গেন্দাফুলের কাঁটাগুলো: যে কথাগুলো হয়তো আপনার ভালো লাগবে না!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আমি জানিনা কে বিনোদনকে কীভাবে নেয় অথবা বিনোদনের আসল উদ্দেশ্য কী, তবে আমার কথায় কারো তেমন কিছু যাবে আসবে না হয়তো। তবুও একটি বকবকের অবতারণা করছি। পড়ে দেখতে পারেন।
সম্প্রতি একটি গান লোকে খুব খাচ্ছে, "গেন্দাফুল" নাম। সেই গানটি আবার বাংলা লোকগান থেকে কথা-সুর ধার করে বানানো। ইদানীং এসব রকমসকমের গান খুব চলছে। সুরকারদের হয় মাথায় নতুন সুর খেলছে না, নতুবা তারা কয়েকদিন গীটার নিয়ে ঘষাঘষি করেই সুরকার বনে যাচ্ছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম ধ্রুপদের ভিত্তি না থাকলে সেই সুরকার পাঁচ বছরের মধ্যে ফুরিয়ে যায়। যেজন্য আপনার এখন সৃজিতের সিনেমায় অনুপম রায়ের গানে বিরক্তি ধরে, যেজন্য বলিউডি সিনেমা দশ বছর আগের টাটকা গানকেও জোরজবরদস্তি ধরে রিমেক করছে। আমাদের আলোচ্য গানটিও সেই ধরণের।
কেবল লোকে খাচ্ছে বলেও না, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক পরিচিতকেও দেখছি এ নিয়ে উচ্ছ্বাসে মাততে। তাই জরুরী জরুরী নিজস্ব ভাবনার এই পেশকরণ।
গানটিতে আমার আপত্তির প্রথম জায়গা এর লিরিক্সে। ভাই, অস্বীকার করার কিছু নেই, একসময় বয়ঃসন্ধিকালে "শিলা কি জওয়ানি" শুনে ও দেখে বহু কিছু করেছি। সেটাতে যে আটকা পড়ে থাকিনি, এটাই শোকর। কিন্তু কাল নানাজনের ছবিতে জ্যাকুলিনকে দেখে আমি ভাবলাম, "কিক" সিনেমার সেই মিষ্টি মেয়েটি (হ্যাংওভার-গানে) কি তবে বাঙালী কোন চরিত্রে অভিনয় করছে। কোন সিনেমা? - তারপর ক্রমে সেই গানের কাছে পৌছা। তো গানের লিরিকে বা কথায় কী পেলাম-
"Bum Tera Gotay Khaye, Kamar Pe Teri Butterfly, Body Teri Makkhan Jaise, Khane Mein Bas Tu Butter Khaye"
বাম্ মানে পিঠের দিক থেকে কোমরের অংশ, পশ্চাদ্দেশ যাকে বলে। আর "কামার" এখানে নিতম্ব বা তলপেট বুঝিয়েছে। আর আলোচ্য শরীর মাখনের মত নরম- তাও। -- এরপর বাকিগুলোতেও শরীরের অঙ্গ, চামড়া কেমন, টিকেট কাটবে না উইকেট ফেলবে এই ধরনের কথাবার্তা। এখন কথা হলো, নারীদেহের এমন উপমা কি আর কোথাও দেয় না? হ্যাঁ দেয়, অবশ্যই দেয়। কিন্তু সেজন্য উপমা, অলঙ্কার ও সৌন্দর্যের একটি সুস্থ বোধ থাকতে হয়।
কবি ভারতচন্দ্র তাঁর নায়িকার বর্ণনা দিয়েছেন এমনভাবে যে, কে বলে শরতের চাঁদ ঐ মুখের তুলনা, ওর পায়ের নখেই তো এরকম কতগুলো পড়ে আছে।
সুনীল লিখছেন, "বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ওয়েলিংটনের মোড় পর্যন্ত চলে আসি। জলের মধ্যে মানুষ ছুটতে পারেনা, কিন্তু আমার ইচ্ছে হলো ছুটে যাই। দরজা খোলার পর মনীষা যখন নিচু হয়ে ঢুকতে গেল, তখন তার ফরসা পেট আমার চোখে পড়ে, জলে ভেজা নাভি, দার্জিলিংয়ের কুয়াশায় আমি এরকম চাঁদ দেখেছিলাম।"
হুমায়ূন আজাদ লিখেছেন, "যে-গাধাটার হাত ধরে তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে/সে নাকি এখনো তোমার একটি ভয়ংকর তিলেরই খবর পায় নি।/ ওই ভিসুভিয়াস থেকে কতটা লাভা ওঠে তা তো আমিই প্রথম আবিষ্কার করেছিলাম।/ তুমি কি জানো না গাধারা কখনো অগ্নিগিরিতে চড়ে না?" (আমাকে ছেড়ে যাবার পর) -
কিংবা-
"তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,/ আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খসে প’ড়ে সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।" (আমাকে ভালবাসার পর)
এখন আপনারা বলবেন, ওও একটু সাহিত্য মেরে বললে ভাল, নাহলে চটি, নারীর অবমাননা?, হ্যাঁ, ঠিক তাই। কারণ সাহিত্য স্রেফ সাহিত্য না, আপনি শিশুকাল থেকে অজস্র শব্দ শুনে, অজস্র দৃশ্য দেখে, তার মধ্যে থেকে সবচেয়ে সুন্দরটি আপনার নারীর জন্য তুলে আনছেন। এই বোধটিই "ভেনাস"এর উন্মুক্ত স্তন আর হাইস্কুলের টয়লেটে আঁকা আপনার নগ্ন নারীদেহের চিত্রের ফারাক। এই বোধ ফ্রান্সিস কপোলার আছে বলেই তার ক্যামেরা "গডফাদার" সিনেমার এপোলনিয়ার বুককে ফুল হিসেবে তুলে ধরে, আর আপনার মননে অনুপস্থিত বলেই ক্যামেরা বাসে মেয়েদের শরীর হাতিয়ে মজা পাওয়া লোকদের মতই নায়িকার বুকে, কোমরে ঘুরে বেড়ায়।
তো লিরিক্সটি নারীদের চিরায়ত ভোগ্যদ্রব্য হিসেবে উপস্থাপন করছে, আর বরাবরের মতই অনেক নারী এটিতে অনেক মজা পেয়ে নাচছেন। তারা সম্প্রতি রায়হান নামের একটি অর্ধোন্মাদের নিজের বুক নিজে খামচে চুমো খাওয়ার দৃশ্যেও মজা পেয়েছেন। তারপর এই রায়হান যখন হাতাতে হাতাতে তার বুক খামচে ধরবে তখন অনেক তত্ত্বীয় কথাবার্তা শোনাতে আসবে। না মানে না- এটা আমিও বিশ্বাস করি। কিন্তু না যাতে একবারই বলতে হয় সেজন্য এই রায়হানের মত পুরুষতান্ত্রিক বর্জ্যকে আমরা শুরুতেই থামাচ্ছি না কেন। কীজন্য একটি গ্রুপে তার "ন্যুড দাও", "এটা দেখাও, ওটি দেখাও" শুনতে হচ্ছে কাউকে।
তারপর আসে চরিত্রের পোর্ট্রেটিংয়ের ব্যাপারটা। আমি সিনেমা দিয়ে সাধারণত কোনকিছু ব্যাখ্যা করতে ভালবাসি। এটিতেও তাই একটু সিনেমালাপ আনছি।
আপনি নিজের বাঙালী মন দিয়ে নিজেকে যেমন ভাবছেন, অবাঙালীর মন- চোখ দিয়ে নিজেকে দেখতে বসলে ভয়ানক ভিড়মিই খাবেন। নিজেই দেখুন না বাঙালির সব সাহসী গোয়েন্দা, গুপ্তচর বিদেশের কাঠামো থেকে ধার করা। আগ্রাসী নায়ক হাঁটে যে দক্ষিণী সিনেমা থেকে গল্পটা ধার করা, সেই সিনেমার নায়কের অনুকরণে। মৌলিক সাহিত্যে বাঙালী চাকরির দুশ্চিন্তায় থাকা, টিউশনি করানো, নম্র ভদ্র ম্যাড়মেড়ে একটি চরিত্র (সুনীলের তরুণ সময়ের উপন্যাস বাদে)। একটু খেয়াল করে বলিউডের এই সিনেমাগুলো আবার দেখুন তো, "ভিকি ডোনার".... সেখানে বলছে, বাঙালী ছেলে ফট্টু গোছের। আবার ভিকির মা তার ছেলের বাঙালী স্ত্রীকে বলছে, "ডমিনেটিং", তাকে বোঝানো হচ্ছে যে "বাঙালী ছেলে গুড ইন বেড টু!" "পিকু"তেই দেখুন, বাঙালী পিতা তার বাঙালী মেয়ের যৌনজীবন নিয়ে বলে অন্য ছেলেদের নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করছেন।
"বরফি"তে বাঙালী নারী তার বাঙালী স্বামীকে ছেড়ে নেপালী প্রেমিকেই জীবনের সব খুঁজে। আরেক বাঙালী পিতা তার মানসিক সমস্যাগ্রস্ত কন্যাকে সম্পত্তির লোভে অপহরণ করাচ্ছে। আপনি বলবেন, তাহলে তো তামিল সিনেমায় যে খলনায়ক দেখায়, তারাওতো তামিলই হয়। হ্যাঁ, কিন্তু নায়কটিও সাথে তামিল যে বাচ্চু। জাতিগত কনট্রাস্ট তো তৈরি হচ্ছে না আর বারবার একই জিনিস যে দেখানো হচ্ছে তার ফল একটাই- স্টেরিওটাইপ তৈরি হওয়া। বাঙালী পুরুষ একরকম, বাঙালী নারী আরেকরকম।
মজার ব্যাপার হলো, তিনটি সিনেমার পরিচালকই বাঙালী পুরুষ। যেখানে অন্য জাতিরা "পাঞ্জাব কা শের" টাইপ সিনেমা বানাতে ব্যস্ত, সেখানে আঁতেল, উদার সাজতে চাওয়া মানে ঐ পুরুষতান্ত্রিক ধারণারই প্রতিচ্ছবি - নারীকে ভেট দেয়া। অবাঙালী সমাজের কাছে বাঙালী নারীকে শরীরসর্বস্ব করা।
শুধু বলিউড কেন, দক্ষিণী সিনেমায়ও কম কী। তেলেগু ভাষার "গোদাচারি"তে বাঙালী পুরুষ সন্ত্রাসবাদে মদদদাতা, "পারি পারি লেচে মানুসু"তেও ঐ ভ্যাবলা বাঙালী পুরুষ ছেড়ে তেলেগু যুবকে মন মজা। মালায়লাম সিনেমা "ওয়েলকাম টু সেন্ট্রাল জেল"-এ শুনি, "এসব বাঙালী শ্রমিককে কে এনেছে, এরা দুদিন পরেই আমাদের মেয়ের হাত ধরে বলবে - আমি তুমাকে বালুবাশি!", এছাড়া "আঙ্গামালি ডায়েরিজ" ধরনের সিনেমাতেও আছে এ ধরণের সংলাপ। কিন্তু বাঙালী নারীর ব্যাপারে- আহা মাখন, মাখন।
গায়ক বা ছড়াকার বাদশা পাঞ্জাব প্রদেশের লোক। সেখানেও বাঙালী নারী সম্বন্ধে ধারণা একই। সেই আগুনে উস্কে দিতে সংযোজিত হলো তার উৎকট লিরিকের পাশাপাশি শরীর প্রদর্শনের স্থূল এই ভিডিওটি। বলিউড ও বলিউড প্রভাবিত বাংলাদেশী সিনেমা আমাদের মনে একটি ধারণা গড়ে দিয়েছে যে কোন নারীকে পছন্দ হলে তাকে স্টক করতে হবে। তার পিছনে পিছনে ঘুরতে হবে। সে বিরক্ত হওয়া মানে বিরক্ত নয়, অনুরাগ বৃদ্ধি পাওয়া। তারপর একদিন টুপ করে গা ঢাকা দিলে আমাকে দেখতে না পেয়ে তার প্রেম প্রকাশ পাবে। এই ধারণাটি যে গ্রামেগঞ্জে নারীদের যৌন হয়রানির (ইভটিজিং) বড় নিয়ামক- তা কি আপনি বিশ্বাস করেন? না করলে থাক, কিন্তু আমার ধারণা শিগগিরই সারা পৃথিবীতে যেখানে বাঙালী ও অন্যান্য ভারতীয় জাতির সমাবেশ আছে এবং হিন্দি গানের সহজলভ্যতা আছে, সেখানে বাঙালী নারীরা একটি চাপ, অন্যরকম দৃষ্টির সম্মুখীন হবেনই, এই গানটির জন্যই।
চলচ্চিত্রে, গানে নারীকে এভাবে উপস্থাপনকে প্রশ্রয় দেবেন না। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। কথা বলুন। কারণ জ্যাকুলিনকে দেখে জাগা শরীরী উত্তেজনা জ্যাকুলিনকে ছুঁবে না, ছুঁবে আপনার প্রিয়তমা, সন্তান, বোন কি মা-কে। বাসে, হাটে-ঘাটে, মাঠে। সেই নোংরা হাত মুচড়ে দেবার মত শক্তি তো জাগাতেই হবে, তারও আগে এই ভোগবাদী জিভের লকলকানি তো আটকান।
ধন্যবাদ, বকবক শেষ হলো।
[তথ্য সহায়তা: স্মৃতিলেখা'দি]