‘ইতি,মা’ মাথাভারী কোনো 'আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' গল্প নয়। ১ ঘন্টা ২৫ মিনিটের সাদামাটা আমার-আপনার পরিবারের গল্প। তবে এই সাদামাটা গল্পই আমাকে ভাবিয়েছে, কাঁদিয়েছে, গর্ব করে বলতে বাধ্য করেছে বাংলাদেশেও এমন কাজ হয়।

রুম্মান রশীদ খান:

যে কোনো নাটক/ সিনেমা ভালো লাগলে বিদ্যুৎ গতিতে সবার কান পর্যন্ত পৌছে দেয়া আমার অভ্যেস। তবে গতকাল রাতে ‘ইতি, মা’ দেখার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি বলছি কম, ভাবছি বেশি। কি দেখলাম তার চেয়ে বড় ভাবনার জায়গা তৈরি হয়েছে-কি করলাম আমি আমার মায়ের জন্য। মায়েরা ঈশ্বরের রূপ নিয়ে আসে।  কিন্তু মাঝেমধ্যে কারো কারো কাজ দেখে মনে হয় স্বয়ং ঈশ্বর ভর করেছে; ‘ইতি’মা’ তেমনই একটি কাজ। 

অতি আবেগে কিছু বলতে চাইনি বলে নিজেকে সময় দিয়েছি। ঘোর কেটে যাবার পর এখন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলছি, ‘ইতি,মা’ শুধু একটি টেলিভিশন প্রডাক্সন নয়, এটি বিশাল অনুভূতির নাম। সর্বশেষ দেখা কোন টেলি-ফিকশনের থরে থরে এতটা মায়ায় জড়ানো ছিল, মনে পড়ে না। যদিও ‘ইতি,মা’ মাথাভারী কোনো 'আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' গল্প নয়। ১ ঘন্টা ২৫ মিনিটের সাদামাটা আমার-আপনার পরিবারের গল্প। তবে এই সাদামাটা গল্পই আমাকে ভাবিয়েছে, কাঁদিয়েছে, গর্ব করে বলতে বাধ্য করেছে বাংলাদেশেও এমন কাজ হয়। কখনো এমনটা মনে হয়নি আগে। 

কেন্দ্রীয় চরিত্রে যারা অভিনয় করেছে তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম; একটি production এর সবাই যেন (এমনকি সুজনের বন্ধু, করিম চাচা, বোনের অফিস কলিগ প্রমুখ) তাদের নিজ নিজ চরিত্রে অভিনয় করার জন্যই জন্ম নিয়েছেন। মূল চরিত্রে শিল্পী সরকার অপু, রুমানা রশীদ ঈশিতা, আফরান নিশোকে দেখে বার বার মনে হয়েছে, তারা পেশাদার অভিনয়শিল্পী নন, তারা সত্যি সত্যিই কুমিল্লার নার্গিসের মা, নার্গিস আর সুজন। 

ইতি, মা... নাটকের কয়েকটি দৃশ্য

প্রতিটি সম্পর্কের রসায়নের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো এতটা প্রগাঢ় দাগ ফেলেছে মনে, আমি অন্তত কখনো ভুলতে পারবো না ‘ইতি, মা’। ঠিক ১ম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য আমি আর মিতু পরস্পরের সাথে কথা বলিনি। শেষ করার পর আমরা দুজন দুজনের হাত ধরে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। আমার চোখ, মুখ, বুক তখন এক খন্ড নদী। বার বার ভাবছিলাম, এমন কাজও কি কোনো দর্শকের খারাপ লাগতে পারে? সম্ভব?

‘ইতি,মা’ দেখার পর থেকে প্রায় প্রত্যেক অভিনয়শিল্পীর কাছে গিয়ে hug করতে ইচ্ছে হয়েছে। বিশেষ করে শিল্পী সরকার অপু একজন মুসলিম মায়ের চরিত্রে কতটা বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন, তা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ না করলে বোঝা যাবে না। আফরান নিশো তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা (কিংবা সেরা) অভিনয় দেখিয়েছেন, flawless যাকে বলে। বিশেষ করে ঢাকা থেকে ফিরে ঈশিতার সাথে সংলাপহীন কান্নার দৃশ্যগুলোতে দুজনের অভিনয় বাংলা নাটকের ইতিহাসের একটি সেরা দৃশ্য হিসেবে একদিন সবাই স্মরণ করবেন। 

রুমানা রশীদ ঈশিতাকে ‘ইতি,মা’ তে যতই দেখছিলাম, ততই আফসোস করছিলাম-‘পাতা ঝরার দিন’-এর আগে লম্বা সময় কী অপব্যবহারটাই না আমরা করেছি এই অবিশ্বাস্য অভিনয় প্রতিভাকে। ঈশিতাকে ভুলিয়ে নার্গিস হয়ে থাকবার জন্য প্রিয় এই অভিনেত্রীর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা। ছোটবেলার ‘ফালানী’ আর বড়বেলার ‘নার্গিস’ পৃথিবীর সব ধরনের পুরস্কারের ঊর্ধ্বে। 

পরিচালক আশফাক নিপুন চাইলে ‘ইতি,মা’ তে অনেক ডিটেইলিং না রাখলেও পারতেন। হজ্বের অফিসে যাওয়া কিংবা বিমানবন্দরে দৃশ্যধারণ, সুই ফুঁটিয়ে নিশোর সরাসরি রক্ত দেয়া সহ আরো অনেক দৃশ্য। কিন্তু আপসহীন পরিচালক সেটি করেছেন। এজন্যই হয়তো তিনি এ সময়ের শ্রেষ্ঠতম পরিচালক, নাট্যকার। তবে লেখক হিসেবে তিনি এগিয়ে নাকি পরিচালক হিসেবে-আমি সন্দিহান। ‘ভিক্টিম’ এগিয়ে নাকি ‘ইতি,মা’-আমি সন্দিহান। এতদিন আশফাক নিপুনের কিছু কাজ ভালো লাগতো, কিছু লাগেনি। তবে এবারের ঈদে তার তিনটি কাজ দেখার পর ব্যক্তিগতভাবে আমি এই নাট্যকার, নির্মাতার অফিসিয়াল ডাইহার্ড ফ্যান হয়ে গেছি। হ্যাটস অফ টু ইওর এন্টায়ার কাস্ট এন্ড ক্রু অফ 'ইতি মা'। হাইলি রেকমেন্ডেড ফর অল। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা