যার নির্দেশে ভুতুড়ে বিল, তিনিই যখন তদন্ত কমিটির প্রধান!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ভুতুড়ে বিলের ব্যাপারে একটা তদন্ত কমিটি করে অনেক কর্মচারীকে শাস্তি দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। অথচ সেই তদন্ত কমিটির প্রধান যিনি ছিলেন, সেই শহিদুল ইসলামই এসব ভুতুড়ে বিল বানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন! যিনি প্রধান অপরাধী, তিনিই বিচারক- এমন ঘটনা বাংলাদেশেই সম্ভব!
বিষে বিষক্ষয় বলে একটা প্রবাদ আছে।বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বাংলা এই প্রবাদটাকে ভীষণ সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছেন। ভুতুড়ে বিলের ব্যাপারে হাজার হাজার অভিযোগ আসার পরে ডিপিডিসি অবশেষে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, ভুতুড়ে বিলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়ার কাজ করবে এই কমিটি। কিন্ত হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, এই তদন্ত কমিটির যিনি প্রধান, সেই এসএম শহিদুল ইসলামই নাকি নির্দেশ দিয়েছিলেন ভুতুড়ে বিল বানিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের 'সাফল্য' প্রমাণ করতে! এরকম অদ্ভুত নজির শুধু বাংলাদেশেই দেখা যাবে, যার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, তিনিই তদন্ত কমিটির প্রধান! অবশ্য, ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিলের মতো আজব নজিরের দেখাও বাংলাদেশেই মিলবে, বিশ্বের আর কোন দেশে এই জিনিস নেই।
প্রথম আলোর একটা বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে পড়লাম, সেখানে বলা হয়েছে, ভুল করে নয়, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েই বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল করেছিল ডিপিডিসি। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাড়তি রাজস্ব দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘পারফরম্যান্স বোনাস’ নেওয়া। একই সঙ্গে প্রথাগত লোকসান (সিস্টেম লস) কমিয়ে দেখানো ছিল এর উদ্দেশ্য। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুও এই প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
ডিপিডিসির তথ্যপ্রযুক্তি শাখা থেকে সংস্থাটি ৩৬টি স্থানীয় কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসের বিল বেশি করতে নির্দেশনা দিয়েছিল। এবং নির্দেশদাতা ছিলেন আইটি শাখার প্রধান এসএম শহিদুল ইসলাম। এই বাড়তি বিল ৩৬টি কার্যালয়ে কী পরিমাণ বেশি করতে হবে, সেটাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের তিন মাসের বিলের সঙ্গে তুলনা করে এ বছরের তিন মাসে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৬১ শতাংশ বিল বেশি করতে বলা হয়।
রাজধানী ঢাকার মধ্যে সর্বোচ্চ বিল করার নির্দেশনা ছিল মুগদাতে ৬১.০৭%, বাসাবোতে ৬.৮৩%, বনশ্রীতে ৫৬.০৪ %, মগবাজারে ৫০.৪৪%, আজিমপুরে ৪৬.৫৭% ও রাজারবাগে ৪৭.৭১%। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ জেলার ১৩টি কার্যালয়ের অধীনে থাকা গ্রাহকদের মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জে ৩০% ও নারায়ণগঞ্জ পশ্চিমে ২৫% বিল বেশি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই নির্দেশ পালন করতে গিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগে কর্মীরা একটু কাঁচা কাজ করে ফেলেছিলেন। খোদ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ বিদ্যুৎ বিভাগের বড় বড় কর্মকর্তার বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও বিদ্যুতের ‘ভুতুড়ে বিল’ পাঠানো হয়েছিল তখন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুতুড়ে বিল নিয়ে প্রচুর অভিযোগ এবং সমালোচনাগুলো বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীরও চোখে পড়ে। তিনিই এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। মন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে বিদ্যুৎ বিভাগ একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি জুলাই মাসে প্রথম সপ্তাহে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে পাঁচটি সংস্থার প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশের ভিত্তিতে গত ৫ জুলাই ডিপিডিসির একজন নির্বাহী প্রকৌশলীসহ চার কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত হন। এ ছাড়া ৩৬টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রত্যেক নির্বাহী প্রকৌশলীকে ১০ দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে নোটিশ দেওয়া হয়। বদলি করা হয় দুই প্রধান প্রকৌশলীকে।
অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব কর্মকর্তাকে বাড়তি বিল করার নির্দেশনা দিয়েছে খোদ ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ! আর তদন্ত কমিটির যিনি প্রধান ছিলেন, যার সুপারিশে প্রায় তিনশো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে, সেই এসএম শহিদুল ইসলামের নির্দেশেই তৈরি করা হয়েছে ভুতুড়ে বিল! যারা শোকজ নোটিশ পেয়েছেন, তারা জবাবে বলেছেন, ‘‘এসএম শহিদুল ইসলামই তাদের অতিরিক্ত বিল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ কোন এলাকায় কত ভাগ বেশি বিল করতে হবে তাও বলে দেয়া হয়েছি৷’’
শাস্তিপ্রাপ্ত এই কর্মমর্তা-কর্মচারীরা শহিদুল ইসলামের নির্দেশের ই-মেইল এবং তাদের কাছে পাঠানো কোন এলাকায় কত বাড়তি বিল করতে হবে তার নির্দেশনা সংক্রান্ত চার্টও শোকজের সঙ্গে জমা দিয়েছেন৷ তাতে দেখা গেছে, মুগদা এলাকায় সর্বোচ্চ ৬৫ ভাগ বিল বেশি করতে বলেছেন তিনি৷ ৮ এপ্রিল এই নির্দেশ দেয়া হয়৷ জানা গেছে বেশি বিদ্যুৎ বিল আদায় করে সরকারের কাছ থেকে ‘পারফরমেন্স বোনাস’ নেয়াই ছিলো এর উদ্দেশ্য! অর্থাৎ, নিজেদের উদরপুর্তি করার জন্য জনগনের টাকায় কাঁঠাল কিনে জনগনের মাথায়ই ভেঙে খেতে চেয়েছিলেন শহীদুল ইসলাম এন্ড গং!
একে তো ভুতুড়ে বিল বানিয়ে হাজার হাজার গ্রাহককে ভোগান্তিতে ফেলেছেন, সীমাহীন বিড়ম্বনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন, পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগ এবং সরকার- দুই প্রতিষ্ঠানেরই ভাবমূর্তি মাটির সঙ্গে মিশিয়েছেন, তারপর আবার নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিনা অপরাধেই শাস্তি দিয়েছেন। এতগুলো ন্যাক্কারজনক কাণ্ড ঘটানোর পরেও এসএম শহিদুল ইসলাম বা তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কেবল তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে একবার।
দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের টিকিটাও কেউ ছুঁতে পারে না, অথচ আমরা দেখতে পাই, সৎভাবে কাজ করার 'অপরাধে', দুর্নীতিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার মিশন নিয়ে কাজ করা মাহবুব কবির মিলনের মতো কর্মকর্তাদের প্রতি পদে পদে বাধা দেয়া হয়, বিনা অপরাধে ওএসডি করে রাখা হয়। সিনিয়র কর্তারা তাকে পরামর্শ দেন, ফেসবুকে এত বেশি অ্যাক্টিভিটি না দেখানোর জন্য। এই বাংলাদেশে সৎ থেকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে গণমানুষের সমস্যার সমাধান করতে চাওয়াটা অপরাধ, ভুয়া বিল বানিয়ে, গ্রাহকের ভোগান্তির সৃষ্টি করে, জনগনের পকেট কেটে টাকা চুরি করাটা কোন অপরাধ নয়...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন