, তা নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণার, স্বস্তির ও ভরসার৷ আমাদের বিচার বিভাগ এরকমই সক্রিয় হবে সামনেও, দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা এটিই চাই।

এরকম ন্যাক্কারজনক ঘটনা বাংলাদেশে প্রতিদিনই হয়। সম্পত্তিজনিত বর্বরতা বাংলাদেশে খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়ই। কিন্তু যেটি অস্বাভাবিক এখানে, সেটি হলো, মিডিয়া যদি সাধারণ মানুষের কান্নাজড়ানো গলা শোনায় পুরো দেশকে এবং সে কান্না যদি আদালতের চৌহদ্দিকে ভেজাতে পারে, তাহলে যে অসাধারণ সব দৃশ্যপট তৈরী হয়... সেই উপলব্ধির ক্ষেত্র তৈরী হওয়া। আমরা ধন্যবাদ জানাই একাত্তর জার্নাল কে, ফারজানা রূপা কে, আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

এভাবেই পরিবর্তন হবে। একটা সময়ে এসে দেশ বদলাবেই। আলো আসবেই।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা