পরিবারের বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে নামলেন ব্যবসায়। আনাড়ি হওয়ায় প্রথমদিকে বেশ বড়সড় ধাক্কা খেলেন কয়েকটা। এরপর যখন শক্তপোক্ত হয়ে ফিরলেন, তখন চিত্রটা ভিন্ন, তার প্রতিষ্ঠানের মূল্যমান এখন ত্রিশ কোটি টাকার বেশি!

আমাদের দেশ অথবা এই উপমহাদেশের প্যাটার্নটাই এমন, এখানে আপনি যদি সিস্টেমের পার্ট হয়ে যান, তাহলে আপনার জীবন বেশ নিশ্চিন্ত। কিন্তু সমস্যা হয় তাদের নিয়েই, যারা স্রোতের সাথে মিশে যেতে চান না। যারা আলাদা করে কিছু করার স্বপ্ন দেখতে চান। সমস্যা হলো, যে মুহুর্ত থেকেই তারা স্বপ্ন দেখা শুরু করে, সেই মুহুর্ত থেকেই পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র এই তিনটি যন্ত্র মিলে সেই লোকটিকে ভেঙ্গে-গুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া শুরু করে। এরকমই গল্প ছিলো মোহাম্মদ গাজী তৌহীদুর রহমানের। যিনি ভাবতেন, তার নিজের একটা ব্যবসা হবে। কারখানা হবে। সেখানে মানুষ কাজ করবে।

শুরু থেকেই যেটা প্রধান সমস্যা দেখা দিলো, তার ভাবনাকে সত্যি করার মত কোনো সহায়তা তিনি  পেলেন না কারো থেকে। অথচ তার বদলে সবখান থেকেই আসতে শুরু করলো বিপত্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে পাশ করে বের হওয়া তরুণ সে। চোখেমুখে উদ্যোক্তা হওয়ার তীব্র স্বপ্ন। কিন্তু পরিবার আটকে দিলো প্রথমেই। স্রোতের বিপরীত যাওয়া যাবে না। করতে হবে চাকরী। দশটা- পাঁচটার চাকরী। তৌহিদ প্রথম প্রথম পরিবারের কথা গা করলেন না। শুরু করলেন ব্যবসা। নানারকম ব্যবসা। যখন, যেখানে সুযোগ পেয়েছেন ব্যবসার, করেছেন। ওদিকে পরিবারের প্রতিবাদ, সমালোচনা তখন চলছে পুরোদমে।  

তৌহিদ হার মেনে নিলেন। অনিশ্চিত ব্যবসা ছেড়ে নিশ্চিত চাকরী করা শুরু করলেন। কিন্তু মাথায় চেপে বসা জগদ্দল 'ব্যবসা'র ভূত যাবে কোথায়! বছরখানেকের মধ্যে দিলেন চাকরী ছেড়ে। আবার শুরু করলেন ব্যবসা। পরিবার এবার অন্তিম-অস্ত্র প্রয়োগ করলো। বিয়ে দিয়ে দিলো তৌহিদ'কে। মাথায় যুক্ত হলো আরেক বাড়তি চাপ। আবার ব্যবসা ছেড়ে চাকরী শুরু করলেন তিনি। কয়েক বছর চাকরী করলেনও। কিন্তু যার স্বপ্ন ব্যবসা করবেন, তাকে অন্য কিছু দিয়ে প্রবোধ দেয়া তো সম্ভব না।

চাকরী করতে করতেই ছোট্ট এক ব্যবসার  সুযোগ পান তিনি।  বিস্কুটের প্যাকেটের ভেতরের প্লাস্টিকের ট্রে বানানোর ব্যবসা ধরেন তিনি। তিনি দেখলেন এই ব্যবসা বেশ লাভজনক। তিনি শুরু করলেন এই ট্রে বানানোর কাজ৷ কন্ট্রাক্ট হয় এক লোকের সাথে। আইনি জিনিসপত্র না বোঝার কারণে তৌহিদকে ঠকিয়ে টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করে চলে যায় সেই লোক। তৌহিদ ফাঁপড়ে পড়েন। চাকরীটাও তিনি ছেড়ে দিয়েছেন ততদিনে।

তৌহিদ তখন আবার ভাবতে শুরু করেন, কী করা যায়! বিস্কুটের ট্রে তৈরীর মেশিন আগেই কেনা ছিলো। তৌহিদ সেটা ব্যবহার করেই বিস্কুটের নানারকম ট্রে বানানো শুরু করেন। বাজারের একরকম ট্রে'র বদলে তিনি ফরমায়েশ মতন যেকোনো রকম ট্রে বানাতে পারতেন। ব্যবসা ধরে ফেলতে তাই সময় লাগলো না। স্থানীয় বাজারে তার বেশ ভালোই সুনাম হলো ফলশ্রুতিতে। তারই যোগসূত্র ধরে আরব আমিরাত থেকে একদিন আসে ট্রে বানানোর বিশাল অর্ডার। সেই কাজ শেষের পর আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ সুনাম হয়ে যায় তৌহিদের।

এরপর আমেরিকার এক প্রতিষ্ঠানের সাথেও কাজ করেন তিনি। সেই প্রতিষ্ঠানে অসাধারণ কাজ করার ফলে কোম্পানিটি কিনে নেয় তৌহিদের কোম্পানি এফএম এর ৩৮ শতাংশ। এখানে বলে রাখা ভালো, 'এফএম' নামটি এসেছে তৌহিদের মা সৈয়দা ফেরদৌস বেগম ও মেয়ে তাসফিয়া রহমান মীমের নামের আদ্যক্ষর এফ ও এম থেকে। পরবর্তীতে তৌহিদের 'এফএম প্লাস্টিক'  শুধু ট্রে'তেই থেমে থাকলোনা। বানিয়েছে অনেক কিছুই। এখন তার এই প্রতিষ্ঠানটি ত্রিশ কোটি টাকার এক প্রতিষ্ঠান। তিনি এখন উদ্যোক্তাদের লিডারও। নতুন নতুন তরুণদের কর্মসংস্থান করেন তিনি। এসএমই ফাউন্ডেশনের সাধারণ পরিষদ সদস্য হিসেবেও যুক্ত আছেন তিনি।

'শূন্য' থেকে শুরু করে এখন তিনি বেশ সফল এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক

এই মানুষটার অসাধারণ সাফল্যের গল্পগাথা কিছুদিন পর পাঠ্যপুস্তকেও যোগ করা হবে। অনেক আগে থেকেই চেয়েছিলেন, তার একটি কারখানা থাকবে। সেটি হয়েছেও। নরসিংদীতে ৫৫ হাজার স্কয়ার ফুটের কারখানা আছে তৌহিদের। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, তার কারখানায় কাজ করবে অনেক মানুষ। তার কারখানায় এখন নিয়মিত কাজ করছে ২০০ কর্মী। বিস্কুটের ট্রে বানানোর কাজে এফএম প্লাস্টিক এখন এক ভরসার নাম। ২০১৮ সালের এসএমই ফাউন্ডেশনের বর্ষসেরা মাঝারি উদ্যোক্তাও হয়েছেন মোহাম্মদ গাজী তৌহিদুর রহমান। তার জীবনগল্প আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়, যে শিক্ষা অনেক প্রাচীণ; হাল না ছেড়ে স্বপ্নের সাথে লেগে থাকার শিক্ষা।

সেটিই করেছেন তিনি। সাফল্য সেভাবেই এসেছে। সাফল্য পাওয়ার সূত্রও তো এটাই! 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা