নিউইয়র্ক-লন্ডনের শপিংমলগুলোয় কাপড়ের গায়ে বাংলাদেশ ট্যাগ দেখে আনন্দিত হয়েছেন? তবে শুনুন এর নেপথ্যের বর্বর কাহিনী...

আমেরিকা-ইংল্যান্ড চাইলে আমাদের চেয়ে ভালো কোয়ালিটি-প্রোডাক্ট বানাতে পারে। আমাদের চেয়েও ঝকঝকে কাপড় বানিয়ে রপ্তানি করতে পারে। আর্মস-টেক প্রোডাক্ট বিক্রি করে বিলিয়ন ডলার আয় করলেও নিজেরা কাপড় কেন বানায় না জানেন? জানলে আপনি বুঝবেন, আমরা কতটা বর্বর একটা ইন্ডাস্ট্রি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। 

বাংলাদেশে একটা গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতন ৫ হাজারের আশেপাশে। তাকে ভোরে ঘুম থেকে জাগতে হয়। কীসের কী রান্না করে খেল, তার আগেই পিঁপড়ার মতো দলবেঁধে গার্মেন্টসগুলোয় ঢুকে পড়ে। বিকেল পর্যন্ত সারিসারি রোবটের মতো কাজ করে। আগে বোনাস ছিল না। এখন কেউ কেউ দেয়। আগে বেতনটাও ঠিকঠাক দিত না, এখন না হয় পাচ্ছে।

এই ভয়ংকর দৈনিক মজুরি শুক্রবার বাদে প্রতিদিনই চলে। কোন ডে অফ নাই। কোন ছুটি নাই। গার্মেন্টসের শ্রমিকরা দুই ঈদে লোকাল বাসে ট্রেনের ছাদে ঘরে ফেরে। সবার শেষে যায়, সবার আগে ফেরে। বছরের অন্য সময় তাদের গ্রামে ভুলেও ফিরতে দেখবেন না।

তারা বাচ্চা জন্ম দিতে ভয় পায়। দেখবে কে? স্বামী-স্ত্রী ভোর থেকে সন্ধ্যা কাজ করে। যদি ভুলেও বাচ্চা জন্ম হয়, গ্রাম থেকে তাদের মায়েরা চলে আসে। ছোট্ট ঘুপচি ঘরে বাচ্চাদের বেড়ে উঠতে হয় দাদী নানীর কোলে। স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের সাথে আরেকটা বৃদ্ধ মানুষের জীবন বন্দী হয়ে যায়। অথবা দুধ ছাড়ার আগেই তাদের বাচ্চাদের গ্রামে মায়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আপনার পরনের কাপড় যত দামী, বুঝবেন ঐ শ্রমিকের বাচ্চারা ততবেশি বাবা-মা ছাড়া ঘুপচিঘরে-গ্রামের নানীর বাড়িতে কান্নাকাটি করেছে।

ঘুপচি পরিবেশেই কেটে যায় তাঁদের রাত-দিন;  image- GMB Akash

গার্মেন্টসে বাচ্চা নিয়ে যাওয়া যায় না। আলাদা খেলার জায়গা তো দূরের কথা, প্রেগনেন্ট হলে ছুটির ব্যবস্থা পর্যন্ত নাই। পেটে বাড়ন্ত বাচ্চা নিয়ে কাজ করে যায় দিনের পর দিন। হিউম্যান রাইটস দূর কি বাত! গ্রাম থেকে নিঃস্ব হওয়া, পথে বসা, সম্মান হারানো কিংবা নানা কারণে তারা শহরে আসে। একটা অংশ রিক্সা টানে। বড় অংশটা গার্মেন্টসের চক্রে ঢুকে পড়ে। সবারই ধারণা স্বামী-স্ত্রী মিলে টাকা জমিয়ে একদিন গ্রামে ফিরবে। ব্যবসা করবে ছোট। বাকী জীবন নিজগ্রামেই কাটিয়ে দিবে। আমার জীবনে আমি একটা পরিবারকেও দেখতে পাইনি ফিরে এসে ব্যবসা করে দাঁড়াতে পেরেছে। নিঃস্ব হয়ে আবার ফিরে যায়।

অসুস্থ হলে প্রোপার হেলথ সাপোর্ট তাদের নাই। একদিন ছুটি নিয়ে ডাক্তার দেখাবে সে উপায় নাই। কাজের প্রোপার ইনভায়োরেনমেন্ট নাই। সন্ধ্যা হয়, আবার ঘুপচিতে ফিরে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে। এর ভেতরই তারা সংসার করতে চেষ্টা করে। প্রেম-বিয়ে করে। রাতে ফিরে মোবাইলে গ্রামে ফেরত পাঠানো বাচ্চার সাথে কথা বলে সন্তানের সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে। এরপর? পরেরদিন ভোরবেলায় গার্মেন্টসের মতো জেলখানাগুলোয় ফেরার তাড়া নিয়ে সন্ধ্যা সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়ে। 

আমেরিকান-মেক্সিকান-ইতালিয়ান-ব্রিটিশ অর্ডার বাংলাদেশে কেন আসে? এখানে শ্রমের দাম কম। উৎপাদন খরচ কম। এখানে জীবনের মূল্য নাই। এই কাজগুলো ইউরোপ-আমেরিকায় করা যাবে না। প্রোডাকশনের পেছনেই অনেক টাকা চলে যাবে। এজন্যই কমদামে জীবন কিনে নিয়ে যায় বাংলাদেশ থেকে। ওয়ার্ল্ড কাপে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের জার্সিতে যখন বাংলাদেশের নাম দেখবেন, আপনি এখন আর আনন্দিত হতে পারবেন না। প্রত্যেকটা সুতোর ভাঁজে ভাঁজে অনেকগুলো বাংলাদেশী শ্রমিকের জীবন সেলাই করে বেঁধে রাখা আছে। এই গল্প ইউরোপ আমেরিকার ক্ষেত্রেও শুধু নয়। এই আড়ং, এই সেইলর, এই রিচম্যান সবকিছুই দুষ্টচক্রের প্রোডাক্ট।

আমার ফ্রেন্ডলিস্টে একজন শিক্ষিত, মার্জিত বিশ্বভ্রমণকারী আছেন। তিনি টেড-টকে শতশত ইঞ্জিনিয়ারদের সামনে বলেছিলেন, আমার একটাই টি-শার্ট। আরেকটা কেনার আগে আমি জানি, একটা করে কাপড় তৈরি করতে কারখানায় কতগুলো পানি নষ্ট হয়। পরিবেশ নষ্ট হয়। কারখানার বর্জ্য কত নদীকে নষ্ট করে। পোশাক শিল্পে দ্বিতীয়? আড়ঙের প্রোডাক্ট ছাড়া কিছু কেনেন না? কোন অপশনটা নিয়ে সীনাটা টান করবেন, বলুন তো?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা