স্টিভ জবস, 'ফলো ইউর প্যাশন' ও একটি ভ্রান্ত ধারণা
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
স্টিভ জবস বলেছেন, ফলো ইউর প্যাশন। কিন্তু তিনি নিজে কি তা ফলো করেছেন? যদি করতেন, তাহলে তার হওয়ার কথা কোনো চার্চের পাদ্রী, নয়ত হিমুর মতো ভবঘুরে মানুষ! তাহলে?
যত ধরনের বিশ্বাস দুনিয়ায় আছে, প্রত্যেকটা বিশ্বাসই আসলে একেকটা ব্যবসার পণ্য। রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে শুরু করে সব ধরনের বিশ্বাসই এই তালিকার মধ্যে পড়ে। মানুষের হতাশা নিয়েও আজকাল ব্যবসা হচ্ছে। কারণ, এখানে বিশ্বাসকে পণ্য বানাবার সুযোগ আছে।
এমনিতেই মানুষের স্বাভাবিক সাইকোলজি সারাক্ষণই এপ্রোভাল খুঁজে বেড়ায়। ধরেন, আপনি খুব মোটা, এখন চিকন হওয়ার জন্য ব্যায়াম শুরু করেছেন। তিন মাসে তিনশ গ্রাম শুকানোর পর আপনি এপ্রোভাল খুঁজে বেড়াবেন, আশায় থাকবেন কেউ একজন মুগ্ধ হয়ে বলুক, আপনি কতটা শুকিয়ে গেছেন। কেউ না বলা পর্যন্ত আপনার বিশ্বাস শক্ত হয় না। আবার ধরেন, আপনি লিখেন বা ছবি আকেঁন অথবা অন্য কোনো ক্রিয়েটিভ কাজ৷ কেউ যদি আপনার প্রশংসা করে তাহলে আপনার কেন ভাল লাগে? এমন না তারা ভাল না বললে আপনার লেখা খারাপ বা ছবি খারাপ। কিন্তু এই যে এপ্রোভাল সেটা আসলে আপনার ইনার মাইন্ডকে এক ধরনের স্যাটিসফ্যাকশন দেয়। সাধারণভাবেই মানুষের সাইকোলজি সব কিছুতে এপ্রোভাল খুঁজে।
যারা হতাশ তাদের জন্য এই সমস্যা আরো বেশি প্রকট। তারা শুধু এপ্রোভালই খুঁজে না, একধরনের নিশ্চয়তা খুঁজে। একটা বিশ্বাস খুঁজে যে সেও চাইলে কিছু করতে পারে। এই বিশ্বাসটা সফল মানুষের কথা থেকে সে পেতে চায়। হতাশ মানুষের কাছে এ ধরনের এপ্রোভাল বা বিশ্বাস বিক্রি করার জন্যই একটা সেক্টর গড়ে উঠেছে মোটিভেশন কেন্দ্রিক। কেউ মোটিভেশনাল স্পিচ শুনাচ্ছে, কেউ বই লিখছে 'হাউ টু বি সাকসেসফুল' টাইপ। খেয়াল করে দেখবেন, বেস্ট সেলার ননফিকশন বইগুলোর বেশিরভাগই মোটিভেশন বিষয়ক।
মোটিভেশনাল বইগুলোতে কী থাকে বা যারা অনুপ্রেরণার কথামালা শুনান তাদের কথার সারাংশ কী মনে করুন তো? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের প্রধান সাজেশন হলো, 'ফলো ইউর প্যাশন'। আপনি যে কাজটা ভালবাসেন সেটাই আপনার প্রফেশন হওয়া উচিত, এইজন্য আপনার পরিশ্রম করা উচিত, প্যাশনের পেছনে সময় দেয়া উচিত। এগুলোই তো শুনে থাকেন স্পিকারদের কাছ থেকে, তাইনা? এর সাথে নিশ্চয়ই রেফারেন্স হিসেবে স্টিভ জবস, জাকারবার্গ সহ কয়েকজন কলেজ ড্রপ আউটের নাম আপনাকে শুনানো হয়। স্টিভ জবস এর উক্তিও রেফারেন্স হিসেবে বলা হয়। মূলত, এই 'ফলো ইউর প্যাশন' থিউরিটা এসেছেই স্টিভ জবসের স্পিচ থেকে। স্টিভ জবস স্ট্যানফোর্ডে তার সেই বিখ্যাত স্পিচে বলেছিলেন,
"You’ve got to find what you love…. The only way to do great work is to love what you do. If you haven’t found it yet, keep looking, and don’t settle ."
এই থিউরি বলে, আপনাকে প্রথমে আপনার প্যাশন খুঁজে বের করতে হবে, আপনি কী ভালবাসেন সেটা জানতে হবে। তারপর সেই প্যাশনের সাথে ম্যাচ করে এমন চাকরি খুঁজে পেতে হবে। কিন্তু, আমরা বলতে চাই এই থিউরি ঠিক নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই থিউরি কাজ করবে না। ইনফ্যাক্ট, খোদ স্টিভ জবসের নিজের জীবনেই এই থিউরি কাজ করেনি।
আমরা বলতে চাই, কেউ যদি আপনাকে বলে 'ফলো ইউর প্যাশন', চট করেই এটা বিশ্বাস করবেন না, ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক যত পরামর্শ লোকে দেয়, এটা সবচেয়ে বাজে পরামর্শের একটি। বিশেষ করে আপনি যদি এমনিতেই কিছুটা হতাশ হন, এই পরামর্শ ফলো করতে গিয়ে খুব ভাল চান্স আছে যে আপনি আরো বেশি হতাশ হয়ে যাবেন। আপনি তখন হাড়ে হাড়ে টের পাবেন, 'Reality is stronger than motivation'।
তরুণ বয়সের স্টিভ জবসের কখনোই এমন প্যাশন ছিলো না যে সে একটা টেকনোলজি কোম্পানি শুরু করবে। সে পড়তো রিড কলেজে। তাঁর তখন লম্বা চুল ছিল এবং সে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতে ভালবাসত। আসলে ওই বয়সে তাঁর না ছিল ব্যবসায়ে আগ্রহ, না টেকনোলজিতে। বরং, পাশ্চাত্যের ইতিহাস এবং নাচের দিকে তার আগ্রহ ছিল বেশি, এগুলো নিয়ে সে পড়াশুনা করত। এছাড়া সে ডুবে থাকত প্রাচ্যের অস্পষ্ট রহস্যের চিন্তায়।
কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের পরই সে ড্রপড আউট হল। তারপরেও সে এক বছর কলেজে ছিল কারণ সেখানে ছিল থাকা আর টেম্পলে ফ্রি খাওয়ার ব্যবস্থা। যদিও দিনে দিনে সে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। দৈণ্যদশা এড়াতে সে চাকরি করবে বলে ঠিক করল। এটা ছিল ১৯৭০ এর দিককার কথা। একটি চাকরির বিজ্ঞাপন তাকে আকর্ষণ করলো, বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল এমন - 'Have fun & make money'। এটারি (Atari) নামের এই কোম্পানির নাইট শিফটের চাকরি কিছুদিন করলেও স্টিভ জবসের পুরানো বৈরাগ্যভাব বোধহয় জেগেছিলো মনের মধ্যে। চাকরি ছেড়ে দিলেন জবস। বেড়িয়ে পড়লেন ভারতের উদ্দেশ্যে, ভিক্ষুকজীবি হিসেবে তিনি ভারতে গেলেন, যাকে আবার তিনি বলছেন 'স্পিরিচুয়াল জার্নি'।
যাহোক, ভারত থেকে তিনি ফিরলেন ১৯৭৪ সালে। সেসময় এলেক্স নামের স্থানীয় একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং উদ্যোক্তা কম্পিউটার টাইম-শেয়ারিং কোম্পানি শুরু করলেন। এলেক্স স্টিভ ওজনিয়াক নামক একজনকে এপ্রোচ করলেন, সে যেন তাকে টার্মিনাল ডিভাইসের ডিজাইন করে দেয় যাতে করে ক্লায়েন্টরা সেন্ট্রাল কম্পিউটারে একসেস করতে পারে ডিভাইস ব্যবহার করে।
জবসের বন্ধু হলেও ওজনিয়াক কখনোই স্টিভ জবসের মতো ছিল না, সে সত্যিই টেকনোলজির প্রতি পাগলের মতো আগ্রহী ছিল এবং কলেজে এই বিষয় নিয়ে গুরুতর পড়াশুনাও করেছে। ওজনিয়াক ব্যস্ততার কারণেই কিনা কে জানে কাজটার দায়িত্ব পুরোপুরি নিতে পারলনা, সে বন্ধু জবসকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিল। জবস এখানেও বেশিদিন স্থায়ী থাকলেন না। ১৯৭৫ এ তিনি এই কাজ ছেড়ে দেন হুট করে এমনকি যার চাকরি সেই এলেক্সকে পর্যন্ত জানাননি।
গল্পটা বলার কারণ হলো, যদি টেকনোলজি জবসের প্যাশনের জায়গা হত, তাহলে অন্তত তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই সময়গুলোতে সেই প্যাশনের প্রতি ডেডিকেশন একটুও দেখা যায়নি এমনকি এই সময় পর্যন্ত এসেও মনে হয়নি যে তিনি টেকনোলজিকে খুব বেশি দরদ দিয়ে অনুভব করেন। তিনি যে দুইটি চাকরি করেছেন সেগুলো আসলে তাঁর আর্থিক প্রয়োজন মেটানোর তাগিদেই, কারণ অন্য সময়ে তিনি ভবঘুরের মতো থাকতেন, তাঁর আগ্রহের জায়গা ছিলো আধ্যাত্মিকতায়। খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতেন, লম্বা লম্বা চুলে তিনি ছিলেন বিভ্রান্ত এক তরুণ। তাঁর আগ্রহ ছিল জেন বুদ্ধিজমে। যদি স্পিরিচুয়ালিটিকেই তিনি ফলো করতেন আজকে তিনি হতেন কোনো চার্চের পাদ্রী, নয়ত হিমুর মতো ভবঘুরে মানুষ।
কিন্তু, সেটা হয়নি। জীবন তাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে তাকে আজকের দিনের অনেক টেকনোলজিস্ট, অনেক তরুণ স্পিরিচুয়াল গুরুর মতোই মানে। সে গল্প প্রায় সবাই জানেন। সফল হওয়ার পর স্টিভ জবস সবাইকে 'ফলো ইউর প্যাশন' থিউরি শুনাতেন স্পিচে, সেমিনারে। তার পরামর্শ যা ভালবাসো তাকে পেশা হিসেবে নেও। এই থিউরি ছড়িয়ে গেছে দাবানলের মতো। ফেসবুকেও অনেকে মোটিভেশনাল স্ট্যাটাস লিখতে গেলে টেনে আনে স্টিভ জবসের ড্রপ আউট হওয়ার কথা, প্যাশন ফলো করার কথা। মোটিভেশনাল স্পিচেও সারকথা একই। প্যাশন কী সেটার পেছনে দৌড়াও। কিন্তু, এই পরামর্শ কি আসলেই কাজ করে?
সবাই জীবনে প্যাশনের পেছনে দৌড়ানোর সুযোগ পায় না, এমনকি সবাই প্যাশন খুঁজেও পায় না। তাহলে কি তাদের জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে? এর সমাধান কী? সমাধান হল, যে কাজের সুযোগ আসুক না কেন সেটাতেই নিজের শতভাগ এফোর্ট দেয়া। কারণ, আপনি কখনোই জানেন না এরপর আপনার জন্য কী সুযোগ অপেক্ষা করছে।
কক্সবাজারের জাহিদের কথাই মনে করে দেখেন, মধু হই হই গান গাওয়ার পর যাকে গোটা বাংলাদেশ চিনে গেছে। ওই ভিডিও না হলে সে কি এই পর্যায়ে আসতে পারত কখনো? বাস্তবতা কী বলে? ওই ভিডিওর আগে কেউ যদি তাকে বলতো যা ভালবাসো তাই করো, সেটা শুনে সে যদি গানই করতো, তাহলে তার পরিবারের না খেয়ে মরতে হতো হয়তো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পালটে গেছে। এখন সে আশা করতেই পারে গান গেয়ে জীবন চলে যাবে।
তাই আমার সবসময়ই মনে হয়, যখন যা করার সুযোগ থাকে সেটাতেই একশ ভাগ এফোর্ট দিয়ে লেগে থাকা উচিত। কারণ, এটাতেই নিজের হাত আছে, এটাই বর্তমান, ভবিষ্যৎ বলে কয়ে কেউ ঠিক করতে পারে না, ঠেকাতেও পারে না।
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন