ফেলানীর আর দেশে আসা হলো না। নো ম্যানস ল্যান্ডে সে আটকে যায়। রাতের দিকে কোচবিহার জেলার চৌধুরীহাট সীমান্তচৌকি সংলগ্ন কাঁটাতারের বেড়া পেরুতে গেলে, আটকে যায় সে। ভয়ে সে চিৎকার করে উঠলে বিএসএফ কিছু না বুঝে ফেলানীকে দেখতে পেয়ে অতর্কিত গুলি করে।
ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে মাঝে মধ্যেই কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে চলে আসে। উইকিপিডিয়া বলছে, ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ বাহিনী কর্তৃক ১৫০০ জন বাংলাদেশি নিহত হয়। সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রত্যেকটি দেশেরই সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মূল কাজ। তবে, এই কাজ করতে গিয়ে কখনো কখনো সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাতে যে নিরপরাধ মানুষও ভিক্টিম হয় না, সেটাই যেন প্রমাণ করে ফেলানী নামক কিশোরীর হত্যাকাণ্ড।
আজ থেকে ৯ বছর আগের ঘটনা। দিনটি ছিল ২০১১ সালের ৭ই জানুয়ারি। সেদিন ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের কুড়িগ্রামের একটি এলাকায় ঘটে এই নির্মম ঘটনাটি। কুড়িগ্রামের অনন্তপুর-দিনহাটা সীমান্তের খিতাবেরকুঠি এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশের এক কিশোরী, যার বয়স তখনো ঠিকমতো পনেরোও পেরোয়নি, সেই ফেলানি নিহত হয়। ফেলানীর বাবা নয়াদিল্লীতে কাজ করতেন। বাবার সাথেই থাকত মেয়েটি। বয়স যখন পনেরো ছুঁই ছুঁই ফেলানীর বাবা ঠিক করলেন মেয়েকে দেশে নিয়ে এসে বিয়ে দিবেন।
কিন্তু, ফেলানীর আর দেশে আসা হলো না। নো ম্যানস ল্যান্ডে সে আটকে যায়। রাতের দিকে কোচবিহার জেলার চৌধুরীহাট সীমান্তচৌকি সংলগ্ন কাঁটাতারের বেড়া পেরুতে গেলে, আটকে যায় সে। ভয়ে সে চিৎকার করে উঠলে বিএসএফ কিছু না বুঝে ফেলানীকে দেখতে পেয়ে অতর্কিত গুলি করে। বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে ফেলানীর দেহ ঝুলে থাকে ভারত বাংলাদেশের মাঝখানে। নো ম্যানস ল্যান্ডের কাঁটাতারের বেড়ায়। পা উপরে, মাথা নিচে, একটি মৃতদেহ ঝুলছে কাঁটাতারে এই ছবিটি বিশ্বমানবতাকে চমকে দেয়। ফেলানী হত্যার পর ঝড় ভয়ে যায় বাংলাদেশে এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার সংস্থাগুলোও প্রতিবাদ জানায়।
ফেলানী হত্যাকাণ্ডই যেন হয়ে উঠে সীমান্তের হত্যাকাণ্ডের এক ঝুলে থাকা অমীমাংসিত ইস্যুর প্রতীক। এই ঘটনার বিচারকার্য শুরু হয় ভারতে। চাপের মুখে পড়ে বিএসএফ স্বয়ং নিজেদের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করে। আসামী অমিয় ঘোষ। ২০১২ সালের আগস্টে শুরু হওয়া এই বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে সেখানে যান বিজিবির ৪৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক কর্নেল জিয়াউল হক খালেদ। সাক্ষ্য দেয়ার জন্য যান ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম ও মামা আব্দুল হানিফ। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপারটি হলো, এই ঘটনায় আসামী অমিয় ঘোষ বেকসুর খালাস পেয়ে যায় পরের বছরই। আদালত কারণ হিসেবে বলে, "Insufficient and Inconclusive Evidence." অপর্যাপ্ত প্রমাণ!
এই কারণটি মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। অনেকের কাছেই এই বিচারকার্যকে প্রহসন মনে হয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের চাপে বিএসএফের পরিচালক মামলার রায় আবারও মূল্যায়নের ঘোষণা দেন। আবার ফেলানীর বাবা যান, আদালতে স্বাক্ষ্য দিতে। কিন্তু, প্রথমবার যারা বিচারকার্যে ছিলেন, দ্বিতীয়বারও তারাই। ফলে, রায়ের পরিবর্তন হবে না এটা যেন অনুমিতই ছিল। এবং সেটাই হয়েছে। ফেলানী হত্যার বিচার হবে এই আশায় এখনো বুক বেঁধে আছেন তার বাবা। ফেলানীর অপরাধ কী, কোন কারণে তাকে মারা হলো এই উত্তর কেউ কি দিতে পারবে?
বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত কিছুটা জটিল। কিছু এমন বাড়িঘর আছে, যেখানে বাড়ির এক অংশ পড়েছে ভারতে, একাংশ বাংলাদেশে। সাময়িকভাবে সীমান্ত পার হয়ে নাগরিকরা এদেশ থেকে সেদেশে যায়, এমন ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। এটাকে বলা হয় "ইন-এডভার্টেন ক্রসিং"। এরা বেশিরভাগই সাধারণ মানুষ। বিএসএফ যখন সীমান্তে কাউকে গুলি করে তখন তারা আত্মরক্ষার্থে এই কাজ করেছে বলে মনগড়া অজুহাত দেয় বেশিরভাগ সময়। একজন নিরস্ত্র মানুষকে মারার পর এই ধরণের অজুহাত হাস্যকর। ভারতের সংবিধান, এবং আইন, বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত চুক্তি কোনোটাই এ ধরণের খুনকে সমর্থন করে না। ফলে, একজন নিরস্ত্র নিরপরাধ ফেলানীর হত্যার বিচারটা তাই আরো বেশি আকাঙখিত হয়ে উঠে আমাদের কাছে।
কিন্তু, এখনো এই বিচার ঝুলে আছে, যেমন ঝুলে ছিল ফেলানীর নিষ্প্রাণ দেহ, সীমান্তের কাঁটাতারে। আমাদের কি সেই ফেলানীকে মনে আছে? বাংলাদেশের সাথে ভারতের এখন অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে ভাল কূটনৈতিক সম্পর্ক। আমরা কি এই সম্পর্কের অধিকার নিয়ে হলেও একজন নিরপরাধ ফেলানীর বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত হোক এই আশা করতে পারি না? রাষ্ট্রীয়ভাবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যাপারটিকে কতটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, তা জানি না। তবে, আশা রাখি, নয় বছর ধরে বিচার পাওয়ার আশায় আকুল ফেলানীর পরিবারের পাশে থেকে রাষ্ট্রও তার হতভাগা নাগরিকটির অধিকার আদায়ে ভূমিকা রাখবে...