ধার করে ৮০ হাজার টাকায় কেনা রিক্সাটা হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন ফজলুর। রাত পোহানোর আগেই তার মুখের হাসি ফিরে এসেছে, আহসান ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তি তাকে উপহার হিসেবে একটা রিক্সা কিনে দিচ্ছেন...

গতকাল বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত চরিত্রে পরিণত হয়েছিলেন ফজলুর রহমান। পেশায় তিনি একজন রিক্সাচালক। ব্যাটারিচালিত রিক্সা চালান তিনি, যদিও ঢাকায় এই রিক্সা বেআইনী। তবে আইনের তোয়াক্কা না করেই শহরের অলিতে গলিতে চলে এসব রিক্সা। ট্রাফিক পুলিশ দেখলে ৫/১০ টাকা ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেয়। মাঝেমধ্যেই এসব রিক্সা উচ্ছেদের জন্য অভিযান চলে। গত সোমবার জিগাতলা এলাকায় এরকমই একটা উচ্ছেদ অভিযানে আটক করা হয়েছিল ফজলুর রহমানের রিক্সাটা। 

হাজারীবাগের বাসিন্দা ফজলুর রহমান রিক্সাচালক হয়েছেন পনেরো দিন আগে। এক দোকানে কাজ করতেন, করোনার মহামারীর মধ্যে সেই কাজটা হারিয়ে অকুল পাথারে পড়েছিলেন। অন্য কোন কাজ পাচ্ছিলেন না, পকেটে টাকা নেই, বাড়িতে খাবার নেই। অনন্যোপায় হয়ে হাত পাতলেন স্বজন আর বন্ধুদের কাছে, ধার-দেনা করে দিন পনেরো আগে ৮০ হাজার টাকায় একটা ব্যাটারিচালিত রিক্সা কিনেছিলেন ফজলুর। তথাকথিত 'চক্ষুলজ্জা' বিসর্জন দিয়ে বসেছিলেন রিক্সার ড্রাইভিং সিটে। লোকে যা বলবে বলুক, দিনশেষে পরিবারের সবার জন্য খাবার কেনার টাকাটা অন্তত আয় হচ্ছিল। 

ঢাকায় যারা আছেন, তারা জানেন করোনার এই পরিস্থিতির মধ্যে রিক্সাচালকেরা কি বেকায়দায় পড়েছেন। অজস্র মানুষ রুজি-রোজগার হারিয়ে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকলেও তাই অনেক সময় যাত্রী পাওয়া যায় না। আগে যেখানে রিক্সা পাওয়ার জন্য যাত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, এখন সেখানে যাত্রী পাওয়ার জন্য রিক্সাচালকেরা দাঁড়িয়ে থাকেন, একজন যাত্রী এলে তাকে নিয়ে শুরু হয় টানাটানি। যে দূরত্বের ভাড়া আগে পঞ্চাশ টাকা ছিল, সেখানে এখন ত্রিশ টাকায়ও যেতে রাজী হয়ে যান রিক্সাচালকেরা, কারন যাত্রী হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়।

ছবি যখন কথা বলে

সোমবার জিগাতলায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ব্যাটারিচালিত রিকশা উচ্ছেদের জন্য অভিযান চালাচ্ছিল। ফজলুর রহমান তখন সেই এলাকায় ছিলেন। বেচারার ভাগ্য খারাপ, অভিযানকারী দলের সামনে পড়ে গেলেন। ফজলুর রহমান তো আর ঋণখেলাপী বা রাঘব বোয়াল টাইপের কোন দুর্নীতিবাজ নন যে পার পেয়ে যাবেন। ক্রেনে করে তার রিকশাটিও তুলে নেওয়া হলো। 

উপার্জনের একমাত্র সম্বলটিকে চোখের সামনে বিলীন হয়ে যেতে দেখে হতাশায় মুষড়ে পড়েছিলেন ফজলুর, কান্না বাঁধ মানছিল না তার চোখে। রাতে খালি হাতে বাসায় কিভাবে ফিরবেন, কাল থেকে সংসার চলবে কি করে, রিক্সা কেনার জন্য যে টাকাটা ধার করেছেন সেটাই বা ফেরত দেবেন কিভাবে- এসব দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন ফজলুর। অনলাইন গণমাধ্যম বিডিনিউজ২৪ ডটকমের ফটোগ্রাফার আসিফ মাহমুদ অভি তখন ছিলেন সেখানে, কান্নায় ভেঙে পড়া ফজলুরের ছবি তোলেন তিনি, ভিডিওতে ধারন করেন ফজলুরের বক্তব্যও। ৫ই অক্টোবর বিডিনিউজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয় সেসব ছবি। 

তবে ছবিগুলো ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে গতকাল। সহায়-সম্বল হারানো ফজলুর রহমানের কান্নার ছবি দেখে নেটিজেনরা মুষড়ে পড়েছে, দরিদ্র‍্য মানুষটার ওপর এমন অমানবিক আচরণ মেনে নিতে পারেনি মানুষ। হাজার হাজার শেয়ার হয়েছে ফজলুরের কান্নার ছবি, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলেছেন অনেকে, সবাই দুঃখপ্রকাশ করেছেন ফজলুরের জন্য। অজস্র মানুষ ফজলুর রহমানের ঠিকানা জানতে চেয়েছেন। কেউ টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছেন, কেউবা তাকে একটা চাকরি দেয়ার জন্য খুঁজেছেন। 

ফজলুরের মুখের এই হাসিটা টিকে থাকুক

রাতের বেলায় মন ভালো করা একটা খবর এসেছে। আহসান ভুঁইয়া নামের এক ব্যক্তি ফজলুর রহমানকে খুঁজে বের করেছেন, তার কাছে পুরো ঘটনা শুনেছেন, তারপর ফজলুরকে নিয়ে গিয়েছেন গুদারাঘাট এলাকায়। সেখানে নতুন একটা রিক্সার অর্ডার দিয়েছেন তিনি, ফজলুরকে এই রিক্সাটা উপহার হিসেবে দিচ্ছেন তিনি। ফেসবুকে ফজলুরের হাসিমুখের ছবি শেয়ার করে আহসান লিখেছেন- ‘আমরা চাইলেই বদলে দিতে পারি। নতুন রিক্সা অর্ডার দিয়ে বাসায় যাচ্ছি। পরশু ডেলিভারি।’ আহসান ভূঁইয়া পেশায় ব্যারিস্টার, আওয়ামী লিগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য ছিলেন এই ভদ্রলোক।

আহসান ভূইঁয়াকে ধন্যবাদ। বলা হয়, মানুষের মুখে হাসি ফোটানোটা নাকি দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ। সেই কাজটা তিনি করে দেখিয়েছেন। আশা করি আরও অনেকে এগিয়ে আসবেন ফজলুর রহমানের পাশে দাঁড়ানোর জন্য, হয়তো তাকে আর রিক্সাই চালাতে হবে না। ফজলুরের মতো অসহায় অবস্থায় এদেশের শত শত মানুষ প্রতিদিন পড়েন, তাদের সাহায্যেও আমরা অবদান রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব দলবেঁধে, এমন স্বপ্ন দেখি। 'সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে'- কবিতার এই লাইনটা বাস্তবে রূপান্তর করে দেখিয়েছেন আহসান ভূঁইয়া, এবার আমাদের পালা...

ছবি কৃতজ্ঞতা- আসিফ মাহমুদ অভি ও বিডিনিউজ২৪ ডটকম। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা