এখানে প্রকৌশলীকে যখন ইচ্ছা মার দেয়ার অলিখিত লাইন্সেস তৈরি হয়ে গেছে। মার দিতে দিতে চাইলে খুন করেও ফেলে রাখা যায়।, অসুবিধা নেই। প্রকৌশলীদের পক্ষে প্রতিবাদের ভয়েজ নেই।

আজ রাজশাহী গণপূর্ত অফিসে ঢুকে দেলোয়ার হোসেন নামের এই প্রকৌশলীকে মনের খায়েস মিটিয়ে পিটানো হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে তার ল্যাপটপ, অফিসের চেয়ার টেবিল, প্রিন্টার। 

দেলোয়ারের অপরাধ, তিনি অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। রাজশাহীর পুঠিয়ায় ভূমি নির্মাণের কাজ চলছিল। প্রকৌশলী দেলোয়ার কাজের অগ্রগতি দেখতে সরোজমিনে গিয়ে দেখতে পান, সেখানে নিম্নমানের ইটের খোয়া দিয়ে ঢালাই কাজ চলছে। সিডিউলে চার ইঞ্চি ঢালাই দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হচ্ছে মাত্র আড়াই ইচ্ছি। 

এমন নিম্নমানের কাজের দরুণ বছর খানেকের মধ্যে হুড়মুড় করে ভেঙে যেতে পারে ছাদ, আহত কিংবা নিহত হতে পারে বহু মানুষ। দেলোয়ার ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ বন্ধের নির্দেশ দেন। নিন্মমানের সামগ্রী সরিয়ে ফেলতে বলেন। 

ঠিকাদার লিটন ও তার সহকারী এতে রেগে যান। সামান্য প্রকৌশলীর এতো সাহস কীভাবে হয়! তারা দেলোয়ারের অফিসে আসেন এবং পিটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতাল পাঠিয়ে দেন। 

কিন্তু ঠিকাদার লিটনের প্রতি কৃতজ্ঞতা। দেলোয়ারকে সে যে খুন করে ফেলে দেয় নাই এটাই রক্ষা! কারণ এখানে প্রকৌশলীকে যখন ইচ্ছা মার দেয়ার অলিখিত লাইন্সেস তৈরি হয়ে গেছে। মার দিতে দিতে  চাইলে খুন করেও ফেলে রাখা যায়। অসুবিধা নেই। প্রকৌশলীদের পক্ষে প্রতিবাদের ভয়েজ নেই।

গত মে মাসে গাজীপুরের আরেক প্রকৌশলী দেলোয়ারকে (জি, উনার নামও দেলোয়ার) মাত্র পনেরো হাজার একশো টাকার চুক্তিতে দিনে দুপুরে হত্যা করে বেড়িবাঁধে লাশ ফেলে রাখা হয়। 

সৎ প্রকৌশলী হিসেবে গাজীপুরের সুপরিচিত সেই দেলোয়ারেরও একই সমস্যা ছিল। ঠিকাদারের কথা অনুযায়ী নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারে তিনিও বাধা দিয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে গাজীপুরের প্রকৌশলী দেলোয়ারকে খুন করে ফেলে হয়। 

এর আগে জানুয়ারি মাসে বাঘা উপজেলায় ফরিদুল ইসলাম নামের আরেক প্রকৌশলী রাস্তা নির্মাণে দুই নম্বরি ইটের ব্যবহারে প্রতিবাদ করলে সেখানকার ঠিকাদার তাকে রাস্তায় জনসম্মুখে মনের আনন্দে চড় থাপ্পড় মারে। বিচার হয়নি। হবেও না। 
 
ডাক্তারদের গায়ে হাত তুললে তারা সঙ্গে সঙ্গে কর্ম বিরতিতে চলে যায়। ডাক্তারদের  বড় বড় সংগঠনগুলো প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠে। সেনা বা পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ আহত বা নিহত হলে সমগ্র দেশ কেঁপে উঠে, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করে। ছাত্রদের সাথে বাস ভাড়া নিয়েও সামান্য দুর্ব্যবহার হলে রাস্তা আটকে শহর অচল করে দেয়া হয়। একজন সাংবাদিক নির্যাতিত হলে সমগ্র মিডিয়ায় তোলপাড় হয়। একযোগে নিউজ হয়। পরিবহন শ্রমিকদের চোখে চোখ তুলে কথা বললে বন্ধ হয়ে যায় গাড়ির চাকা। ওরা অপরাধ করলেও শ্রমিকদের  সংঘবদ্ধ আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে পুরো দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। 

প্রকৌশলী একমাত্র পেশা, যাদের ভিতর ন্যুনতম ইউনিটি নেই, সংঘবদ্ধ কার্যক্রম নেই, নেই অভিভাবক, নেই ছায়া। প্রকৌশলীরা মার খায়। ক্লাশ এইট পাশ নেতার হাতে চড় খেয়ে অপমান হজম করে ফেলতে হয়। দিনে দুপুরে খুন হলেও প্রকৌশলীদের পক্ষে রাজপথে দাঁড়িয়ে বিচার দাবীর কেউ নেই। ওদের জন্য বিচার চেয়ে প্রেস কনফারেন্স হয় না, টিভি চ্যানেলে কথা বলার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রকৌশলীদের পক্ষে অনলাইনে প্রতিবাদের ভয়েজ নেই। খুব সম্ভবত এই দেশের পেশাজীবীদের মধ্যে 'প্রকৌশলী'রা সর্বাপেক্ষা দুর্বলতম পেশাজীবী সংগঠন, যাদের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিয়ে কেউ ভাবিত নয়।

এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কোন অভিভাবকের মুখে আর গর্বিত কন্ঠে শোনা যাবে না 'আমার সন্তানকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবো'। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা