বলিউড দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত প্রেম-ভালোবাসার মাঝেই আটকে ছিল। বন্ধুত্ব সম্পর্কটাকে সেরকমভাবে কখনোই নারচার করতে পারেনি। যে বন্ধুত্ব নিয়ে এতো অনীহা বলিউডের, সে বন্ধুত্বকেই বারবার রিডিফাইন করলেন কেন রাজকুমার হিরানী!

বলিউড দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত প্রেম-ভালোবাসার মাঝেই আটকে ছিল। বন্ধুত্ব সম্পর্কটাকে সেরকমভাবে কখনোই নারচার করতে পারেনি। বলিউড হিট মুভির ফর্মুলাই ছিল নায়ক-নায়িকার প্রেম, সে সম্পর্ককে ঘিরে তৈরি হওয়া বাকি সম্পর্কগুলো নিয়ে কেউ আলাদাভাবে কাজ করতেই চাইতেন না যেন। অথচ ইতিহাস ঘেটে দেখলে দেখা যাবে বলিউডের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সেলেব্রেটেড ফিল্ম ‘শোলে’র পেছনে জয় আর ভিরুর বন্ধুত্বই অনেক বড় অবদান রেখেছে। 

তো যে বন্ধুত্ব নিয়ে এতো অনীহা বলিউডের, সেই বন্ধুত্বকেই বারবার রিডিফাইন করলেন কেন রাজকুমার হিরানী! হয়তো তিনি তার আশেপাশের জগত থেকে গল্প নেন বলেই বন্ধুত্বকে সবসময় বেশি মর্যাদা দিয়েছেন তার সিনেমায়। তা না হলে তার দেখানো বন্ধুত্বগুলো আইকনিক হবে কেন! বলিউডের সবচেয়ে সফল নির্মাতা রাজু হিরানী তার ৫ টি সিনেমাতেই বন্ধুত্বকে যেভাবে প্রকাশ করেছেন সেরকমটা আর কেউ পারেনি কখনো। চলুন এনালাইসিস করা যাক রাজু হিরানীর সিনেমার বন্ধুত্বকে।

মুন্না ভাই এমবিবিএস

গল্পটা এক টাপোরি গুণ্ডা মুন্নার ডাক্তার হয়ে ওঠার। কিন্তু মুন্নার মুন্না হয়ে ওঠার পুরোটাই সার্কিটকে জুড়ে। সার্কিটকে মুন্নার সহযোগীও বলা যায়, সহকারিও বলা যায়, চ্যালাও বলা যায় কিন্তু সবচেয়ে ভালো হয় হয়তো বন্ধু বললেই। কারণ এই সার্কিটেরই কেবল শক্তি আছে মুন্নাকে থামানোর, রাগ কমানোর, মায়া বাড়ানোর, দুঃখে পাশে দাঁড়ানোর। বাবা-মা কষ্ট পেয়েছে তাই প্রতিশোধপরায়ণ মুন্না যখন ডক্টর আস্থানার মেডিকেলে পড়াশোনা করতে যায় তখন সার্কিটের কাঁধেই সব দায়িত্ব দিয়ে পড়তে যায় সে। সার্কিটও মুন্নার হল এমনভাবে সাজিয়ে দেয় যেন তার ভাইয়ের কোন কষ্ট না হয়। ডিসেকশনের জন্য ডেডবডি লাগবে তাই মুন্নার চাওয়ামাত্রই সার্কিটের এক জলজ্যান্ত বডি নিয়ে আসা হাসির উদ্রেক করার পাশাপাশি মুন্নার প্রতি সার্কিটের ভালোবাসাটাও প্রকাশ করে। 

ডক্টর সুমানের প্রতি মুন্নার দুর্বলতা, তাকে পটানোর চেষ্টা, সবকিছুতেই মুন্না ডানে তাকালেই দেখতে পেতো সার্কিটকে। কষ্টের সময় সার্কিটের কাঁধেই মাথা রেখে কষ্টমোচন করতো মুন্না। এর আগে কখনো বলিউডে গুরু-চ্যালার মাঝে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করার প্রয়োজন মনে করে নি কেউ, মনে করলেও রাজু হিরানীর মতো কেউ প্রকাশ করতে পারেনি। সার্কিটের মাঝে মুন্না কেবল বন্ধুই না, একজন ছোট ভাইও পেয়েছিল। সার্কিটও মুন্নাকে বড় ভাই মেনে তার সব আবদার মেনে চলার চেষ্টা করতো, তার কাছেই আশ্রয় খুঁজতো। এমন বন্ধুত্ব রাজু হিরানী বের করে এনেছেন শহরের নিম্নবিত্ত অপরাধপ্রবণ এলাকা থেকে চটুল হিউমার যোগ করে।

লাগে রাহো মুন্নাভাই

এবারও সার্কিট আর মুন্না। তাদের বন্ধুত্বে অবশ্য নতুন অংশীদার হিসেবে যোগ দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধী। হ্যাঁ রাজু হিরানী এই সিনেমায় ফিকশনালাইজ গান্ধীকে মুন্না-সার্কিটের সঙ্গী করে ভারত স্বাধীন হবার প্রায় ৫৯ বছর পর আবার গান্ধীগিরি করেছেন। প্রিয় মানুষকে মুগ্ধ করতে গিয়ে গান্ধীকে নিয়ে পড়তে পড়তে হেলুসিনেশনে গান্ধীর দেখা পায় মুন্না। বইয়ে পড়া শিক্ষাই কল্পনায় গান্ধীর মুখ থেকে শুনে বাস্তবায়ন করতে নামে মুন্না। সঙ্গী হয় সার্কিট, যে কীনা গান্ধীকে দেখতে না পেয়েও মুন্না যেন নিজেকে পাগল না ভাবে তাই মুন্নাকে বলে সেও গান্ধীজিকে দেখতে পারে। তারপর দুজন মিলে করে বেড়ায় দেশজুড়ে গান্ধীগিরি। 

লাগে রাহো মুন্নাভাই সিনেমায় সঞ্জয় দত্ত ও আরশাদ ওয়ার্সি

এই সিনেমাতেও রাজু হিরানী বন্ধুত্বকে দেখিয়েছেন আরও নতুনভাবে। গান্ধীজিকে কেবল নোটে আর ছুটিতে স্মরণ না করে তার বলে দেয়া কাজগুলো, মনোভাবগুলো বুকে ধারণ করতে হবে বন্ধুর মতোই। মুন্না সেরকমই একজন বন্ধু হয়ে সে বন্ধুত্বের দীক্ষা দিয়ে যায় সবাইকে। বাপু, মুন্না আর সার্কিট তিন বন্ধুর এই বন্ধুগিরি একমাত্র রাজু হিরানীই দেখাতে পারেন।

থ্রি ইডিয়টস

এই সিনেমার রন্ধ্রে রন্ধ্রেই বন্ধুত্ব। অনেকেই বলে থাকেন একে রাজু হিরানীর সেরা সিনেমা, বলিউডের সেরা সিনেমা। এরকম তকমা লাগানো যায় এই সিনেমায় গায়ে কারণ এতো সুন্দরভাবে বন্ধুত্বকে যে আর কখনো দেখানো হয়নি। রাজু, ফারহান আর র‍্যাঞ্চো- তিন বন্ধুকে নিয়েই থ্রি ইডিয়টস। উপমহাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার যে অসার অবস্থা, প্রকৃত মেধা ধ্বংসের যে পাঁয়তারা, ভয়কে পুঁজি করে সবার যে প্রথম হবার তাড়া এই সিনেমায় তার সবই উঠে এসেছে তিন বন্ধুর হাত ধরে। 

রাজু- যে কীনা পড়ার চেয়ে বেশি পূজা করে, কারণ তার মনে ভয় ঢুকে গেছে যে এতো এতো পরীক্ষা আর পড়ার মাঝে সে যেন খেই হারিয়ে না ফেলে কারণ সে খেই হারিয়ে ফেললে তার দরিদ্র পরিবারকে সামলাবে কে। 

ফারহান- যার ওপর ছোটবেলা থেকেই প্রেশার যে ইঞ্জিনার হতেই হবে। কিন্তু তার প্যাশন যে ফটোগ্রাফি। যে প্যাশন দাবিয়ে সে যুদ্ধ করে যাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার হতে। 

আর আছে র‍্যাঞ্চো- যে কীনা কেতাবি পড়াশুনার চেয়েও বেশি হাতে-কলমে পড়তে শিখতে বেশি আগ্রহী। যার প্যাশনই ইঞ্জিনিয়ারিং, ভয়ও নেই তাই মনে। 

থ্রি ইডিয়টস- র‍্যাঞ্চো, রাজু, ফারহান

এই র‍্যাঞ্চোই রাজু আর ফারহানকে বাঁচতে শেখায় নতুন নিয়মে। র‍্যাঞ্চোর প্রথম হওয়া নিয়ে রাজু, ফারহান কষ্ট পেলেও পড়ে বুঝতে পারে যে তাদের একজন ভীত বেশি আর অন্যজনের প্যাশন নেই এখানে। এক বন্ধুর হাত ধরে আরেক বন্ধু নিজ নিজ জীবনের মানে খুঁজে পায়। রাজুর বাবা অসুস্থ হলে র‍্যাঞ্চো বাইকে নিয়ে তাকে হাসপাতালে পৌঁছায়। র‍্যাঞ্চোর প্রেম সফল করতে রাজু, ফারহান সাহায্য করে। ফারহানের ফটোগ্রাফি প্যাশন নিয়ে র‍্যাঞ্চো ফারহানের বাবা-মাকে বোঝায়। শেষমেশ যে যার ভয়কে জয় করে সফল হয় মানুষ হিসেবে। ওদিকে র‍্যাঞ্চো ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতে-কলমে ইঞ্জিনিয়ারিং শেখায়, নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করে। জীবনে বন্ধুদের এটাই অবদান যে তারা সাহায্য করে নিজেকে নিজের চিনতে, তাই তো বন্ধুদের সাথে আমরা আমাদের মতোই থাকি; ভণিতা-অভিনয়ের কোন প্রশ্নই আসে না।

পিকে

এক এলিয়েন এসে হাজির হয় ধর্মভীরু পৃথিবীতে। তার ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য স্পেসশিপ কল করতে হবে, কিন্তু স্পেসশিপ কল করার ডিভাইস চুরি হয়ে যায় পৃথিবীতে এসেই। তারপর সেই অদ্ভুত এলিয়েনের হাত ধরে আমরা দেখি পৃথিবীতে ধর্মের নামে চলা অধর্মের ব্যবসা কতো প্রকার ও কী কী! এরই মাঝে এলিয়েন পিকের দেখা হয়ে যায় নিউজ রিপোর্টার জাজ্ঞুর সাথে। রাজকুমার হিরানী এবার বন্ধুত্বের অনুষঙ্গ আনলেন এক এলিয়েন আর পৃথিবীর মানুষের মাঝে। জাজ্ঞুর হাত ধরেই পিকে একে একে তার সরল মনে ধর্ম নিয়ে চলা অধর্মের ব্যবসার নানান ত্রুটি সামনে নিয়ে আসতে থাকলো। 

দুজনের বন্ধুত্বের মাঝে চাওয়া-পাওয়ার কোন জায়গা নেই, জায়গা আছে কেবল ভরসার। পিকে জানতো জাজ্ঞু কখনো তার হাত ছাড়বে না, আর জাজ্ঞু জানতো পিকে হাত ধরলে সহজে ছাড়েই না। পিকে আর জাজ্ঞুর এই বন্ধুত্ব যেন নতুন করে আমাদের ভাবতে শেখায়। কিছু কিছু বন্ধুত্বে ভালোবাসা অনাহূত অতিথির মতো ঢুকে পড়লেও তেমন প্রভাব ফেলে না কেননা বন্ধুত্বের দেয়াল ভালোবাসার এলো ঝড়ে নড়বড়ে হয় না।

পিকে সিনেমায় আমির খান ও আনুশকা শর্মা

সাঞ্জু

সঞ্জয় দত্তের জীবনী নিয়ে তৈরি করা রাজকুমার হিরানীর এই সাম্প্রতিক সিনেমায় দুটি বন্ধুত্বের সম্পর্ক আমাদের আঁকড়ে ধরেছে। এক হচ্ছে সঞ্জু আর তার বাবা সুনীল দত্তের মাঝে তৈরি হওয়া বন্ধুত্ব আর দুই সঞ্জু আর কামলির পাগলামিমাখা বন্ধুত্ব। সঞ্জয় দত্ত যখন তার মা মারা যাবার পর ড্রাগসের দুনিয়ায় আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছিল তখন বাবা সুনীল দত্ত পিতা-পুত্রের সকল দূরত্ব পাশে রেখে বন্ধুর মতো সঞ্জুকে আপন করে নেন। সঞ্জয়ের ফিরে আসা ড্রাগস থেকে আবার সন্ত্রাসীমূলক কার্যকলাপে ঢুকে পড়া, ক্যারিয়ারের ডাউনফল চলতে থাকা সবকিছুর মাঝেই সুনীল তার ছেলেকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন পরম আদর ও কঠিন শাসনে। যেভাবে এক বন্ধু শত বাঁধা সত্ত্বেও তার বন্ধুকে আঁকড়ে রাখে। 

সুনীল একা হয়তো পারতেন না যদি না কামলিও থাকতো তার সাথে সঞ্জুকে ধরে রাখার জন্য। সঞ্জুর মা যখন মৃত্যুশয্যায় তখন পরিচয় বিদেশে সঞ্জুর কামলির সাথে। সঞ্জুকে বারবার ড্রাগস থেকে ফেরানোর জন্য কতোকিছুই না করেছে কামলি। সঞ্জুর প্রিয়তমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে দেখে নিজে গিয়ে কনভিন্স করে এসেছিল তাকে, কিন্তু মাতাল সঞ্জু সে সুযোগও হেলায় হারিয়েছে। এমনকি যে মেয়ের সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল সে, সে মেয়েকেও সঞ্জু তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। তবুও কামলি সঞ্জুর হাত ছাড়ে নি। কারণ ফ্লড মানুষের সাথে বন্ধুত্ব রাখা যায় কিন্তু বন্ধু যদি টেরোরিস্ট হয়ে যায়, মানবতা লোপ পায় তাহলে আর হাত ধরে রাখা যায় না। কামলিও রাখেনি। এতো চেষ্টা করেও যাকে পথ দেখাতে পারেনি তার কাছ থেকে দূরে চলে যায় হোক ভুল তথ্য পেয়েই। কিন্তু কামলি শিখিয়ে দিয়ে যায় বন্ধুত্বের সংজ্ঞা। হয়তো সামনের মানুষটা আপনার বন্ধুত্ব ডিজার্ভ করে না, কিন্তু তাই বলে আপনি আপনার বন্ধুকে ছেড়ে যেতে পারেন না ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না সে মানবতা হারায়।

রাজু হিরানীর সব সিনেমাতেই বন্ধুত্ব এসেছে মূল প্রভাবক হিসেবে। হতে পারে রাজু বাস্তবেই বন্ধুবৎসল তাই, হতে পারে রাইটার অভিজাতের সাথে ও প্রডিউসার বিধুর সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ামক হিসেবে কাজ করে অথবা হতে পারে বন্ধুত্বের মাঝে রাজু হিরানী খুঁজে পেয়েছেন তার গল্পগুলোকে। যা ই হোক না কেন এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে তার মতো করে নিয়মিত কেউ বন্ধুত্বকে দেখাতে পারেননি নানা রঙে, নানা ঢঙে; সম্পর্কের নানা বাস্তবতায়! স্যালুট ম্যাজিশিয়ান... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা