একই দেশে একদল লোক হাজার কোটি টাকা পাচার করে, দুর্নীতি করে, আরেক দল লোক কোনমতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার রোজগারের জন্য লড়াই করে। এই তো বাংলাদেশ!

গণমাধ্যম ও ফেসবুকে ফজলুর রহমান নামে এক রিকশাওয়ালার ছবি দেখে ভীষণ মন খারাপ হলো। এই ঢাকা শহরে গত ২০ বছরে কতো শতোবার যে এমন রিকশা উচ্ছেদ অভিযান দেখেছি বলে শেষ করতে পারবো না। কতোদিন দেখেছি ট্রাকে করে রিকশা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! তখন দেখেছি গরিব মানুষের কান্না। 

এই যেমন আজকের ঘটনাই বলি। ফজলুর রহমানের ছবি দেখলাম রাতে। তার আগে সন্ধ্যার ঘটনা। আমি মহাখালী থেকে হেঁটে লেকের পাড়ে এসে রোজ রিকশায় উঠি অফিস শেষে করে। আজও লেকের পাড় পেরিয়ে ১৪  নম্বর রোডে এসে দেখি চারটা রিকশা আছে। কিন্তু কেউ যাবে না। 

এই রাস্তাগুলোতে মূলত গুলশান-বনানী কিংবা নিকেতন সোসাইটির রিকশা চলে। রিকশার গায়ে সোসাইটির লোগো থাকে। রিকশাওয়ালার পোষাকেও। চারজনের কেউই কেন যাবেন না সেটা বোঝার চেষ্টা করতেই দেখলাম তারা একজন ট্রাফিক কনস্টেবলের কাছে গিয়ে হাতজোড় করে কথা বলছে। 

ঘটনা কী জিজ্ঞেস করতেই এক রিকশাওয়ালা দেখালো তার রিকশার সিটটি রিকশা থেকে নামিয়ে ট্রাফিক কনস্টেবল রাস্তায় নামিয়ে রেখেছে। চারটা রিকশারই একই অবস্থা। কেন নামিয়ে রাখছে জানতে চাইলে রিকশাওয়ালারা বললো তারাও বুঝতে পারছে না। তাদের তো এখানে চলাচলের অনুমতি আছে। 

আমার কিছুটা সন্দেহ হলো। মনে হলো পুলিশ বা সিটি করপোরেশন যদি রিকশার বিরুদ্ধে এখানে অভিযান চালাতো তাহলে তো তাদের লোকজন থাকতো। আমি কনস্টেবল ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম ভাই এদের সীট নামিয়ে রেখেছেন কেন? তিনি ধমকের সুরে আমাকে বললেন সেটা আপনাকে বলতে হবে কেন? 

আমি বললাম ভাই রে আমি তো রিকশায় করে বাসায় যাবো। রিকশা না পেলে কীভাবে যাবো? তিনি বললেন অন্য রিকশা খুঁজেন। সামনে যান। এই রিকশাগুলো এখন যাবে না। 

আমি তখন জিজ্ঞাসা করলাম কেন যাবে না? এদের অপরাধ কী? আপনি যে সীট নামিয়ে রেখেছেন এটা কী পুলিশের কোন অফিসারের নির্দেশে নামিয়েছেন? কই কোন অফিসারকে তো দেখছি না। কে আপনাকে নামাতে বলেছে? ওই কনস্টেবল  কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন আপনি কী? 

আমি হিমুর মতো শান্ত সুরে বললাম ভাই আমি এই দেশের একজন নাগরিক। তা আপনি বলেন কোন কর্মকর্তার নির্দেশ ছাড়া কী আপনি এভাবে রিকশা আটকে রাখতে পারেন? আচ্ছা আমি এক কাজ করি এখানকার ট্রাফিকের ডিসি সাহেবকে ফোন দেই মোবাইলে। দেখি উনি জানেন কী? 

কনস্টেবল ভাই এবার বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তার ঘাবড়ে যাওয়া দেখে আমি চার রিকশাওয়ালাকেই বললাম আপনাদের সিট নিয়ে যান। 
পুলিশ ভাই দেখি নিজেও বলতেছেন, হ্যা নিয়ে যান। এরপর আমি চারজনের রিকশার একটাতে উঠে রওয়ানা হলাম। আমি যে রিকশায় ছিলাম সেই রিকশাওয়ালা ভাই বললেন, ঢাকায় আজকে অনেক জায়গায় রিকশা ধরতেছে। সেই সুযোগেই বোধহয় এই পুলিশ ভাই কিছু টাকা নিতেন আমাদের কাছ থেকে। আপনি বাঁচালেন। 

রিকশাওয়ালাকে বললাম বাঁচানোর মালিক তো আল্লাহ। তবে ভাই সব পুলিশ খারাপ না। পুলিশ মানেই ঘুষ খায় না। বহু ভালো পুলিশ আছে। এর মধ্যেই ফেসবুকে ফজলুর রহমানের ছবি দেখলাম। তার তো ব্যাটারির রিকশা ছিল। করোনায় দোকানের কাজ হারিয়ে ধারদেনা করে ৮০ হাজার টাকায় রিকশাটা কিনেছিল। 

হ্যা, ব্যাটারি চালিত রিকশা চলার নিয়ম নেই সেটা তো সত্য। কিন্তু হাজারাবীবগ এলাকা বা ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার ব্যাটারির রিকশা চলে কীভাবে? কারা এসবের অনুমতি দেয়? 

রিকশা নিয়ে নিউজ করতে গিয়ে একবার জেনেছিলাম, রিকশার লাইসেন্স বের করা একটা ব্যবসা। নানা সমিতির নামে এই ব্যবসা চলে। যেসব নেতারা রিকশা নামানোর ব্যবসা করে, সিএনজি নামানোর ব্যবসা করে তাদের কিন্তু কিছু হয় না। সব কষ্ট গরিব মানুষের। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় এই ঢাকা শহরে গণপরিবহন বলে তো কিছু নেই। এমন যদি হতো আমরা এই শহরে শুধু রিকশা চলতে দিতাম কী হতো! 

এই যে সব হারিয়ে নানা প্রান্তের মানুষ এই শহরে এসে রিকশা চালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে তাদের জন্য আমরা কী করতে পারি? এমন একটা ব্যবস্থা কী করা যায় না যেখানে গরিব মানুষগুলো অন্তত খেয়ে পরে বাঁচবে। ভাবেন একবার, একই দেশে একদল লোক হাজার কোটি টাকা পাচার করে, দুর্নীতি করে আরেকদল লোক কোনমতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার রোজগারের জন্য লড়াই করে। এই তো বাংলাদেশ!

যাই হোক, রিকশাচালক ফজলু ভাইয়ের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমরা যদি ৮০ জন মানুষ এক হাজার টাকা করে দেই তার একটা রিকশা হয়ে যাবে, কিন্তু আমি জানি না আবারও তার রিকশাটা অন্য কেউ নিয়ে যাবে কী না? কিন্তু আমরা কী তাকে একটা চায়ের দোকান করে দিতে পারি বা অন্য কিছু? আমি আছি। আপনারা যে কেউ চাইলে যুক্ত হতে পারেন তাতে।

ছবি কৃতজ্ঞতা- আসিফ মাহমুদ অভি, বিডিনিউজ২৪ ডটকম

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা