ড্রাইভার হবার স্বপ্ন দেখা 'ইমন' আপনার অপেক্ষায়...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মানুষ হিসেবে আমি মৃগেল মাছ টাইপের। প্রতিকূল পরিবেশেও নির্লিপ্ত থাকি। অধিকাংশ দুঃখবোধ আমাকে স্পর্শ করে না। ইমনের অসহায়ত্বও আমার নির্লিপ্ততা কাটাতে পারল না। কিন্তু..
রাজীব হোসাইন সরকার: বাংলাভিশন অফিসের সামনে বসে আছি। দুটো চাইনিজ কমলা ছিলতে ছিলতে একটা ছোট ছেলে আর একজন বয়স্ক লোক আমার পাশে বসল। আমি বিরক্ত হয়ে ছেলেটাকে বললাম, - 'নাম কী?' - 'ইমন'। - 'ইমন তুমি কমলা আস্তে ছেলো। আমার গায়ে রসের ছিটা আসছে।'
ইমন কমলা ছেলা বন্ধ করল। তার চোখেমুখে অসহায়ত্ব। মানুষ হিসেবে আমি মৃগেল মাছ টাইপের। প্রতিকূল পরিবেশেও নির্লিপ্ত থাকি। অধিকাংশ দুঃখবোধ আমাকে স্পর্শ করে না। ইমনের অসহায়ত্বও আমার নির্লিপ্ততা কাটাতে পারল না। আমি চুপচাপ পিডিএফ পড়ছি।
পাশের বৃদ্ধলোক আকস্মিক আমার উরুতে হাত দিলেন। হাত স্থির নয়, নড়াচড়া করছে। ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করছে। আমি ধমকে হাত সরাতে বললাম। লোকটি চমকে হাত সরাল। ইমন কিছু বলল না। জাগতিক সকল প্রকার কর্মাকান্ডের প্রতি একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে ছেলা কমলা বৃদ্ধ লোকটির হাতে তুলে দিল। ব্যাপারটা তখনই আমি ধরে ফেললাম।
লোকটি অন্ধ, ছেলের হাতে কমলা খুঁজতে ভুল করে আমার উরুতে হাত দিয়ে ফেলেছে। মৃগেল মাছও মাঝেমাঝে নড়াচড়া করে। অক্সিজেনের অল্প অভাবেই মারা যায়। আমার রাগও মারা গেল। আমি ইমনকে বললাম, - 'তুমি এখানে বসলে কেন?' - 'ক্ষুধা লাগছে। আব্বাকে কমলা খাওয়াইতে বসছি।' - 'তোমার আব্বা কমলা ছিলতে পারে না?' - 'পারে।
কমলাগুলো অনেক শক্ত, ছেলা যায় না। রাস্তায় কুড়ে পাইছি তো। কে জানি বিক্রি হয় না তাই ফেলে দিছে, তাই আমি ছিলে দিচ্ছি।' ইমনের চোখেমুখে লজ্জা। কমলা কুড়িয়ে খাওয়া ব্যাপারটি যে লজ্জার হতে পারে সম্ভবত সে ধরে ফেলেছে। - 'ইমন তোমার বাসা কোথায়?' - 'কারওয়ান বাজার।' - 'এখানে কী করো?' - 'সজুতা তুলি' - 'সজুতা কী?' ইমন বলতে পারল না, সজুতা কী!
পাশ থেকে তার বৃদ্ধ পিতা বলল, 'তিন বছর আগে টাইফয়েডে চোখ নষ্ট হইছে স্যার। ফার্মগেট ইসলামিয়ায় দুইবার অপারেশন দিছে। চোখ ঠিক হয় নাই৷ চট্টগ্রামে একবার করছি৷ তাও হয় নাই। ডাক্তার বলছে, মাথার রগ শুকায় গেছে। তাই সাহায্য নিয়া খাই বাবা।' সজুতা যে ভিক্ষাকে (সহযোগীতা) বোঝানো হচ্ছে এবং আট বছরের এই বাচ্চা ছেলেটা ভিক্ষা বলতে লজ্জা পাচ্ছে, ব্যাপারটা আমার কাছে কেন যেন আকস্মিক ভাল লেগে গেল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'তোমার মা কই?' - 'নারায়নগঞ্জে।'
- 'সেখানে কী করে?'
- 'কাজ করে। আব্বা সজুতা তোলে তাই তার সাথে থাকে না।'
- 'তুমি কেন থাকো? তুমিও মায়ের মত চলে যাও। আব্বার হাত ধরে ভিক্ষা করতে লজ্জা লাগে না?'
বৃদ্ধ লোকটি বেশ লজ্জা পেলেন। তিনি ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন। ছেলে চুপ হয়ে গেল। - 'ইমন, তুমি পড়ো না?' ছেলের পিতা বলল, - 'থ্রি পড়ছে। এরপর ছাইড়া দিছে।' - 'কেন?' পিতাকে জবাব দেবার সুযোগ না দিয়ে ইমন বলল, - 'আব্বা একা চলতে পারে না। আমি নিয়া বেড়াই।'
এরপর পাঁচমিনিট কথা হল। বৃদ্ধ আগে মেকানিক ছিলেন। সাইকেল ভ্যানের কাজ করতেন। টাইফয়েডের পর চোখ অন্ধ হবার সাথে সাথে তাকে কাজ এবং স্ত্রীকে ছেড়ে পথে নামতে হয়েছে। এক লক্ষ টাকায় নিজের বাড়ি বিক্রি করে চিকিৎসা করেছেন। টাকা শেষ হলেও চোখ ভালো হয়নি। আমি ইমনকে জিজ্ঞাসা করলাম, - 'বড় হয়ে কি হতে চাও?' - 'কারে কাজ করব।' - 'কাজ নাকি ড্রাইভার হতে চাও?'
ইমন লজ্জা পেল। তার পিতা হেসে বলল, - 'ড্রাইভার হইতে চায়।' অতি সাধারণ স্বপ্ন। এর পেছনে সম্ভাব্য লজিক হতে পারে জীবনের কাঠিন্য ও নির্মমমতা দেখে তার ধারণা হয়েছে, কাচের আড়ালে ঐ গদির চেয়ারে বসে স্টিয়ারিংটা ধরলেই বোধ হয় পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখী জীবন যাপণ করা সম্ভব। আমি তাকে বাসার ঠিকানা দিতে বললাম। দিতে পারল না। ইমনের পিতাও স্পষ্ট বলতে পারল না। একটা সময় উনি জিজ্ঞাসা করলেন, - 'আপনি কী করেন বাবা?' -
'ডাক্তার। কিন্তু ডাক্তারি করি না।' উনি কী বুঝল, সামান্য মৃগেল মাছ টাইপের মস্তিষ্ক নিয়ে ধরতে পারলাম না। উনি এবার আমার গলার স্বর অনুসরণ করে আমার মাথায় হাত রাখলেন। হাত মাথা থেকে গাল বেয়ে পিঠে গেল। প্রথমবারের মত খারাপ লাগল না। তবে কোন একটা অপ্রকাশ্য কারণে মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
আমি বললাম, আসেন একটা ছবি তুলি। ইমন এক হাত তার বাবার কাঁধে রেখে আমার কাঁধে মাথা রাখল। আমি বললাম, 'মাথা সরাও।' ইমন মাথা সরাল না। আমি ধমক দিলাম। তবুও সে মাথা সরাল না। জাগতিক মায়া মমতা কোন লজিক মেনে চলে না। হতে পারে আমার ধমকে কিংবা তাদের প্রতি মৃদ্যু আগ্রহের কারনে তার ধারণা হয়েছে এই মৃগেল মাছের কাঁধেও মাথা রাখা যায়। কিংবা বিপর্যস্ত জীবনে নিষ্ঠুরতার আড়ালে তারা একটু একটু করে ভালোবাসা খুঁজে বেড়ায়। কিংবা কয়লায় হীরে থাকার মতো ধমকের আড়ালে তারা জনৈক মৃগেল মাছের সস্তা দামের ভালোবাসাটা ধরতে পেরেছে।
ছবি তোলা শেষে ইমন জিজ্ঞাসা করল, ছবি কেমন হইছে দেখি। আমি দেখালাম। ইমনের পিতা মুখ বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। যদিও আমি জানি তিনি দেখতে পান না তবুও বললাম, এই দেখেন আপনাকে সুন্দর লাগছে। আপনার ছেলেকে লাগছে প্রিন্সের মত। প্রিন্স মানে রাজপুত্র। যার ঘোড়া থাকে।
ইমনের ঘোড়া নেই। কিন্তু ইমনের থাকবে একটা গাড়ি। কার গাড়ি। ইমন একসময় মন খারাপ করে বলল, 'আব্বা চলেন বাসায় যাই। আজ আর না।' ইমনের পিতা তার সন্তানের হাত ধরে ধীরেধীরে রাস্তা পার হয়ে মানুষের মাঝে মিশে গেল। ছবি তোলার পেছনে কারণ হল- এই ছবি যদি কেউ দেখে ফেলে, সে যদি সহৃদয়বান হয় এবং পান্থপথের আশপাশ দিয়ে যাবার পথে ভুল করেও ইমনকে দেখে ফেলে, সে যেন গাড়ির কাচ নামিয়ে তাকে বলে ফেলে, চলো, তোমার বাসায়। যতটুকু পারো শিক্ষিত হও।
আমি একদিন ফিরে আসব। সেদিন তুমি প্রথম স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালানো শিখে ফেলবে। হয়ে যাবে আমার ড্রাইভার। আমি নিশ্চিত, শুধু এতটুকু নিশ্চয়তা পেলেই ইমন সহস্র বছর অপেক্ষা করে নিজেকে তার স্বপ্নপূরণের জন্য তৈরি করে ফেলবে। অপেক্ষা করবে আপনার জন্য।