মহাখালী বা বনানীতে অফিস করা যে ভদ্রমহিলা উত্তরায় থাকেন, তার জন্যে বিকেলে অফিস ছুটির পরে বাস পাওয়াটা যে কি বিশাল একটা বিশ্বযুদ্ধ, সেটা কেবল তিনিই ভালো বলতে পারবেন। আধঘন্টা-চল্লিশ মিনিটের রাস্তা, কিন্ত বাস পাবার জন্যেই তাকে হয়তো দেড়ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা লাগে!

ঢাকা শহরে কর্মজীবী যে কোন নারীর কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের নাম ঢাকার গণপরিবহন। কোনমতে বাস ওঠার জন্যেই একটা মহাযুদ্ধে অবতীর্ন হতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুনতে হয়- ‘লেডিস সিট নাই!’ যুদ্ধে জয়ী হয়ে বাসে উঠলেও কি আর শান্তি আছে? কামুক পুরুষের অবাঞ্ছিত স্পর্শের আতঙ্কে থাকতে হয় সারাক্ষণই, এই শহরে তো মানুষের সংখ্যা আর পার্ভার্টের সংখ্যা প্রায় সমান। তার ওপরে বাসের ভেতরে হাঁসফাঁস টাইপের একটা অবস্থা, পা গলানোরও জায়গা নেই, কোনমতে বসতে বা দাঁড়াতে পারলেও গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে থেকে সবাই, কারণ ত্রিশজনের বাসে লোক উঠে গেছে আশিজন!

ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে, গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নারীদের যৌন হয়রানির মূল কারণ হচ্ছে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলোর অভাব। ভাবুন তো, শহরজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে নারীবান্ধব গণপরিবহন, সেগুলোতে চড়ার জন্যে যুদ্ধ করতে হচ্ছে না কাউকে, নারীর বসার জায়গা দখল করে রাখছে না পুরুষ, গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে না কেউ, অযাচিত হাত এসে স্পর্শ করছে না নারীকে- কেমন হতো সেটা?

স্বপ্নের মতো সেই বাসেরই ডিজাইন করেছেন কানিজ ফাতেমা, পেশায় তিনি স্থপতি। তার ডিজাইন করা বিশেষ এই বাসে নারী ও শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওঠা-নামার জন্য আলাদা দরজা আছে। সংরক্ষিত ১৫টি সিট ঠিক রেখে বাসের মোট আসনসংখ্যা ৫২ থেকে ৪৭টি করা হয়েছে। ফলে হুইলচেয়ার প্রবেশের জন্য র‍্যাম্প এবং প্রয়োজনে ভাঁজ করে রাখা যায়- দুই ধরনের সিটের ব্যবস্থাই করা হয়েছে।

নিজের ডিজাইন করা নারীবান্ধব বাসে স্থপতি কানিজ ফাতেমা

এর বাইরে অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্যে আরামদায়ক আসনের সঙ্গে সিট বেল্ট আছে, যাতে তারা নির্বিঘ্নে যাত্রা করতে পারে, ভাঙা বা এবড়ো-থেবড়ো রাস্তাতেও কোন অসুবিধায় পড়তে না হয়। নবজাতক শিশুকে মা যাতে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন, সেজন্যে পর্দাঘেরা সিটের ব্যবস্থা আছে। আছে রাতে পর্যাপ্ত আলোর জন্য স্ট্রিপ লাইট এবং যাত্রীদের নিরাপত্তায় মোবাইল ফোন চার্জিং পয়েন্টও। পুরো বাসেই নারী ও শিশুদের জন্য দেওয়া আছে নানান রকমের প্রয়োজনীয় তথ্য।

বিআরটিসির পুরনো একটি বাসকে এভাবেই বিশেষ ডিজাইন করে নারীবান্ধব বাস পরিণত করেছেন কানিজ ফাতেমা এবং তার স্বামী রুবাইয়াত উর রহমান, যিনি নিজেও একজন স্থপতি। আরেক স্থপতি অধরা প্রতীতিও সাহায্য করেছেন কানিজকে। খুব দ্রুতই ঢাকার রাস্তায় নামবে এই বাস, এটিকে নারী ও শিশুবান্ধব বাসে পরিণত করতে খুব বেশি টাকা খরচ হয়নি। এখানে বলে রাখা ভালো, নারীবান্ধব বাস মানে কিন্ত লেডিজ বাস নয়, এই বাসে নারী-পুরুষ সবাই চড়বেন।

এত কিছু থাকতে হঠাত নারীবান্ধব বাসের আইডিয়া কেন মাথায় এলো কানিজের? তিনি নিজে নারী, এজন্যেই কি? জবাবটা হ্যাঁ এবং না- এর মাঝামাঝি। ঢাকার বাসে নারী হয়রানি তো নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়, এমনই একটা ঘটনা কানে এসেছিল কানিজের। বাসে এক শিশুর হয়রানির পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে বেশ আলোচিত হচ্ছিল। শিশুটি মায়ের সঙ্গে বাসে ওঠে এবং সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এক লোক শিশুকে কোলে বসান। আর এই সুযোগেই শিশুটিকে তিনি যৌন হয়রানি করছিলেন। ঘটনাগুলো তো প্রতিনিয়তই ঘটছে। আর সেখান থেকেই কানিজের মাথায় আসে নারীবান্ধব বাসের আইডিয়াটা।

ঢাকার গণপরিবহনে চড়াটা নারীর জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের নাম

গল্পের শুরুটা ২০১৬ সালের শেষ দিকে, তখন ‘আরবান ৯৫ চ্যালেঞ্জ’ নামে একটা প্রতিযোগিতার কথা জানতে পারেন কানিজ। প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু ছিল—৯৫ সেন্টিমিটারে শিশুদের চোখের লেভেলে একটি শহর কেমন? কীভাবে শহরকে শিশুবান্ধব করা যায়? দৈনন্দিন যাতায়াতের সমস্যা, সেই সমস্যা শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, সেসব নিয়েই কাজ শুরু করেন কানিজ।

প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য অনেকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কানিজ জানলেন, বিরূপ অভিজ্ঞতার জন্য অনেকে বাসে চলাফেরাই বাদ দিয়েছেন। সিএনজি বা অন্য বাহন বেছে নিচ্ছেন অনেকে বা ঘরের বাইরে যাওয়ার পরিমাণই কমিয়ে দিচ্ছেন। কানিজের পরিকল্পনা শুনে রাজী হয়ে গেলেন সেই সময়ের বিআরটিসির চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া।

মহাখালী বা বনানীতে অফিস করা যে ভদ্রমহিলা উত্তরায় থাকেন, তার জন্যে বিকেলে অফিস ছুটির পরে বাস পাওয়াটা যে কি বিশাল একটা বিশ্বযুদ্ধ, সেটা কেবল তিনিই ভালো বলতে পারবেন। আধঘন্টা-চল্লিশ মিনিটের রাস্তা, কিন্ত বাস পাবার জন্যেই তাকে হয়তো দেড়ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা লাগে! কোন বাসই ফাঁকা আসে না, কেউ 'লেডিস' ওঠাতে চায় না! কাকুতি-মিনতি করেও লাভ হয় না অনেক সময়। বাসে উঠলেও যে কত বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়, সেটা ভুক্তভোগী নারী ছাড়া কেউই জানেন না।

ঢাকা শহরে বাসে ওঠার জন্যে নারীর এই সংগ্রাম বন্ধ করতেই প্রয়োজন নারীবান্ধব বাস

চলন্ত বাসে তরুণীর জামা কেটে ফালাফালা করে দেয়া হয়েছে, শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গে বাজেভাবে স্পর্শ করা হয়েছে, কিংবা কোন নারীকে দেখিয়ে দেখিয়ে চলন্ত বাসের ভেতরেই হস্তমৈথুনের চেষ্টা করেছে কোন এক জারজ শুওর- এসব ঘটনা অহরহ ঘটছে ঢাকায়। চলন্ত বাসে ধর্ষণ, কিংবা শ্লীতাহানীর নজিরও একটা-দুটো নয় কিন্ত। ঢাকার মতো বাজে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম দুনিয়ার আর কোন দেশের প্রধান শহরে আছে কীনা আমাদের জানা নেই। কানিজ ফাতেমার এই নারীবান্ধব বাসের আইডিয়াটা বদলে দিতে পারে জীবন আর জীবিকার তাগিদে ঢাকার রাজপথে বিচরণ করা নারীদের জীবনকেই। 

এমন উদ্যোগগুলোকে স্বাগত জানানোটা তাই খুব বেশি দরকার। কয়েক লক্ষ কোটি টাকা বাজেটের ক্ষুদ্র একটা অংশ এই নারীবান্ধব গণপরিবহনের পেছনে ব্যয় করে শহরের পরিবহন ব্যবস্থাটাকে একটু ঢেলে সাজানোটা এখন সময়ের দাবী। বাড়ি বা অফিসে যাওয়ার পথে নারীকে যাতে কোন বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে না হয়, ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়, কিংবা রাত বিরাতে বাসে চড়তে গিয়ে নারীকে যেন বিপদের মুখে পড়তে না হয়- সেটা নিশ্চিত করা তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব, আমাদের দায়িত্ব।

তথ্য ও ছবি কৃতজ্ঞতা- প্রথম আলো


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা