পৃথিবীটা যখন বড্ড একপেশে হয়ে যাচ্ছিলো, যখন পৃথিবীটা জাতীয়তাবাদীদের হাতে চলে যাচ্ছিলো, যখন পৃথিবীটার মানুষে মানুষে বিদ্বেষ- জাতে জাতে রেষারেষি দেখতে বিবমিষা জাগতো, ইন্টারনেটের যুগে মানুষ যখন ভিকটিমেরই দোষ ত্রুটি খুঁজে বের করে ভিকটিমাইজ করতো, তখন প্রায়ান্ধকার পৃথিবীতে এক চিলতে আলো নিয়ে এলো আমেরিকার সাম্প্রতিক এই আন্দোলন।

শুভ কামাল: আমেরিকায় অসংখ্য এমন ছোটবড় আন্দোলন কিংবা রায়ট হয়েছে প্রতি বছরে দুই তিনবার করে, কালো ভাইদের অন্যায় মৃত্যুর প্রতিবাদে, কিংবা বৈষম্যের বিরুদ্ধে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে নিপীড়িত এই কালো ভাইদের কোনো ন্যায্য দাবিই আজপর্যন্ত এমন রায়ট ছাড়া অর্জিত হয়নি। শান্তিপ্রিয় মার্টিন লুথার কিংও বলেছিলেন "রায়ট হচ্ছে যাদের কথা শোনা হয়না তাদের ভাষা"। জন হোপ বলেছেন- "একটা রায়ট ইঙ্গিত দেয় এখন পরিবর্তন প্রয়োজন, দূর্ভাগ্যবশত- নতুন একটা একশন (রায়ট) পুরনো অনেক ব্যথার রিয়্যাকশন"। 

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি  

আমেরিকায় পুলিশ সংক্রান্ত ঘটনায় প্রায়ই কালো ভাই মারা যায়, এর কয়েকটা থেকে আন্দোলন হয়, মাঝারি আকারের রায়ট হয় বছরে দুই একবার। আন্দোলনের এক পর্যায়ে সোশ্যাল মিডিয়া দুই ভাগ হয়ে যায়, কেউ কেউ নিহত ব্যক্তির উপরেই দোষ চাপিয়ে দেয়- এরেস্ট হওয়ার সময় আইন অমান্য করে বাধা দিচ্ছিলো কেন সেটা বলে। মূলত দেখা যায় কালা ভাইরাই সেসবক্ষেত্রে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে কয়েকদিন, হয়তো হাতে গোণা দুই চারজন অন্য জাতির আন্দোলনকারী দেখা যায়, এক সময় দাঙ্গা থেকে লুটপাট হয় তখন লোকে কালো ভাইদের উপরেই দোষ চাপিয়ে নিষ্কৃতি পেয়ে যায়। 

কিন্তু এবারের আন্দোলন একেবারেই অভূতপূর্ব। কালো ভাইয়ের পুলিশি মৃত্যুবিরোধী এমন আন্দোলন হয়তো আমেরিকানরা কখনোই দেখেনি। আগের সব রায়টের সাথে সাম্প্রতিক এই রায়টের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, আগের আন্দোলন কিংবা রায়ট মূলত কালা ভাইয়েরাই করতো, আর এবারে তাদের সাথে স্বতঃস্ফুর্তভাবে যোগ দিয়েছে প্রায় সমসংখ্যক শাদা ভাই সহ সকল জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বিশাল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। হয়তো চোখের সামনে ভিডিওতে একটা মানুষকে মরতে দেখে একটা মানুষও প্রকাশ্যে অপরাধীর পক্ষ নিতে সাহস পায়নি, কারো মনে বর্ণবাদিতা থাকলেও তা মনের ভেতর চেপে রেখে বাসায় বসে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করছে। 

হয়তো অন্য জাতির মানুষ মরেছে, কিন্তু কত আর তাদের এমন মৃত্যু মানুষ হিসেবে সামনে দাঁড়িয়ে দেখা যায়? গত একমাসে আরেক কালো ভাই আহমেদ আরবারি মারা গেছে শুধুমাত্র তার গায়ের রঙ কালো হওয়ার অপরাধে, সেন্ট্রাল পার্কে আরেক মহিলা ভাইরাল হলো কালো ভাইয়ের বিরুদ্ধে পুলিশ ডেকে, তার অপরাধ সে মহিলাকে বলেছিল তার কুকুরটাকে বেঁধে রাখতে। সব মিলিয়ে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর যা হলো তা হচ্ছে ক্ষোভের বিস্ফোরণ!

এবারের আন্দোলনটা হচ্ছে ক্ষোভের বিস্ফোরণ 

কেনই বা আন্দোলন হবে না, তাদের মেরে টেরে লোকে পার পেয়ে যায় আন্দোলন না হলে। ফ্রেডি গ্রে মারা যাওয়ার পর তারা অনেক প্রটেস্ট করছিলো শান্তিপূর্ণভাবে, কেউ পাত্তাই দিচ্ছিলো না, পরে দুই তিনটা পুলিশের গাড়ি পুড়ানোর পরে সেই আন্দোলনও আলোতে আসলো। এইরকম অসংখ্য ঘটনা আছে ইতিহাস জুড়ে। এমনই অনেক আন্দোলনের পর আমেরিকায় ধাপে ধাপে পুলিশ রিফর্ম হয়েছে। 

জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু অসংখ্য মানুষের চোখ খুলে দিয়েছে। আগে বলতো এরেস্ট করার সময় বাধা দিয়েছে তাই পুলিশ গুলি করেছে, এবারে সবাই দেখলো একটা মানুষ লাইভ ক্যামেরায় গলায় পাড়া দিয়ে একটা হাতকড়া পড়া মানুষকে মেরে ফেলেছে, এই লোকটা শুধু শাদা না, এশিয়ান হলেও তাকে এভাবে মরতে হতো না। হোক কালো, তবুও মানুষ তো! মানুষ তো কুকুরকে এভাবে মরতে দেখলেও প্রতিবাদ করবে! তাই মানুষ জাতি ধর্ম ভুলে শুধু তার মানুষ পরিচয়কে সামনে রেখে হাতে হাত রেখে রুখে দাঁড়িয়ে গেলো! 

শুধু কালোরাই নয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন   

যখন এমন শাদা কালো নানান বর্ণের মানুষকে শুরুর দিকে প্রতিবাদ করতে দেখছিলাম, তখন চোখের পানি আটকে রাখতে পারি নাই। এক জাত যখন ভিন্ন জাতের মানুষের প্রতি ভালবাসা দেখায়, তা দেখার চেয়ে জগতের সুন্দর কোনো দৃশ্য আমার জানা নাই। এই পৃথিবীর উপর আশা ফিরে পেলাম আবারও। 

যারা রাস্তায় আন্দোলন করেছেন, তারা জানেন আন্দোলন নেশার মতো। শাহবাগের কথাই ভাবুন, কিছুদিন আমাদের রক্তে কি প্রাণচাঞ্চল্য খেলে গিয়েছিলো! আমার ধারণা এ যুগের আমেরিকান শাদা ভাইয়েরাও এই চাঞ্চল্যের মজা পেয়ে গিয়েছে, আমি টুইটারে গিয়ে অসংখ্য ভিডিও দেখি, তাদের চোখেমুখে আমাদের সেই শাহবাগী তেজ। অনেকেরই হয়ত জীবনের প্রথম আন্দোলন। অন্য জাতের মানুষ বাঁচানোর মতো মহান ব্রত নিয়ে তারা যে আন্দোলন করছে তার নেশা ভয়াবহ। ভেবেছিলাম এই নেশা দুই একদিনে কেটে যাবে, কিন্তু না, এ দেখি থামছেই না! 

এই আন্দোলনে এত শাদা ভাই অংশগ্রহণ করার আরও কী কারণ থাকতে পারে ভাবলাম। আসলে মিনেসোটা খুব ভাল মানুষদের এলাকা, শিক্ষিত লোকদের এলাকা, ব্লু স্টেট। তারা এই অন্যায় দেখে যে কোনো শিক্ষিত লোকের মতো আন্তরিকভাবে রাস্তায় নেমে সাড়া দিয়েছে, তাদেরকে মানুষ সারা দেশ থেকে উৎসাহ দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাদের দেখে অন্যান্য স্টেটেও এত সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে থাকতে পারে। 

সাধারণত কালা ভাইদের রায়ট নির্দিষ্ট এক এলাকায় হয়, কিন্তু আমার ধারণা শাদা ভাইদের এত বিশাল সংখ্যায় অংশগ্রহণ থাকায়ই এই রায়ট ছড়িয়ে গেল সবখানে! আমার দৃষ্টিতে এই আন্দোলন এত বিস্তৃতভাবে ছড়ানোর আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে লকডাউন। মানুষের পরের দিন সকালে গিয়ে অফিস ধরতে হবে সেই চিন্তা নাই, তাই তারা যথেষ্ট সময় আন্দোলনে ব্যয় করতে পারছে। 

আন্দোলন হয়তো আগেই থেমে যেতো যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো লিডারশিপ ক্যাপাসিটি থাকতো। সে উলটাপালটা টুইট করে আন্দোলন উস্কে দিয়েছে। এই লেভেলের আন্দোলন হুমকি দিয়ে থামানো যায় না। কোনো স্টেটের গভর্ণরই তার কথামত ফোর্স করে আন্দোলন থামাতে চেষ্টা করেনি প্রথম তিন চার দিন।

যেখানে ঘটনা ঘটেছে সেই মিনেসোটায় তো মানুষ পুলিশের কোনোপ্রকার বাধা ছাড়াই সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে, পুলিশের প্রেসিঙ্কট তথা থানা পোড়ানোর সময়ে একজন পুলিশকেও সেখানে উপস্থিত থাকতেই দেখা যায়নি। উলটা হুমকি দেয়ায় লোকজন ট্রাম্পের বাসস্থান তথা হোয়াইট হাউসে গিয়েই আক্রমণ করেছে, ট্রাম্প গিয়ে লুকিয়েছে বাঙ্কারে। 

অথচ এই সময় নিয়ম হচ্ছে কমিউনিটির নেতাদের সাথে গিয়ে কথা বলা, তাদেরকে কোনো প্রকার আশ্বাস দিয়ে ঠান্ডা করা। এই জায়গায় শেখ হাসিনা থাকলে আন্দোলন দুই দিনের বেশী যেতোই না! অন্য প্রেসিডেন্ট হলে এই সময়ে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতো, ট্রাম্পের উপদেষ্টারা তাকে ভাষণ দিতে বলতে সাহস পাচ্ছে না, কী থেকে কী বলবে আর পরিস্থিতি আরো ঘোলা হবে।

আজকে ট্রাম্প হুমকি দিয়েছে সেনাবাহিনী নামাবে। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমেরিকার মানুষ প্রেসিডেন্টের শাসানিতে অভ্যস্থ না। এই রকম হুমকি আমেরিকান চরিত্রবিরোধী। আমি যদি আগের মতো রাস্তায় নামার মেন্টালিটিতে থাকতাম, তাহলে এই ঘোষণা শুনে বাসায় ফিরে যাওয়ার হলেও যেতাম না! আমার ধারণা ঠিক তাই হতে যাচ্ছে, এইমাত্র চেক করলাম আজকেও বিভিন্ন সিটিতে ভাংচুর জ্বালাও পোড়াও চলছে। কোনো আন্দোলনই এত তেজে এত দিন চলার কথা না, বার বার আগুনে ঘি ঢালছে ট্রাম্প নিজেই। 

হুমকি-ধামকি দিয়ে ট্রাম্প আগুনে ঘি ঢালছে

সে বিকালে হোয়াইট হাউসের সামনে এসে বড় বড় কথা বলছিলো, তখনই হোয়াইট হাউসের আশেপাশেই কোথাও হয়তো সংঘর্ষ হলো আর আওয়াজ হলো, সে দলবল নিয়ে দ্রুত আবার ঘরের দিকে চলে গেল। ট্রাম্প নরম হলেই সব শেষ হয়ে যেত, সে তার স্বভাবসুলভ ঘাউড়ামি করছে! এখন মানুষ তার এই এটিচ্যুডে কীভাবে রেসপন্স করে সেটাই দেখার বিষয়! এখন ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে হয় ট্রাম্প জিতবে, নইলে আমেরিকার মানুষ জিতবে! টুইটারে একটা হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং হচ্ছিলো বিকালে- "ট্রাম্প অর আমেরিকা"?

এই আন্দোলন থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যে প্রাপ্তি, মানুষ নিপীড়িতের পক্ষে বলছে, আমেরিকার পাশাপাশি ইউরোপের নানা দেশে আমেরিকান এম্বেসীর সামনে মানুষজন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিবাদ করছে। মানুষ বলছে কালো ভাইদের প্রতি এমন সুপ্ত বিদ্বেষের ইতি হওয়া উচিত। পৃথিবীর অনেক কিছুর সূচনাই আমেরিকায় হয়। এই প্রায়ান্ধ পৃথিবীকে আমেরিকা আবার দেখিয়ে দিলো কীভাবে অন্য জাতের মানুষের জন্য জাগতে হয়, দেখিয়ে দিলো ভিকটিমের দোষ না খোঁজাটা এ যুগেও সম্ভব। এই ট্রাম্প-মোদী-বরিস জনসনের পৃথিবীতে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে আশার আলো জাগায়।

একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন লুটপাটের ব্যাপারে। মানুষ সাধারণত লুটপাট করে বড় কর্পোরেশনের চেইন স্টোরগুলোতে, এরা মাল্টি বিলিয়ন ডলারের কোম্পানী, এবং এদের সবার ইন্স্যুরেন্স থাকে, তারা টাকা ইন্সুরেন্স থেকে ফেরত পেয়ে যাবে। যদিও অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইন্সুরেন্স না থাকলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এবং দোকানপাট ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় অনেকের চাকরি চলে যাবে। লুটপাট আর অগ্নিসংযোগ খারাপ। তবে আফসোসের ব্যাপার হলো আমেরিকার স্বাধীনতার সংগ্রামও শুরু হয়েছিলো ছোট ছোট রায়টের মাধ্যমেই। রায়ট ছাড়া আমেরিকায় কোনো অধিকারই অর্জন করা যায়নি। আর একজন আন্দোলনকারী বলেছিলো- কোনোকিছু সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য তাকে আগে ভাংতে হয়!

বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা