কেউ এই প্রেমের কথা জানলে আমাকে পাগলা গারদে দেবে। ভাইয়া বলবে ‘সিনেমা করস? শাবনূর তুই? বালিশ চাইপ্পা কান্দোস?’

আমার বয়স তখন ১৬, মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। বয়সটা এমনিতেই ভয়াবহ, তার উপর আমি সারাজীবন ছিলাম হোস্টেলে। হোস্টেল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর ছাড়া পেয়ে যখন বাসায় আসলাম, তখন আমার জীবনের একটাই উদ্দেশ্য, তা হলো- যেভাবেই হোক একটা প্রেম করতে হবে। কারণ ম্যাট্রিক পাশ করলে কলেজে আবার হোস্টেলে চলে যাব, তাই সময় আছে হাতে মাত্র ৩-৪ মাস। এর মধ্যেই কিছু একটা করতে হবে!

সেসময় মোবাইল ফোন ছিল না, আর চাইলেই ধুমধাম করে প্রেম-ভালোবাসা হতো না। তখন প্রেম করার জন্য বাসার বারান্দা অথবা  ছাদে দাঁড়িয়ে টাংকি মারাই ছিল আমার জেনারেশনের একমাত্র ভরসা।

আমার বাসায় হাঁটাহাঁটি করা টাইপ কোনো ছাদ ছিল না, ছিল টিনের চাল। সেই বাসায় বৃষ্টির দিনে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে আমার কিশোরী মনে ব্যাপক প্রেম উঁকি মারলেও সেটা বাস্তবায়িত করার ‘নো ওয়ে'।

যদিও আমাদের একতলা বাসার একটা বারান্দা ছিল, কিন্তু বারান্দার চারপাশে ছিলো শুধু গাছ আর গাছ, আর আমাদের বাসার চারপাশটায় ছিল অনেক উঁচু প্রাচীল। তাই আশেপাশে অন্য কোনো বারান্দার, অচেনা-অজানা ছেলের প্রেমে পড়ে মন আঁকুপাঁকু করার কোনো উপায় নেই। তবুও মাঝে মাঝে বারান্দায় আমি বই আর চায়ের কাপ নিয়ে বসতাম।

শাহিদা আরবী ছুটি- লেখিকা

তখন আমার ভাইয়া মুখ গম্ভীর করে বারান্দায় এসে বলতো, ‘বারান্দায় বইসা বইসা চায়ের কাপ আর বই নিয়ে সিনেমা করস? যা ভিত্রে যা'। আমাকে তখন সিনেমার সেট ফেলে ঘরের ভেতর চলে যেতে হতো। আমি এবং আমার বোন বারান্দায় যেতে পারতাম শুধুমাত্র রাতের বেলা, কারেন্ট চলে গেলে ,কারণ তখন অন্ধকারে বসে থাকা দুইটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে কেউ টাংকি মারতে পারবে না।

এত রেস্ট্রিকশন, এত বন্দি জীবনে থাকার পরও, আমি শেষমেষ প্রেমে পড়লাম। আমার প্রথম প্রেম! মানুষের প্রথম প্রেম হয় 'লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট টাইপ’, আমার হলো 'স্টোরি অ্যাট ফার্স্ট রিড'।

আমি ওর মায়ের মুখে প্রথম ওর গল্প শুনে ওর প্রেমে পড়ে যাই। তারপর আমি বারবার ওর মায়ের মুখে ওর গল্প শুনি। ওর মায়ের অন্য সব গল্প বলার সময় আমি উদাসীন থাকি, অনেক ডিটেইল মিস করি। শুধু মা যখনই ওর নাম নেন, আমি আমার বড় বড় চোখ আরো বড় করে ওর গল্প শুনি।

প্রথম যেদিন আমি ওর গল্প শুনি, ওকে অল্প একটু জানি, সেদিন সারারাত আমি ওর জন্য কান্না করি। এরপর প্রতিদিন ওর একই গল্প শুনে আমি কান্না করি, রাতের বেলা, কেউ যেন না দেখে। কেউ এই প্রেমের কথা জানলে আমাকে পাগলা গারদে দেবে। ভাইয়া বলবে ‘সিনেমা করস? শাবনূর তুই? বালিশ চাইপ্পা কান্দোস?’

সেই সিনেমা টাইপ প্রেম মনে নিয়ে, ম্যাট্রিক পাশ করে আমি কলেজে চলে যাই। কলেজে থাকতে আমি ওর সব তথ্য, ওর বন্ধুদের তথ্য জোগাড় করে ফেলি। ওর বাসার ঠিকানা, ছবি, প্রিয় গানের শিল্পী, প্রিয় পোশাক, প্রিয় খাবার– স-ও-ব– সব কিছু। তারপর একসময় কলেজ শেষ করে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। ভাইয়াও আর দেশে নেই, বিদেশ থাকে। সব মিলিয়ে আমি স্বাধীন।

শুরু হয় আমার প্রেম। প্রথমেই আমি ওর বাসায় যাই। এলিফ্যান্ট রোডে ওর বাসার আশেপাশে, পাড়ার বখাটে ছেলেদের মতন ঘুরাফেরা করি। ওর বাসা দেখি, দেখতেই ভাল্লাগে।

তখন আমার ইউনিভার্সিটির এক ছোট ভাই বললো, 'ছুটি আপু, এম্নে আশেপাশে ঘুরেন কেন, চলেন বাসায় নিয়া যাই। উনার বাসা সাধারণ মানুষের জন্য খোলা থাকে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে, সেই সময়ে যাব।'

শহীদ শাফী ইমাম রুমী

অবশেষে একদিন আমরা গেলাম ওর বাসায়। বাসার চৌকাঠে পা দেয়া মাত্রই আমার কান্নার শুরু, আশেপাশে দুনিয়ার মানুষ তাকিয়ে ছিল। আমার ফুঁপানো কান্না একসময় হিচকি দেয়া টাইপ কান্নায় পরিণত হলো। আমি গেলাম না। সেই সময় আমার সেই ভার্সিটির ছোট ভাই বলছিলো, 'শুধুমাত্র বই পড়ে, কেউ কারো এতটা প্রেমে পড়তে পারে? যুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধা এগুলোর প্রতি আমাদেরতো ভালোবাসা থাকেই, তাই বলে শহীদ রুমির নাম এভাবে বুকে ধারণ করেন আপনি!’

প্রথম প্রেম প্রথম প্রেমই। বারান্দার রেস্ট্রিকশন না থাকলে হয়তো অন্য ঘটনা হতো। ম্যাট্রিকের পর তিনমাস হাজারো বই না পড়ে একটা দুইটা রক্ত মাংসের মানুষের সঙ্গে প্রেম হয়ে যেত।  কিন্তু আমার প্রথম প্রেম হলো শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এর বড় সন্তান শহীদ শাফি রুমী ইমামের সঙ্গে।

আমাকে যারা ব্যক্তিগতভাবে চিনেন, স্পেশালি আমাকে কিশোরী বয়স থেকে যারা চিনতো, জানতো, তারা জানে– রুমীর সঙ্গেই আমার প্রথম প্রেম। যদিও ওয়ান সাইডেড, তবুও সে প্রেম ছিল মাথা আউলা করা প্রেম।

সেই প্রেম ‘হাগ-কিসি’ টাইপ এইযুগের প্রেম না। সেই প্রেম ছিল ওর অনুপস্থিতে ওর ঘরে যেয়ে, ওর নতুন এলভিস প্রিসলির কলেকশনের রেকর্ডটায় আলতো করে ছুঁয়ে দেয়া। সেই প্রেম ছিল ওর জন্মদিনে ওর মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে বার্গার বানাতে বানাতে ওর গল্প করা। জন্মদিনে ওর মায়ের মুখে ওর গল্প শুনতে শুনতেই ওর প্রিয় ভ্যানিলা ফ্লেভারের কেক বানানোর প্রিপারেশন নেয়া। 

শুভ জন্মদিন রুমী। আপনি বলেছিলেন ”যদি চলেও যাই, কোনো আক্ষেপ নিয়ে যাব না”৷ আমার আজও আপনার মতন এতখানি সাহসী আর কোনো পুরুষের কথা জানা হয়নি।

ফিচার্ডের ছবি: ১৬ বছরের লেখিকা আর সেই সময়কার দুর্দান্ত রুমী।


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা