একটি দেশকে স্বাধীন করায় সর্বোচ্চ অবদানের পরও মাত্র চার বছরও সে দেশের বাতাসে শ্বাস নেয়ার সুযোগ পাননি বঙ্গবন্ধু। সেখানে ৪৯ বছরে ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা চালিয়েও মারা সম্ভব হয়নি ইতিহাসের আরেক মহানায়ক ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে!

আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বর্ণনা করতে গেলে প্রথমেই যে অমর উক্তিটি মনের কোণে উঁকি দিয়ে যায়, সেটি নিঃসৃত হয়েছিল কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মুখ থেকে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, তাঁর সিদ্ধান্ত, অবিচলতা নিয়ে বলতে গিয়ে ক্যাস্ট্রো বলেন,"আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।" ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) চতুর্থ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও কিউবা ছিল। সেই সময়েই বঙ্গবন্ধুর সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয় ক্যাস্ট্রোর, এবং তখন তিনি এই অমর বাণীটি করেছিলেন।

ক্যাস্ট্রোর সাথে বঙ্গবন্ধুর বহু মিল। ক্যাস্ট্রো যেখানে কিউবার অবিসংবাদিত নেতা, ঠিক তেমনই আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। ক্যাস্ট্রো না থাকলে পৃথিবীর বুকে সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো না কিউবা, আর একজন শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রটির হয়ত জন্মই হতো না। তবু কোথাও একটা গিয়ে যেন, ক্যাস্ট্রোর সাথে বঙ্গবন্ধুর বড্ড অমিল।

বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মাত্র চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। আর সেই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিল বঙ্গবন্ধুর নিজের দেশেরই একদল চরম বিশ্বাসঘাতক। অথচ ক্যাস্ট্রো পেয়েছিলেন এক সুদীর্ঘ জীবন। ৯০ বছর পৃথিবীর আলো বাতাস উপভোগ করে ২০১৬ সালে স্বাভাবিক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেন তিনি।

তবে তাই বলে কেউ যেন ভাববেন না ক্যাস্ট্রোর জীবন ছিল একদমই কন্টকমুক্ত। বরং পৃথিবীর ইতিহাসে ক্যাস্ট্রোই বোধহয় সেই ব্যক্তি, যাকে সর্বোচ্চ সংখ্যকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। অনেকেরই হয়ত এ কথা শুনে পিলে চমকে যাবে যে, জীবদ্দশায় ক্যাস্ট্রোকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল ৬৩৮ বার!

এক ফ্রেমে দুই মহান নেতা

প্রায় এক যুগ আগে, কিউবান ইনটেলিজেন্সের সাবেক প্রধান ফ্যাবিয়ান এসক্যালেন্তে একটি ব্রিটিশ ডকুমেন্টারি দলের কাছে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ)-র চরেরা নাকি ৪০ বছরের মধ্যে ৬০০ বারেরও বেশি চেষ্টা করেছে ক্যাস্ট্রোকে হত্যা করার। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে তাদের সকল প্রচেষ্টা। চলুন এক নজরে দেখে নিই যুক্তরাষ্ট্রের কোন রাষ্ট্রপ্রধান কয়বার হত্যার চেষ্টা করেছিলেন ক্যাস্ট্রোকে-

আইসেনহাওয়ার- ৩৮
কেনেডি- ৪২
জনসন- ৭২ 
নিক্সন- ১৮৪
কার্টার- ৬৪
রিগ্যান- ১৯৭
বুশ সিনিয়র- ১৬
ক্লিনটন- ২১

এসক্যালেন্তের ভাষ্যমতে ক্যাস্ট্রোকে ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, এ তথ্য আসলেই অবিশ্বাস্য। তবে বিভিন্ন সময় সিআইএ-র ফাঁসকৃত গোপন নথি এবং গুপ্তচর ও গুপ্তঘাতকদের দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মাধ্যমে এটি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে আসলেই যুক্তরাষ্ট্র সিআইএ-র মাধ্যমে অসংখ্যবার হত্যা করতে চেয়েছে ক্যাস্ট্রোকে। তাছাড়া এসক্যালেন্তের কথাকেও উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। তিনি যে ক্যাস্ট্রোর নিরাপত্তারক্ষীও ছিলেন। ৪৯ বছরের শাসনামলে পুরো সময় তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

ক্যাস্ট্রোকে হত্যার ষড়যন্ত্র বেশির ভাগই করা হয় তাঁর শাসনামলের শুরুতে, ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে। বহু বিদ্রোহের পর কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৫৯ সালে দায়িত্ব নেন ক্যাস্ট্রো। কিন্তু তাকে কিউবার প্রধান নেতা হিসেবে কখনোই মেনে নিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। সেজন্য পাঁচটি ভাগে সিআইএ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র বিভাগ তাঁকে হত্যার বিভিন্ন চেষ্টা চালায়। তাঁকে কিউবার সিংহাসন থেকে নামাতে নেওয়া হয় 'অপারেশন মঙ্গুজ' পরিকল্পনা। ক্যাস্ট্রোকে হত্যাচেষ্টার প্রতিটিই ছিল অভিনব ও আগেরগুলোর চেয়ে ব্যতিক্রম।

চলুন জেনে আসি সবচেয়ে অভিনব ও চমকপ্রদ হত্যাচেষ্টাগুলোর ব্যাপারে:

ক্যাস্ট্রোকে হত্যাচেষ্টার মধ্যে সবচেয়ে জটিল ও বহুল আলোচিত হলো তাঁর চুরুটের মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্য রাখা। নিউইয়র্কের এক পুলিশ কর্মকর্তা কাছ থেকে এই ফন্দি নেয় সিআইএ। ওই চুরুটের মধ্যে যে পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য রাখা হয়, তা তাঁর মাথা উড়িয়ে দেওয়ার মতো। এ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। এছাড়াও তাঁকে দুর্বল করতে একবার তাঁর জুতো ও চুরুটের মধ্যে রাসায়নিক দ্রব্য রাখা হয়। এর প্রভাবে তাঁর শরীরের সব চুল পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। বিভিন্ন সময়ে তাঁর খাবারে বিষ রেখে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তাঁর ব্যবহৃত কলমে বিষযুক্ত সূচ রেখে ও পোশাকে জীবাণু ছড়িয়েও তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালায় সিআইএ।

সিআইএর আরেকটি ষড়যন্ত্র ছিল সাবেক স্ত্রী মিরতাকে হাত করে ক্যাস্ট্রোকে হত্যার চেষ্টা। বিষযুক্ত ক্যাপসুল দিয়ে তাঁকে হত্যা করার ফন্দি আঁটা হয়। কোল্ডক্রিমের কৌটায় রাখা হয় এই ক্যাপসুল। কিন্তু এ ষড়যন্ত্রের কথা জেনে ফেলেন ক্যাস্ট্রো। এরপর ক্যাস্ট্রো যা করেন, তা এর আগে আপনারা হয়ত কেবল সিনেমাতেই ঘটতে দেখেছেন। তিনি মিরতার হাতে পিস্তল তুলে দিয়ে তাঁকে বিষ দিয়ে নয়, সরাসরি গুলি করে হত্যা করতে বলেন। কিন্তু মিরতা তা পারেননি।

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: কিউবার লৌহমানব

আরেকবার ক্যাস্ট্রোকে কোথায় হত্যা করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল, জানেন? একেবারে সমুদ্রের তলদেশে! ক্যাস্ট্রো বরাবরই স্কুবা ডাইভিং করতে ভালোবাসতেন। সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগাতে চেয়েছিল সিআইএ। ক্যাস্ট্রো স্কুবা ডাইভিংয়ে যাবেন শুনে আগে থেকে সমুদ্রের তলদেশে বড় একটি ঝিনুকের ভিতর বিস্ফোরক লুকিয়ে রেখেছিল তারা। পরে সেটির গায়ে খুব সুন্দর করে রং করে দিয়েছিল যাতে ক্যাস্ট্রো দেখামাত্র আকৃষ্ট হন এবং সেটির কাছে যেতে আগ্রহী হন। কিন্তু সে যাত্রায়ও সিআইএ-র ফাঁদে পা দেননি তিনি। 

প্রেসিডেন্ট হিসেবে শাসনামলের শেষের দিকে ২০০০ সালে পানামা সফরে যান ক্যাস্ট্রো। সেখানেও তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। একটি মঞ্চে বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। সেই মঞ্চে ভাষণ ডেস্কে ৯০ কেজি বিস্ফোরকদ্রব্য রাখা হয়। ক্যাস্ট্রোর নিরাপত্তাকর্মীরা এই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। শুধু হত্যার চেষ্টাই নয়, ক্যাস্ট্রোর ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টাও কম করেনি সিআইএ। একবার এক বেতারকেন্দ্রে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন তিনি। এ সময় স্টুডিওতে নেশাজাতীয় দ্রব্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর প্রভাবে অদ্ভুত আচরণ করেন তিনি। বিচলিত হয়ে পড়ে পুরো কিউবা। তবে এবারও ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হয় সিআইএর।

এভাবে ৪৯ বছর প্রথমে প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৯-১৯৭৬) ও পরে রাষ্ট্রপতি (১৯৭৬-২০০৮) থাকাকালীন প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। শেষমেষ ২০০৮ সালে তাঁর ভাই রাউল ক্যাস্ট্রোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেন তিনি। তবে তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীনই, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চ্যানেল ফোর। '৬৩৮ ওয়েজ টু কিল ক্যাস্ট্রো' নামের ওই প্রামাণ্যচিত্রে দেখানো হয়— কত কৌশলে তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যে সম্প্রচার করা হয় প্রামান্যচিত্রটি।

শুরু করেছিলাম বঙ্গবন্ধু ও ক্যাস্ট্রোর মধ্যকার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের কথা দিয়ে। বঙ্গবন্ধু যেখানে চার বছরও স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকার সুযোগ পেলেন না, সেখানে ক্যাস্ট্রো কীভাবে এত দীর্ঘ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অক্ষত অবস্থায় পাড়ি দিলেন? এর প্রধান কারণ হলো, ক্যাস্ট্রোর শত্রুরা ছিল সকলে ভিনদেশী। নিজের দেশের মানুষের কাছ থেকে তিনি সবসময়ই অকুন্ঠ সমর্থন পেয়ে এসেছেন। তাঁর আশেপাশে কোনো বিশ্বাসঘাতক ছিল না। সেই সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধুর হয়নি। তিনি ছিলেন শত্রুবেষ্টিত অবস্থায়, আর সেই শত্রুরা অধিকাংশই ছিল এমন সব মানুষজন, যারা ছিল তাঁর কাছের মানুষ, যাদেরকে তিনি বিশ্বাস করতেন অন্ধের মত।

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা