বন্যার পানিতে ভেসে যাচ্ছে জনপদ, ডুবে যাচ্ছে বাড়িঘর। তবু এর মাঝে এক টুকরো আশার প্রদীপ জ্বেলে টিকে রয়েছে একটি স্কুল, যেটি কখনো পানিতে ভেসে যায় না!

চলনবিল-নাটোর, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ জেলাজুড়ে বিস্তৃত একটি বিলের নাম। চলনবিল সংলগ্ন অঞ্চলগুলো বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় জুড়ে জলের তলে ডুবে থাকে। ভৌগলিকভাবে এমনিতেই বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ এলাকা বর্ষায় বন্যাকবলিত হয়। আর এই বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকেন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। প্রতি বছর বন্যার কবলে পড়ে হাজারের বেশি স্কুল বন্ধ রাখা হয়। 

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চলনবিল এলাকার সিধুলাই গ্রামটি সে রকমই একটি বন্যাকবলিত গ্রাম। চলনবিলে বছরের সাত মাস পানি থাকায়, এই এলাকার শত শত স্কুল বন্যার কারণে বন্ধ হয়ে যায়। সিধুলাই গ্রামের সন্তান স্থপতি মোহাম্মদ রেজওয়ানের মনে দাগ কেটে যায় বিষয়টি। বাংলাদেশ নদীর দেশ, জলের দেশ। এখানে পানি থাকবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু পানির কারণে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না এই বিষয়টি রেজওয়ানকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি তার সৃজনশীলতা দিয়ে এই সমস্যার একটি যুগান্তকারী সমাধান খুঁজে বের করেন। 

জলই যেহেতু সমস্যা, জলই হবে সমাধান। নৌকার মধ্যেই স্কুল করার চিন্তা করলেন, নকশাও করে ফেললেন স্কুলের। প্রথমবারের মতো তিনি শুরু করলেন একটি ভাসমান স্কুল! অভিনব এই স্কুল গড়ার পেছনে আইডিয়ার কথা বলেছিলেন রেজওয়ান-

বন্যাকবলিত অঞ্চলে বেড়ে ওঠার ফলে আমি খুব কাছ থেকেই এখানকার মানুষের কষ্ট দেখেছি। এখানকার মানুষের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে দেখতে দেখেছি। বর্ষার সময়টায় ছাত্রছাত্রীরা একদমই স্কুলে যেতে পারে না, কারণ রাস্তা তখন ডুবে থাকে পানির তলায়। এর ফলে স্কুল থেকে প্রতিবছর অনেক ড্রপআউট হয়।

যদিও আমার পরিবারের একটি নিজস্ব নৌকা ছিলো। আমি সেই নৌকাতেই বর্ষার সময়ে স্কুলে যেতাম। কিন্তু অনেকেই এভাবে যেতে পারতো না। আমি ভেবেছিলাম যদি ছেলেমেয়েরা যাতায়াত সমস্যার কারণে স্কুলে না যেতে পারে,তাহলে স্কুলই তাদের দ্বারে দ্বারে যাবে, নৌকা করে। কিন্তু একজন স্থপতি হিসেবে আমাকে ভাসমান স্কুলটা করার আইডিয়া কাজে লাগানোর জন্য ইনভেস্টর খুঁজে পেতে কষ্ট হয়েছে। কিন্তু সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে আমি একটি অলাভজনক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করি। সংস্থাটির নাম “সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থা”। সেটা ১৯৯৮ সালের কথা।

ভাসমান আহকুলে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন এক শিক্ষক

তবুও রেজওয়ান দমে যাননি। আটানব্বুই সালে মাত্র একটি কম্পিউটার, নিজের জমানো কিছু টাকা আর নিজের স্কলারশীপের ৫০০ ডলারের টাকা দিয়ে ভাসমান স্কুলের কাজ শুরু করেন। ইন্টারনেট সম্পর্কে তার ধারণা ছিল। তাই তিনি বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় একশটার বেশি সংগঠনের কাছে মেইল পাঠানো শুরু করলেন সাহায্য পাবার আশায়। 

সে সময়টা খুব কঠিনই ছিলো রেজওয়ানের জন্যে। মানুষ কত কিছু করে, আর রেজওয়ান কি না নিজের স্কলারশীপের শেষ পয়শাটাও খরচ করে ফেলেছেন ভাসমান স্কুল গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য। এলাকায় খোঁজখবর রাখতেন। যেখানে পুরানো কিংবা অচল নৌকা পাওয়া যেতো সেগুলো তিনি সংগ্রহ করতেন। পরে তাদেরকে মেরামত করে স্কুল করার উপযোগী করে সাজাতেন। প্রথম ভাসমান স্কুলটি তৈরি করার জন্য রেজওয়ানের প্রায় চার বছর সময় লেগেছিলো।

কী আছে স্কুলটিতে? একটি সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল রয়েছে ভাসমান এই স্কুলটিতে। এই বিদ্যুৎ ব্যবহার করে সন্ধ্যার পরেও স্কুলের কার্যক্রম চালানো যায়। নৌকার আলোতে কিংবা কে জানে শিক্ষার আলোতে গ্রামটাও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে রাতে। নৌকার ভেতরেই ক্লাসরুম বানানো হয়েছে। আছে চেয়ার, টেবিল, ব্ল্যাকবোর্ড।

বিভিন্ন সরঞ্জামে সজ্জিত এ ভাসমান স্কুল

বই এর সেলফও আছে নৌকার ভেতরেই। স্কুলটিকে যতটা সম্ভব সুযোগ সুবিধা সংযুক্ত করেছেন রেজওয়ান। বরং, সাধারণ ভূমির স্কুলগুলো থেকেও এটিকে আধুনিক স্কুল বলা যেতে পারে। কারণ, স্কুলটি শুধু কম্পিউটারই নয়, শিক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয় এমন অনেক ইলেকট্রনিক ডিভাইস দ্বারা সুসজ্জিত৷ আছে ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধাও। নৌকাই যেন আরেক ভাসমান পৃথিবী! দৈর্ঘ্য ৫৫ ফুট, ১১ ফুট প্রস্থের একেকটি নৌকায় ত্রিশজন ক্লাস করতে পারেন। 

রেজওয়ান সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন এই ভাসমান নৌকায়। বই, খাতা, কলম সব কিছুই দিচ্ছেন বিনামূল্যে। তবে সবচেয়ে সুবিধা পাচ্ছেন গ্রামের মেয়ে শিক্ষার্থীরা। গ্রামের অনেকেই মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে চায় না। কিন্তু যখন স্কুলই ঘরের কাছে চলে আসে তখন বাবা মায়েরাও আপত্তি করতে পারেন না, বরং আগ্রহ নিয়েই এখন মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন তারা। 

রেজওয়ানের সংস্থাটি ভাসমান স্কুলের মাধ্যমেই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখেনি। বন্যাকবলিত অঞ্চলে এমনিতেই অসুখ বিসুখ বেশি হয়। বিশেষ করে পানিবাহিত রোগ হওয়ার আশংকা তো সবসময়ই থাকে এই এলাকাগুলোতে। তিনি তাই শুরু করলেন ভাসমান ক্লিনিকের কার্যক্রমও! ভাসমান ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামবাসীকে চিকিৎসার সুবিধা দিচ্ছেন তিনি। এছাড়া ভাসমান লাইব্রেরিও আছে রেজওয়ানের। যেখানে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন বিষয়ের উপর বই পড়তে পারেন। আছে ভাসমান কৃষি বিষয়ক ট্রেইনিং সেন্টার। এই ভাসমান প্রকল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হচ্ছে ভাসমান খামার। ভাসমান খামার বর্ষাকালের জন্য, যখন কৃষকরা প্রচলিত ফসল ফলাতে পারেন না, বেকার বসে থাকতে হয়, তাদের কথা ভেবেই এই উদ্যোগ।

আন্তজার্তিক স্বীকৃত পুরষ্কারের কথা যদি বলা হয়, তাহলে এই স্কুলের উদ্যোগ নেয়ার জন্যে এ পর্যন্ত ১৫টির অধিক পুরষ্কার পেয়েছেন রেজওয়ান। “বিল গেটস ফাউন্ডেশন” থেকে “মিলিয়ন ডলার ফান্ড”পেয়েছেন স্কুলের জন্যে। বিখ্যাত ইন্টেল কোম্পানিও তাকে এওয়ার্ড দিয়েছে ভাসমান স্কুলের জন্যে। ২০১২ সালে পেয়েছেন “WISE AWARD”। এই পুরষ্কার পাওয়ার পর পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষাবিদরা, পরিবেশবাদীরা নড়ে চড়ে উঠেন। তারা বুঝেন যে বাংলাদেশের মতো একটি দূর্যোগপ্রবণ দেশে, যেখানে প্রতিবছরই প্রায় বন্যা হয়, এখানে কীভাবে একটা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীতে অভিনব আইডিয়া ব্যবহার করে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। 

রেজওয়ানের এই পদ্ধতি এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোল মডেল হিসেবে কাজ করছে। বিশেষ করে, জলবায়ু সংকটের কারণে হুমকির মুখে থাকা কয়েকটি দেশ এই আইডিয়াকে কাজে লাগাচ্ছে। অনেক দেশেই চালু হয়েছে এই নৌকা স্কুল। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন্স, ভিয়েতনাম ও জাম্বিয়া। শুধু তাই নয়, আন্তজার্তিক পাঠ্যক্রমেও এখন এই ভাসমান স্কুল প্রকল্প সম্পর্কে পড়ানো হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবেলায় মানুষের সংগ্রামের অসাধারণ দৃষ্টান্তের উদাহরণ হিসেবে এই বিষয়টিকে পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 

বাংলাদেশসহ বন্যাকবলিত বিভিন্ন দেশের জলমগ্ন অঞ্চলে জীবনযুদ্ধ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভাসমান নৌকা স্কুলকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি মডেল হিসেবে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, স্লোভেনিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোর প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমে যুক্ত হয়েছে এই স্কুল! 

* সিধুলাই গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ উপকৃত হচ্ছেন এই ভাসমান স্কুল থেকে। এখনো গ্রামটিতে জলেরা আসে দল বেঁধে। এখনো ডুবে গ্রাম, কিন্তু এখন আর স্কুল ডুবে না। কারণ, এই ভাসমান স্কুল ডুবে যাওয়ার জন্য সৃষ্টি হয়নি। এই ভাসমান স্কুল যে ভাসছে জ্ঞানের আলোর বাতিঘর হয়ে... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা