
'ফরিদপুর মুসলিম হোটেল'-ই এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা হোটেল। এটি মূলত একটি ভাসমান হোটেল, যেটি বুড়িগঙ্গার উপর পাঁচটি পৃথক নৌকার উপর গড়ে তোলা হয়েছে।
যেকোন জায়গায় বেড়াতে গেলে প্রথমেই যে প্রশ্নটি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় তা হলো, সেখানে থাকার মত হোটেল আছে তো? সে হোটেলের খরচ বাজেটে কুলোবে তো? স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ মানুষই থাকার জন্য সবচেয়ে সস্তা হোটেলেরই খোঁজ করে। তাই মনে হতেই পারে, বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা হোটেল কোনটি?
এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য খুব দূরে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। কারণ পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে সস্তা আবাসিক হোটেল বলে ধারণা করা হয় যেটিকে, সেটির অবস্থান বাংলাদেশেই। এবং তাও আবার এই ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলে বুড়িগঙ্গা নদীর বুকে। হোটেলটির নাম 'ফরিদপুর মুসলিম হোটেল', যেখানে মাত্র ৩০ টাকা দিয়েই রাত্রিযাপন করা যায়।
২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে কয়েকটি বৈশ্বিক গণমাধ্যমে এই হোটেলের সংবাদ প্রকাশিত হয়, এবং তারপর থেকেই এটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। অনেক খোঁজাখুঁজি শুরু হয় যে বিশ্বের আর কোথাও এর চাইতে সস্তায় রাত কাটানোর মত হোটেল আছে কিনা। তবে এখন পর্যন্ত সেরকম কোন হোটেলের হদিস যেহেতু মেলেনি, তাই আমরা ধরে নিতেই পারি যে 'ফরিদপুর মুসলিম হোটেল'-ই এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা হোটেল। এটি মূলত একটি ভাসমান হোটেল, যেটি বুড়িগঙ্গার উপর পাঁচটি পৃথক নৌকার উপর গড়ে তোলা হয়েছে।
মাত্র ৩০ টাকা ভাড়া হলেও, তার বিনিময়ে এ হোটেলে যেসব সুবিধা মেলে, তাকে আশাতীতই বলা চলে। ঘরগুলো খুব ছোট হতে পারে, একটি কম্যুনাল ব্যাংকের চেয়ে আকারে খুব বেশি বড় হবে না; তবে সার্বক্ষণিক পানি এবং টয়লেটের ব্যবস্থা ঠিকই আছে। তবে খাবার আলাদা করে কিনে খেতে হয়। এই হোটেলটি পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তবে শুধু পর্যটকরাই যে এ হোটেলে রাত কাটায় তা নয়। স্থানীয় অনেক মানুষ যাদের স্থায়ী আবাসন ব্যবস্থা নেই কিংবা দিন মজুর- তারাও মাঝেসাঝেই এই হোটেলে চলে আসে কয়েকটা রাত খুব কম খরচে কাটিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

প্রতিটি অতিথিকে একটি করে লকারের মত দেয়া হয় যাতে তারা তাদের জিনিসপত্র সেখানে নিরাপদে গচ্ছিত রাখতে পারে। একসাথে প্রায় চল্লিশ জনের মত অতিথি প্রতি রাতে ৩০ টাকার বিনিময়ে থাকতে পারে এই হোটেলে, এবং এমন অনেকেও আছে যারা একটানা তিন মাসের বেশিও এই হোটেলে থেকে যায়।
কম্যুনাল বাংকগুলো ছাড়াও এই হোটেলে আরও ৪৮টি রুম রয়েছে, যেখানে আরেকটু বেশি 'প্রাইভেসি' পাওয়া যায়। সেই রুমগুলোকে ডাকা হয় 'কেবিন' নামে, আর সেখানে রাত কাটানোর জন্য গুনতে হয় ১২০ টাকা করে। গোলাম মোস্তফা মিয়া নামের এক ব্যক্তি বর্তমানে ভাসমান হোটেলটি চালাচ্ছেন। তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে এটা করছেন। তবে 'ফরিদপুর মুসলিম হোটেল'-ই অবশ্য এ অঞ্চলের একমাত্র ভাসমান হোটেল নয়।
আশেপাশে আরও অনেকগুলো ভাসমান হোটেলই রয়েছে, এবং এ ধরণের ভাসমান হোটেলের ঐতিহ্য এ অঞ্চলে চলে আসছে বহু বছর ধরে। অনুসন্ধানে জানা যায়, হাউস বোট থেকেই নৌকায় ভাসমান হোটেলের চিন্তা-ভাবনা আসে। অতীতে ভাগ্যকুলের কুণ্ডু জমিদার ও ঢাকার নবাবদের একাধিক রাজকীয় প্রমোদতরি বুড়িগঙ্গায় ভাসমান অবস্থায় থাকত। এসব প্রমোদতরি বিভিন্ন রাজকীয় অতিথি কিংবা রাষ্ট্রীয় সফরে ব্যবহৃত হতো। এর মধ্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৮ সালে ঢাকায় এসে কুণ্ডুদের প্রমোদতরি এবং ১৯২৬ সালে নবাবদের হাউস বোট ব্যবহার করেছিলেন। তা ছাড়া ব্রিটিশদের প্রমোদতরি মেরি এন্ডারসন পরে পাগলা ঘাটে ভাসমান রেস্তোরাঁ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
কয়েক বছর আগে আগুনে ওই ঐতিহাসিক প্রমোদতরিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। উল্লেখ্য, ১৬০৮ সালে (মতান্তরে ১৬১০) সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করে তাঁর সুবেদার ইসলাম খাঁ চিশতীকে সেখানে পাঠান। চাঁদনী নামের একটি প্রমোদতরিতে করে তিনি দলবলসহ বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে নামেন। সেই স্থানটি পরে ইসলামপুর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আর যেখানে চাঁদনী প্রমোদতরি রাখা হতো সেটার নামকরণ হয় চাঁদনীঘাট। এখনো চাঁদনীঘাট রয়ে গেছে, কিন্তু সেখানে কোনো প্রমোদতরি নোঙর করে না। সিম্পসন রোডের প্রবীণ ব্যবসায়ী ইন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেন,
‘আমি ৫০ বছর ধরে বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী সদরঘাটে ব্যবসা করছি। আমার বাড়ি গৌরনদীর বাটাজোর গ্রামে। ব্যবসায়িক কাজে প্রায়ই ঢাকায় আসতে হতো। নৌকায় মালামাল নিয়ে সদরঘাট আসতাম। গয়নার নৌকা থেকে মাল খালাস হতে ১০ থেকে ১২ দিন সময় লেগে যেত। এ সময়টা আমি বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর ভাসমান হোটেলে থাকতাম। সেসব হোটেল হিন্দুরা চালাত বলে তার নাম ছিল হিন্দু। যেমন—আদর্শ হিন্দু হোটেল, লক্ষ্মী পাইস হিন্দু হোটেল, শরীয়তপুর হিন্দু হোটেল, নারায়ণগঞ্জ হিন্দু কেবিন প্রভৃতি। বুড়িগঙ্গা নদীর বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ১১০টি ভাসমান হোটেল ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেসব হোটেল হারিয়ে গেছে। টিকে আছে মাত্র ফরিদপুর মুসলিম হোটেলটি।’
তথ্যসূত্র- telegraph, kalerkantho