একাত্তর টিভিকে বয়কট করে দোজাহানের অশেষ নেকি হাসিল আর সমাজ-সংসার ও ধর্মের প্রভূত উন্নয়ন সাধন করে ফেলেছেন বলে যদি আপনার মনে হয়, তাহলে আপনাকে অভিনন্দন। ব্রেইনওয়াশড জোম্বি হবার দ্বারপ্রান্তে সফলভাবে পৌঁছে গেছেন আপনি!

অনলাইনে একাত্তর টিভি বয়কটের একটা হুজুগ চলছে। একাত্তর টিভি নাকি ইসলামের অবমাননা করেছে, মুসলমানরা জায়গা দখল করে মসজিদ বানায়- এমন বক্তব্য দিয়েছে, মসজিদ-মাদ্রাসায় ছাত্র ধর্ষণের অভিযোগ এনেছে- কাজেই বয়কট করো একাত্তর টিভিকে। সবশেষ কবে টিভির সামনে বসেছি মনে পড়ছে না, খেলা দেখলেও সেটা মোবাইল বা ল্যাপটপেই দেখা হয়, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সবগুলোই মোটামুটি ফেসবুক আর ইউটিউবে এভেইলেবল, কাজেই বোকাবাক্সের সামনে বসার দরকার হয় না এখন। কাজেই কে একাত্তর টিভিকে বয়কট করলো, আর কে একাত্তর টিভির পাশে দাঁড়ালো, সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার ছিল না। কিন্ত ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ঢুকে বোঝার চেষ্টা করলাম, আসলে হচ্ছেটা কি এখানে?

একদিকে ইসলামী বক্তারা একাত্তর টিভিকে বয়কটের ডাক দিয়েছেন, অন্যদিকে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরও বলেছেন একাত্তর টিভিকে বয়কট করতে। এত বয়কটের কারন খুঁজতে গিয়ে অদ্ভুত কিছু জিনিস দেখতে পেলাম। তুরাগ নদীর দখলের কথা বলতে গিয়ে উপস্থাপিকা ফারজানা মিথিলা বলেছিলেন, জমি-নদী দখল করে অবৈধ পাওয়ার স্টেশন তৈরি হয়েছে, সরকারী অফিস বানানো হয়েছে, অনেকে মসজিদও বানিয়েছে। পাওয়ার স্টেশন বা সরকারী অফিসের অনুভূতি নেই, কিন্ত মসজিদের যেহেতু আছে, তাই অনুভূতিতে আঘাত লেগে গেল। আর সেকারনেই এই প্রতিবাদের বন্যা, বয়কটের হিড়িক। তিলকে তাল বানানো হলেও মেনে নেয়া যেতো, এখানে তো বিন্দুকে সিন্ধু বানানো হচ্ছে! এছাড়াও অভিযোগ উঠেছে, একাত্তর টিভি নাকি ওয়াজ মাহফিলকে ধর্ষণ বৃদ্ধির কারন হিসেবে দায়ী করার চেষ্টা করেছে। ওয়াজের নামে অনেক জায়গায় যে পুরুষতান্ত্রিকতার জয়গান আর নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর মেলা বসে, সেটা কি চাইলেও অস্বীকার করা সম্ভব?

মজার ব্যাপার হচ্ছে, একাত্তর টিভিকে কী কারনে বয়কট করা হচ্ছে, সেই ব্যাপারে খুব বেশি মানুষ ক্লিয়ার না। এমনকি যারা বয়কট করছে তারাও শতভাগ জানে না বয়কটের কারনটা। হুজুরেরা বলেছেন, অমুক ভাই বলেছেন, ইনবক্সে মেসেজ এসেছে, তাই বয়কট করো! শুধু ইউটিউবে গিয়ে একাত্তর টিভিকে আনসাবস্ক্রাইব করা, ফেসবুক পেজে আনলাইক করা আর পোস্টে গিয়ে 'বয়কট! বয়কট!' কিংবা 'নাস্তিকের বাচ্চা', 'ভারতের দালাল'- এসব কমেন্ট করেই তারা দোজাহানের অশেষ পূণ্য হাসিল করে ফেলছে বলে অনেকের ধারনা। আখেরে লাভ সম্ভবত একাত্তরেরই হচ্ছে, কারন নেগেটিভ মার্কেটিং ইজ দ্য বেস্ট মার্কেটিং। গত দুই-তিনদিনে একাত্তর টিভি নিয়ে যত আলোচনা নিউজফিডে দেখছি, তার দুই পার্সেন্টও স্বাভাবিক সময়ে থাকে না।

কে কোন জিনিস বয়কট করবে, কার চ্যানেল আনসাবস্ক্রাইব করবে, কোন পেজে লাইক দেবে বা আনলাইক করবে- সেটা একটা মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার, স্বাধীন দেশে সবার অধিকার আছে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করার। কিন্ত হিপোক্রেসি জিনিসটা দেখলে খুব বিরক্ত লাগে। এক তো টিভিতে নাটক-সিনেমা-বিজ্ঞাপন সবকিছু দেখাই হারাম। একাত্তর টিভি বয়কট করার আগে তো সেগুলো বয়কট করা উচিত ছিল। 

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম একাত্তর টিভি মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। তাহলে কাজী ইব্রাহিম, ছামছুল হক যশোরী বা আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ- এই লোকগুলোর গোঁড়া এবং অযৌক্তিক বক্তব্যে যখন ইসলামের প্রতি প্রতি মানুষের ভয় এবং ঘৃণা জন্ম নেয়, এদের কেউ বয়কটের ডাক দেয় না কেন? এরা যখন ওয়াজ-মাহফিলের নামে ঘৃণার বিষবাস্প ছড়িয়ে বেড়ায়, তখন কেন কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে না? 

একাত্তর টিভির উপস্থাপিকা ফারজানা মিথিলা

মুফতি ইব্রাহিম যখন করোনাভাইরাসের সঙ্গে ধর্মকে মিলিয়ে ইসলামকে হাসিঠাট্টার বিষয়বস্তুতে পরিণত করেন, তখন তো কেউ তার সমালোচনা করে বলেন না যে, ধর্মকে জড়িয়ে এই লোকের এসব আজগুবি কথাবার্তার কারনে ইসলামের ক্ষতি হচ্ছে। আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ যখন বলেন যে 'নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র তার স্বামীকে শান্তি, তৃপ্তি দেয়ার জন্য। নারীর চুল দেখলে পাপ হয়, মুখ দেখলে, হাত ও পা দেখলে পাপ হয়, পুরা শরীরটাই পাপের বস্তু....'- তখন তার এসব জঘন্য কথার প্রতিবাদ তো কাউকে করতে দেখা যায় না। যে ধর্ম নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে, সেই ধর্মের কথা বলতে গিয়ে কিভাবে একজন বক্তা নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দাবী করে? 

'যেখানে আদর আছে সেখানে লাঠি আছে। ছেলে মেয়ে স্ত্রীর উপর থেকে লাঠি উঠিয়ে নিবেন না'- ওয়াজে হাজার হাজার মানুষের সামনে এই কথার মাধ্যমে যখন ইউসুফ সাহেব ডমেস্টিক ভায়োলেন্সকে উস্কে দেন, তখন কেউ বলে না যে এই ইউসুফ সাহেব মনগড়া কথা বলছেন, আসুন তাকে বয়কট করি। এই লোকগুলোর কারনে ইসলামের বদনাম হচ্ছে, ওয়াজ-মাহফিলগুলো ইসলামের জ্ঞান প্রচারের পরিবর্তে ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। অথচ আপনারা সেগুলোর প্রতিবাদ করেননি, করোনার ভ্যাক্সিন নিয়ে এন্টারকটিক হুজুরের বয়ান শুনে হাসিঠাট্টা করে উড়িয়ে দিয়েছেন, আর আজ এসেছেন একাত্তর টিভিকে বয়কট করতে! অথচ একাত্তরকে বয়কট করার আগে এসব মুফতি টাইটেলধারী লোকগুলোকে বয়কট করা উচিত ছিল সবার!

মাদ্রাসায় যখন দিনের পর দিন ছাত্র বলাৎকার হয়, সেই মাদ্রাসার হুজুরদের কেউ বয়কট করার কথা বলেনি কখনও। উল্টো সেক্সের কনসেন্ট নিয়ে কথা বলার 'অপরাধে' টেন মিনিট স্কুলের ওপর হুমকি এসেছে! এরা কনসেন্ট বোঝে না, শুধু বোঝে, ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক দায়ী! আজ বায়তুল মোকাররমের সামনে আলেম-ওলামারা ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, সেখানে ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম এসে পোশাককেই ধর্ষণের কারন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ধর্ষনের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসিতে উন্নীত করায় তিনি আফসোস করেছেন। সাহস থাকলে ফয়জুল করিমদের বয়কট করুন, এদের বয়কট করাটা বেশি জরুরী, একাত্তর টিভিকে বয়কট করাটা নয়। 

আবারও বলি, আপনি কোন জিনিসটা বয়কট করবেন, কোনটাকে আঁকড়ে ধরে রাখবেন- সেটা একান্তই আপনার ইচ্ছা। একাত্তর টিভি, বাহাত্তর টিভি সব বয়কট করেন, সমস্যা নেই, শুধু নিজের কমনসেন্সটাকে কাজে লাগান, কোথায় ফোকাস করা দরকার সেটা ভাবুন। বিবেক-বুদ্ধি যদি বিসর্জন দিয়ে থাকেন, তাহলে লোকের কথায় নাচতেই পারেন। নাচার আগে গ্রাউন্ড সম্পর্কে একটু খোঁজ নিন, কেন নাচতে বলা হচ্ছে জানার চেষ্টা করুন, অমুক ভাই বা তমুক বক্তার কথায় নেচে লাভ নেই। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিন, নিজের বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহার করে কাজ করুন। একটা টিভি চ্যানেলকে বয়কট করার চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আছে চারপাশে, সেগুলোতে মনোযোগ দিন।

কেন ধর্মান্ধ জনগন আর ঢাবির সাবেক ভিপি একই সুরে কথা বলে, একই চ্যানেলের বয়কট চায়- সব রসুনের কোয়া কেন এক জায়গায় বাঁধা, সেটাই বোঝার চেষ্টা করুন। ফেসবুক মুমিনেরা এককালে 'সংস্কৃতি ধ্বংসের' অভিযোগে সালমান মুক্তাদিরের ইউটিউব চ্যানেল আনসাবস্ক্রাইবের উৎসবে মেতেছিল। তাতে কি ফায়দা হয়েছে, সালমান কতটা কোণঠাসা হয়েছেন, সেসবের খোঁজ নিন। একাত্তর টিভিকে বয়কট করে দোজাহানের অশেষ নেকি হাসিল আর সমাজ-সংসার ও ধর্মের প্রভূত উন্নয়ন সাধন করে ফেলেছেন বলে যদি আপনার মনে হয়, তাহলে আপনাকে অভিনন্দন। ব্রেইনওয়াশড জোম্বি হবার দ্বারপ্রান্তে সফলভাবে পৌঁছে গেছেন আপনি! 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা