এই ধরণী থেকে মানবকূল একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এবং সেটা হবে এই নির্লজ্জ মানুষের কারণেই। এইটুক পড়ে যেসব 'এটা কোনো ব্যাপার হলো' টাইপ বান্দারা এগিয়ে আসবেন গালমন্দ করার জন্য, কেরালার এই ঘটনাটা তাদের জন্যেই...  

‘যেখানে মানুষের জীবনেরই মূল্য নেই, সেখানে পশুপাখীর জীবন নিয়ে ভাবার সময়টা কার?’ এভাবেই মুখস্ত সব টেমপ্লেটে জাস্টিফাই করা হয় পশুদের ওপরে চালানো পাশবিক নির্যাতনগুলোকে। হঠাৎ করেই বা কেন এই প্রসঙ্গটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এখন? সেই জট খুলতে হলে দৃষ্টি ফেরাতে হবে কেরালার দিকে।

দ্য আমেজিং কেরালা। ভারতের সবচেয়ে প্রগতিশীল রাজ্য বললেও ভুল হবে না কেরালাকে। সেখানে সাক্ষরতার হার প্রায় ৯৪% থেকে ৯৮% পর্যন্ত, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও শিক্ষিত লোকের অভাব নেই। ধর্ম, বর্ণ, জাতি গোত্র নির্বিশেষে ওখানে সবাই মিলেমিশেই থাকে। এমনকি এখন পর্যন্ত কোনো ধর্মীয় দাঙ্গার রেকর্ড নেই সেখানে। নিজেদের মতো করে ছোট্ট এক টুকরো স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে তারা।

তাইতো অনেকে গডস ওউন কান্ট্রিও বলে কেরালাকে। এমন একটা মানবিক রাজ্যে, কীভাবে তারা পারলো এমন এক নির্মম ঘটনার জন্ম দিতে। ঘটনাটা ঘটেছে উত্তর কেরালার মালাপ্পুরমে। পাশের সাইলেন্ট ভ্যালি নাশনাল পার্ক থেকে একটা হাতি বেরিয়ে এসে কাছের গ্রামে উপস্থিত হয় খাবারের সন্ধানে। সে পথ দিয়ে হাঁটার সময় তাকে আনারস খেতে দেয় স্থানীয় বাসিন্দারা। আনারসটির ভেতরে ছিল বারুদ ভর্তি। বাজিপটকা জাতীয় বিস্ফোরক আনারসে ঢুকিয়ে হাতিটাকে খেতে দেয়া হয়েছিলো।

মিঃ হাইজিন জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

সেটা খাওয়ার পরে যখন তার মুখের মধ্যে বিস্ফোরণ হতে শুরু করলো, তাতে হাতিটা ভয়ে হকচকিয়ে যায় এবং তার জিভ ও গোটা মুখ ভয়ঙ্করভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়। এতে তার দাঁতও ভেঙে যায়। রক্তাক্ত হয়ে ওঠে সারা মুখ। পরে যন্ত্রণা ও ক্ষুধায় হাতিটা গ্রামের ভেতর দিক বিদিক ছুঁটতে থাকে। কিন্তু এই চরম অস্বস্তির মধ্যেও সে কোনও বাড়ি ভাঙেনি, কাউকে আক্রমণও করেনি। পরে যন্ত্রণার উপশম পেতে সে স্থানীয় ভেলিয়ার নদীতে নেমে যায় পানি খেতে।

টানা ৩ তিন ধরে পানিতে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো ঐ অসহায় হাতি। এই সময়টা ধরে তার মুখ এবং শুঁড় পানির নীচেই ছিল। এতে হয়তো সে কিছুটা আরাম পাচ্ছিলো। গত ২৫শে মে খবর দেয়া হলে, হাতিটাকে প্রথমবার লক্ষ্য করে স্থানীয় বন বিভাগ। সে আহত হয়েছে বুঝতে পারার পর বন বিভাগের কর্মকর্তারা চেষ্টা করেছিলেন নদী থেকে হাতিটিকে সরিয়ে এনে তার চিকিৎসা দেয়ার।

যা ঘটেছে

তাই তাকে পানি থেকে উদ্ধার করতে আরও দুইটা হাতি পাঠানো হয়। কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে একচুল নড়েনি হাতিটা। বিশ্বাসের যে প্রতিদান সে পেয়েছে, এরপরেও কীভাবে আবার সেই বিশ্বাসের জন্ম হয় তার ভেতর? অবশেষে ২৭শে মে নদীতে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই হাতিটা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মন খারাপের ট্রেন হয়তো এখানেই থামতে পারতো, মরে গিয়ে বেঁচে গেছে যে প্রাণ- তার গল্পটা যেন শেষ হয়েও হলো না।

মরদেহ ময়নাতদন্তের পর জানা যায় যে হাতিটা অন্তঃসত্ত্বা ছিলো। তার ভেতরেও বেড়ে উঠছিলো একটা প্রাণ। হয়তো সেই প্রাণের বাড়তি ক্ষুধার তাগিদেই লোকালয়ে ছুটে এসেছিলো সে। তাই মানুষের দেয়া খাবার অন্ধবিশ্বাসে খেয়েছিলো সে।

আনুমানিক ১৪-১৫ বছর বয়স্ক হাতিটা নিজেকে নিয়ে ভেবে নয়, বরং ওর শরীরে বেড়ে ওঠা প্রাণ, যে আরও ১৮ থেকে ২০ মাস পরে ভূমিষ্ঠ হতো তাকে নিয়েই চিন্তিত ছিলো পুরোটা সময়। তাই সে অনাগত সন্তানকে বাঁচানোর জন্য পানিতে নেমে যায়। যে অমানুষগুলো মা হাতিটার সাথে এই নির্মম আচরণ করলো তারা তো কখনোই সে মায়ের অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করতে পারবে না।

অথচ যা ঘটতে পারতো

মোহন কৃষ্ণান নামে কেরালা বন বিভাগের র‍্যাপিড রেসপন্স টিমের একজন ফরেস্ট অফিসার ঘটনাটার বিবরণ দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করার পর সেটা ভাইরাল হয়ে ওঠে, সেদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এদেশের নিউজফিডেও আলোড়ন তুলেছে নির্মম এই ঘটনা। ফরেস্ট অফিসার মোহন যখন সংবাদ মাধ্যমকে বিবৃতি দিচ্ছিলেন তখন নাকি সেটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন উপস্থিত সাংবাদিকেরা।

"ডাক্তার যখন হাতিটির ময়নাতদন্ত করেন- তখন তিনি জানতে পারেন যে হাতিটি ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলো। হাতিটির ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় কাজ করেছিলো পুরো সময়টায়। সে জানতো তার মৃত্যু আসন্ন। শুঁড়সহ গোটা শরীর রক্তময়, যন্ত্রণায় জ্বলছিল সারা দেহ। এই অবস্থায় সে তার সন্তানের কথা ভেবে চলে যায় নদীর মাঝে জলের মধ্যে যাতে সেই রক্তাক্ত জায়গায় পোকা-মাকড় না বসে। যতক্ষণ প্রাণ ছিল সে চেষ্টা করেছিলো যাতে তার সন্তানের কষ্ট একটু হলেও কম হয়। আর শেষ অবধি সে ঐ মাঝ নদীতেই প্রাণ ত্যাগ করে।" কাঁপা গলায় এভাবেই বিবৃতি দেন মোহন কৃষ্ণান।

নির্বাক প্রাণীদের প্রতি সহিংসতা নতুন কিছু না, এটা মানবকূলের সহজাত স্বভাব। হয়তো নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লড়াইয়ে হরহামেশা এই হীনম্মন্যতা দেখানোতে লজ্জার উদ্রেক ঘটে না তথাকথিত সৃষ্টির সেরা জীবের। ওদিকে বোবা প্রাণীদের ওপর নির্যাতন চালানোকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বৈধতা তো দিয়ে রেখেছি এই আমরাই। 

যে প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নেই 

হাতিটা না হয় লোকালয়ে চলে এসে বিরাট অপরাধ করে ফেলেছিলো, তবুও সে তো কারো ক্ষতি করেনি। তার দোষটা না হয় খুঁজে বের করা গেলো, কিন্তু কী অপরাধ ছিলো একটা অনাগত নিষ্পাপ প্রাণের? একটা বোবার প্রাণীর দেহত্যাগ ও আমাদের এই হাহাকার প্রমাণ করে দেয় কেরালার কলঙ্ক হয়েই রয়ে যাবে ঘটনাটা।

এই মানুষই একমাত্র প্রাণী যে ক্ষুধা ছাড়াও মজার ছলে হত্যা করে অন্য প্রাণীকে। অথচ, ঘটনাটা অন্যভাবেও ঘটতে পারতো। আমরা হয়তো পড়তে পারতাম অন্য রকম একটা গল্প। কীভাবে একটা অসহায় অন্তঃসত্ত্বা হাতিকে খাবার দিয়ে বাঁচালো একদল গ্রামবাসী, সেটাও ঘুরতে পারতো আমাদের নিউজফিডে... আমরা না হয় কিছুটা গর্ব করেই বলতাম, মানবতা এখনো বেঁচে আছে...  

তথ্যসূত্রঃ এনডিটিভি ডট কম 

আরো পড়ুন-


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা