এই দেশে কত রকমের অব্যবস্থাপনা, তাই দূর্ঘটনার কোনো মা বাপ নেই৷ কখন কী হয়ে যায়, কে বলতে পারে। দিন বারোটা হোক কিংবা রাত বারোটা, একটা ইমার্জেন্সি কলেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হাজির হয়ে যান ঘটনাস্থলে। তাদের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকে না তখন।

নিমতলী থেকে চকবাজার, তাজরীন গার্মেন্টস থেকে রানা প্লাজা, কিংবা বনানী অগ্নিকাণ্ড; যেখানেই বিপর্যয় কিংবা দূর্ঘটনাজনিত ক্রান্তিলগ্ন, সেখানেই ক্রাইসিস মোমেন্টগুলোতে অক্লান্ত সেবা দিয়ে যে বাহিনী বিপর্যয়কে মোকাবেলা করেন সবার আগে, সেই বাহিনীটির নাম ফায়ার সার্ভিস। 

একেকটি দূর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে দূর্ঘটনা ঘটার পেছনে কার অবহেলা, কেন বার বার একই সংকট, কার কী দায়িত্ব, ক্ষয়ক্ষতি, অব্যবস্থাপনা - সব কিছু নিয়েই আলোচনা হয়। এইসব আলোচনার মধ্যে যদি কোনো সুফল, কোনো আইডিয়া বের হয়ে আসে, কেউ যদি দৃষ্টান্তমূলক এমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে যেন আগামীতে এমন করুণ প্রাণহানির ঘটনা না ঘটে, তবে আলোচনা চলুক। কথা হোক, প্রথা ভেঙ্গে কাজের কাজ কিছু হোক। যদিও, বেশি আশাবাদী হতে পারি না আজকাল। থাকুক হতাশার কথা। এই কষ্টের মধ্যে একটু ধন্যবাদ দেয়ার জন্যে এই লেখা।

ধন্যবাদ দিতে চাই, এই শহরের আনসাং হিরোদের, যারা যেকোনো জাতীয় বিপর্যয়ে ঝাপিয়ে পড়েন, যাদের আগাগোড়া পুরোটাই বোধহয় কলিজা, যাদের মধ্যে দেখা পাই অসামান্য মানবতা, সেই আনসাং হিরো আমাদের ফায়ার সার্ভিস বিভাগ৷ অনেকে বলবেন, তাদের দায়িত্বই তো এটা। কোথাও আগুন লাগবে, তারা এসে পানি ছিটিয়ে নিভানোর কাজ করবেন। এখানে আবার ধন্যবাদ দেয়ার কী আছে? 

চকবাজার অগ্নিকান্ডের পর...

আছে, ধন্যবাদ দেয়ার অনেক কিছু আছে। আমাদের মধ্যে মানবিকবোধের জায়গাগুলো সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে বলে, আমরা সব কিছু 'টেকেন ফর গ্রান্টেড' বলে ধরে নিই৷ কিন্তু, একটু বড় পরিসরে ভাবতে গেলে খেয়াল করব, এই মানুষগুলো শুধু আসলে বিপর্যয় মোকাবেলা করছে না, তারা নিজেদের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলছে। মানুষকে জীবিত উদ্ধারের জন্য তাদের চেষ্টা, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যেন একটু কমানো যায় তার জন্যে সে চেষ্টা, বড় দূর্ঘটনায় যেন নিহতদের সংখ্যা না বাড়ে, যেন বেশি মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হয় তার জন্য কী না করেন এই মানুষগুলো! 

দিন বারোটা হোক কিংবা রাত বারোটা, একটা ইমার্জেন্সি কলেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হাজির হয়ে যান ঘটনাস্থলে। তখন তাদের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকে না। তারা সেইসময় দূর্ঘটনায় পতিত মানুষদেরই নিজের পরিবার বলে মনে করেন হয়ত, তা না হলে কীভাবে এত শক্তি পান, এত ধৈর্য পান এসব দূর্যোগ মোকাবেলার! যখন তারা ভয়াবহ কোনো অগ্নিকাণ্ডকে বশ করতে যান, তখন তাদের পরিবারের মানুষরাও যেন একইরকম উৎকন্ঠা নিয়ে চিন্তা করেন৷

এই দেশে কত রকমের অব্যবস্থাপনা, তাই দূর্ঘটনার কোনো মা বাপ নেই৷ কখন কী হয়ে যায়, কে বলতে পারে। ফলে, এই অনিশ্চয়তাময় দেশটিতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে দিন কাটান, সবসময় তাদের একটা প্রস্তুতির মধ্যে থাকতে হয়, কারণ, ক্রান্তিলগ্নে একটা মিনিট বাঁচিয়ে আগে কাজ শুরু করতে পারলে হয়ত একটু ক্ষয়ক্ষতি কমানো যাবে এই চিন্তা তাদের মাথায় ঘুরে৷ 

ক্লান্তিতে শরীর অবসন্ন হয়ে আসলেও উদ্ধার কাজ থেমে নেই

চকবাজারে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট একযোগে কাজ করেছেন। বনানীর আগুন নেভাতে কাজ করেছে বিশটা ইউনিট। সারাদিন, সারারাত আগুনের সাথে যুদ্ধ করে তারা কতটা সুস্থ ছিলেন সেই খবর জানার ইচ্ছে জেগেছে কারো? চকবাজারে একটা গোটা রাত, তারপর আরো একটা বেলা- কী খেয়েছেন, কীভাবে তারা সামলেছেন সব! এই যে এতবড় অগ্নিকাণ্ড চোখের সামনে দেখেছেন, লাশ দেখেছেন, আর্তনাদ দেখেছেন তারা তাদের মনোজগৎ কেমন ছিল, এটা ভাবনায় এসেছে কারো? কতটা শক্ত থাকতে হয়, এমন একেকটা ঘটনা মোকাবেলা করার জন্য! তারাও মানুষ, তাদেরও ইমোশন কাজ করে। এগুলো সামলে নন শক্ত রেখে কাজ করা বিশাল ব্যাপার।

এই অসাধ্য দিনের পর দিন ঘটিয়ে যাচ্ছেন আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ফায়ার সার্ভিস শুধু অগ্নিকাণ্ড ঘটলে সেটা নেভানোর কাজ করে বলে ধারণা অনেকের৷ বস্তুত, ফায়ার সার্ভিসের কাজের পরিধি আরো ব্যাপক৷ রানা প্লাজা ধ্বসে আমরা দেখেছি তাদের, শিশু জিহাদকে উদ্ধারের ঘটনায় দেখেছি তাদের নির্ঘুম রাতের প্রচেষ্টা। তাদের মানবিক জায়গা কতটুকু বিস্তৃত তা প্রমাণিত হয় যখন শুনি ৯৯৯ নাম্বারে ফোন পেয়ে তারা ছুটে যান ঘুড়ির সুতায় আটকে পড়া চড়ুই পাখিকে মুক্ত করতে। কখনো তাদেরকে দেখা যায়, আটকে পড়া বিড়ালকে পর্যন্ত উদ্ধার করবার কাজে। ফলে, যেখানে মানবিকতার ডাক, সেখানেই ত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভূত হয় ফায়ার সার্ভিস। 

যদিও, এই মানুষগুলোর কাজ একদমই থ্যাংকলেস। কেউ আলাদা করে মনে রাখে না এদের। বরং, পারলে ত্রুটি খুঁজে বের করতে পারলে একটু সমালোচনা করতে পারলে অনেকের আনন্দ। তবুও, ফায়ার সার্ভিস ঠিকই সাইরেন বাজিয়ে হাজির হবে, নির্ঘুম রাত কাটাবে, আগুনে ঝাপাবে, ময়লা পানিতে নামবে। ফায়ার সার্ভিস তবুও আনসাং হিরো হয়ে থাকবে।

একটা ভয়াল রাত কাটাবার পর সব শান্ত হয়। আতংক কমে, তেমনি আবার কমে যায় কৃতজ্ঞতাবোধ। দূর্যোগ কেটে গেলে মানুষ তো সৃষ্টিকর্তাকেও ডাকতে ভুলে যায় আবার, ফায়ার সার্ভিসকে সেখানে কেউ আলাদা করে ধন্যবাদ জানাবে এটা একটু বেশিই আশা করে হয়ে যায়, তবুও ধন্যবাদ জানাই আমাদের পক্ষ থেকে। যা কিছু আপনারা করেছেন, আপনাদের প্রত্যেকটা ত্যাগ, প্রত্যেকটা ঝুঁকি, প্রতিটি নির্ঘুম রাতের প্রতি সম্মান জানাই। এগিয়ে চলুন ফায়ার সার্ভিস, আমাদের এই শহরে আপনারাই আসল হিরো!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা