মোটরসাইকেলে চড়ে গায়ে হলুদ ও 'ফেসবুক মুমিন'দের ফতোয়াবাজি
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বাঙালী পুরুষের মন বড় বিচিত্র, এরা লাইফস্টাইল চায় ইউরোপ-আমেরিকার মতো, দুর্নীতি-চুরি-ধান্ধাবাজী করতে চায় বাংলাদেশের মতো, আর নারীদের বেঁধে রাখতে চায় সৌদি আরবের মতো করে...
গায়ে হলুদের দিন মোটর সাইকেল চালিয়ে শহরজুড়ে শোভাযাত্রা করেছিলেন, যশোরের তরুণী ফারহানা তখনও জানতেন না, সপ্তাহখানেক পরে তিনি পরিণত হবেন টক অফ দ্য টাউনে। ১৩ই আগস্ট তোলা ছবিগুলো ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তেই ভাইরাল হয়ে গেছে ঘটনাটা, দলে দলে 'ফেসবুক মুমিন' আর 'তথাকথিত সমাজ সংস্কারকের দল' এসে ফতোয়া দেয়া শুরু করেছে ফারহানাকে। তিনি কিভাবে ইসলাম ধর্ম এবং বাঙালী সংস্কৃতিকে অপমান করেছেন, সেটারও নসিহত দিচ্ছে হাজার হাজার লোক। ইউটিউবে তো রগরগে শিরোনামে ভিডিওই আপলোড করে বসেছে কিছু ধান্ধাবাজ ইউটিউবার- সব মিলিয়ে তৌহিদি জনতার গলাবাজি এবং গালিবাজির ব্যবসা এখন তুঙ্গে, এবং তার সরাসরি ভুক্তভোগী ফারহানা।
গায়ে হলুদের দিনটাকে অন্যরকমভাবে স্মরণীয় রাখতে চেয়েছিলেন যশোরের মেয়ে ফারহানা আফরোজ। সে কারণে ১৩ আগস্ট শহরব্যাপী ভাই-বোন, বন্ধুদের নিয়ে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা করেন তিনি। ফারহানা মোটরসাইকেল চালাতে পারেন, ঢাকায় তিনি দেখেছেন ছেলেরা মোটরসাইকেলে করে বিয়ে করতে যায়। ফারহানাও ঠিক করে রেখেছিলেন, নিজের বিয়েতে এই কাজটা তিনি করবেন। সেভাবেই বিউটি পার্লার থেকে সাজগোজ করে কাজিন আর বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে চক্কর দিয়েছেন যশোর শহরে, সবার আগে ছিল ফারহানার বাইকটা।
একটা মেয়ে বিয়ের সাজে বাইক চালাচ্ছে, বাঙালী পুরুষ সেটা মেনে নেবে কেন! ধর্মকে ঢাল বানিয়ে তারা মেতে উঠেছে সমালোচনা আর গালাগালিতে। ফারহানা জাহান্নামে যাবেন, তিনি বেলেল্লাপনা করছেন, সমাজকে ধ্বংস করছেন, বিয়ের মতো 'পবিত্র' একটা কাজকে অপমান করছেন, অন্যান্য মেয়েদের উস্কে দিচ্ছেন অসামাজিকতার পথে- কতশত যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে! মা-বাবা তুলে গালাগালি তো আছেই।
এরমধ্যে এক মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবারওয়ালা এক ইউটিউবার নিজের ব্যবসার কাটতি বাড়াতে ফারহানার এই বাইক শো-ডাউন নিয়ে ভিডিওই বানিয়ে ফেলেছে, মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেয়ার জন্যে দিয়েছে মুখরোচক শিরোনামও। সেই ভিডিওর কমেন্টবক্সে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছে ফারহানাকে। অথচ ফারহানা এদের কারো পাকা ধানে মই দেননি, অথচ মস্তিস্ক বর্গা দেয়া এই ব্রেইনওয়াশড জোম্বিদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, ফারহানা মোটরসাইকেলে চড়ে শহরজুড়ে চক্কর দেয়ায় যেন সমাজ-সংসারের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাইকে চড়ে বিয়ে করার ব্যাপারটা নিয়ে ফারহানার নিজের পরিবার এবং তার শ্বশুরবাড়ি- দুই জায়গার লোকজনেরই কোন আপত্তি নেই। তারা যথেষ্ট সাপোর্টিভ, বাইকে চড়ে তোলা ছবিগুলোরও প্রশংসা করেছেন তারা। ফারহানার শ্বশুর তো তাকে নতুন একটা বাইকই কিনে দেবেন বলেছেন! ফারহানার স্বামী, যিনি তার সঙ্গে সারাজীবন সুখে-দুঃখে পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন, তিনিও স্ত্রীকে নিয়ে গর্বিত। অথচ যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই প্রবাদের মতো করে ফেসবুকের তৌহিদি জনতা যুদ্ধ শুরু করেছে ফারহানার বিরুদ্ধে!
মোটরসাইকেলে চড়ে গায়ে হলুদের দিন ফটোসেশন করায় ফারহানা যদি জাহান্নামে যায়, এদের কি সমস্যা? এরা নিজেদের জান্নাত নিশ্চিত না করে অন্যকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে কেন এত আগ্রহী? ধর্মের নাম নিয়ে এরা ফারহানার সমালোচনা করছে, আবার মতের সঙ্গে যুক্তি না মেলায় অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছে- এটা কেমনতর ধর্ম পালন? বাঙালি মুসলমান যেটাকে অশ্লীলতা হিসেবে গণ্য করে, ফারহানার পোষাক আশাকেও সেই অশ্লীলতার ছাপ ছিল না কোথাও। তবুও কেন তারা অভিযোগ করছে যে ফারহানা অশ্লীলতাকে প্রমোট করছে? কেন এই ঘটনাটাকে 'নষ্টামি' বা 'কেয়ামতের আলামত' টাইপের শব্দ দিয়ে অতিরঞ্জিত করার চেষ্টা করছে এরা?
এর একটাই কারণ- ফারহানা বাইকে চড়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করেছেন, এটা এদেশের ধর্মান্ধ পুরুষতান্ত্রিক সেন্টিমেন্টের মুখে ঝামা ঘষে দেয়ার মতোই একটা কাজ হয়েছে। বাঙালি পুরুষদের সিংহভাগ তো নারীকে পায়ের নিচে দমিয়ে রাখতেই পছন্দ করে, ম্যারিটাল রেপ বলে যে কোন শব্দ আছে, সেক্সে কনসেন্ট বলে যে কোন ব্যাপার থাকে, সেটা এই ধর্মান্ধ লোকগুলো বিশ্বাসই করতে চায় না। ফারহানার মতো মেয়েরা বাইকের সিটে বসে সমাজের ড্রাইভিং কন্ট্রোলটা নিজেদের হাতে তুলে।নিলে সবচেয়ে বড় সমস্যায় তো এই প্রজাতিটাই পড়বে! আর তাই হায়েনার মতো এরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিরোধিতায়, জড়াচ্ছে নোংরামিতে।
শুধু তো পুরুষ নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে নারীরাও ফারহানার নিন্দায় মত্ত হয়েছেন, গার্লজ গ্রুপগুলোতেও বসেছে নোংরামির মচ্ছব। অথচ ফারহানা এদের খানও না, পরেনও না। তবুও এই মহিলাদের তাকে নিয়ে অসীম আগ্রহ। পুরুষতন্ত্রের নিচে যুগের পর যুগ দমে থাকতে থাকতে এরা পুরুষদের সুপ্রীম ভাবা শুরু করেছে, তাই নিজের দলের কেউ যখন মাথা তুলে দাঁড়ায়, তারা সেই মাথাটা কেটে দিতে চায়। এদের কাছে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো পুরুষ সঙ্গীটির সেবা করে যাওয়া, 'অমুকের বউ', 'তমুকের মেয়ে' বা 'অমুকের মা' বাদ দিয়ে নিজের একটা আলাদা আইডেন্টিটি ক্রিয়েট করার যে গুরুত্ব, সেটা এরা কোনদিন বুঝতে শেখেনি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদেশের পঁচানব্বই পার্সেন্ট মুসলিম পুরুষ বিয়ের সময় দেনমোহরের টাকাটাও পরিশোধ করে না, বাকী রেখে দেয়, যেটা কিনা ধর্মে সুস্পষ্টভাবে হারাম। বিয়ের অনুষ্ঠানে, গায়ে হলুদে হিন্দি গানের সঙ্গে রাতভর নাচাকুদা করা, মদের আসর বসানো লোকগুলোই এখন কাতারে ফারহানার নিন্দায় মত্ত হয়েছেন। বাঙালী মুসলমানের মন যে বড় বিচিত্র, এটা তো আহমদ ছফা অনেক আগেই বলে গেছেন। এরা লাইফস্টাইল চায় ইউরোপ-আমেরিকার মতো, দুর্নীতি-চুরি-ধান্ধাবাজী করতে চায় বাংলাদেশের মতো, আর নারীদের বেঁধে রাখতে চায় সৌদি আরবের মতো করে।
ফারহানার সমালোচনা করতে হলে তার মাথায় হেলমেট কেন নেই, মুখে মাস্ক কেন নেই, সেটা নিয়ে করুন। প্রশ্ন করতে চাইলে গায়ে হলুদ বা বিয়ের অনুষ্ঠানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হয়েছিল কিনা, সেটা জানতে চান। মোটরসাইকেলে চড়ে বিয়ে করাটাকে ইস্যু বানাবেন না। একটা ছেলে বাইকে চড়ে বিয়ে করতে যেতে পারলে, একটা মেয়েও গায়ে হলুদের দিন কাউকে অসুবিধায় না ফেলে বাইক নিয়ে শোডাউন করতে পারবে। এটা ২০২০ সাল, এই দেশটার নাম বাংলাদেশ। এটা শরীয়াভিত্তিক কোন রাষ্ট্র নয় যে এরকম নোংরা আচরণ একটা মেয়েকে বিয়ের উপহার হিসেবে দিতে হবে...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন