জার্মানির গীর্জা বনাম বাংলাদেশের মসজিদ: আমাদের মানসিকতা কবে উন্নত হবে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এদেশের 'ফেসবুক মুমিন'রা জার্মানীর গীর্জায় জুম্মার নামাজের খবর শুনলে 'সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ!' রব তুলবে, অথচ নিজের দেশে পূজার সময়ে মূর্তি ভাঙবে, সেটাকে আবার জাস্টিফাই করবে অনলাইনে...
ফেসবুকের নিউজফিডজুড়ে আজ জার্মান গির্জার স্তুতি, বার্লিনে মুসলিমরা যাতে ঈদের সময় নামাজ আদায় করতে পারেন তার জন্য স্থানীয় একটি গির্জা তাদের দরোজা খুলে দিয়েছে। ঈদের জামাত সেখানেই আদায় করবেন মুসল্লিরা, কারণ মসজিদে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। এক শ্রেণীর মানুষজনকে দেখলাম প্রচুর উল্লাস করছে, প্রশংসা করে ভাসিয়ে ফেলছে।
অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এরা তো সেই মানুষগুলোই, যারা আনিসুজ্জামান স্যার মারা যাওয়ার পরে কমেন্টবক্সে এসে নোংরামি করে, যারা হিন্দুদের 'মালাউন' গালি দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দিতে চায়, শহীদ আফ্রিদী মুশফিকের ব্যাট কিনলে যাদের অর্গাজম হয়ে যায়, বাংলাদেশী এক তরুণী পাকিস্তানী তরুণকে বিয়ে করার খবরের নিচে যারা জাফর ইকবাল স্যারকে গালাগাল করে যায়!
এদের কাণ্ডকীর্তি দেখে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগলো, আজ যদি বাংলাদেশে হিন্দু বা খ্রিস্টানদের প্রার্থনার জন্যে কোন মসজিদ ছেড়ে দেয়ার কথা উঠতো- তাহলে এরাই তো জিহাদ ঘোষণা করতো, কেউ কেউ হয়তো লাঠিসোটা নিয়ে ঝাঁপিয়েও পড়তো 'ইসলাম রক্ষা'র নাম করে, পেছন থেকে ইন্ধন দিতো ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করা কিছু লোকজন। গীর্জায় নামাজের ব্যাপারটা এদের পক্ষে গেছে, একারণে তারা উল্লাস করছে। আজ যদি মসজিদে পূজা পাঠের কথা উঠতো, তাহলে এরাই তাণ্ডব চালাতে রাস্তায় নেমে আসতো।
বার্লিনের ওই গীর্জার কর্তৃপক্ষ চমৎকার উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। জার্মানিতে ধর্মীয় উপাসনালগুলো গত ৪ঠা মে থেকে খুলে দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে নিয়ম জুড়ে দেয়া হয়েছে, যারা প্রার্থনা করবেন তাদের দেড় মিটার বা ৫ ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ফলে যেখানে আগে পাঁচজন মুসল্লী নামাজ পড়তে পারতেন, সেখানে এখন নামাজ আদায় করতে হবে মাত্র একজনকে!
নিউকোলন এলাকার দার আস-সালাম মসজিদে গত শুক্রবারের জুম্মার নামাজে মাত্র হাতে গোণা কয়েকজন নামাজীর জায়গা হয়েছিল। ঈদের নামাজে আরও বেশি মুসল্লীর সমাগম হবে, তাদের জায়গা দেয়া হবে কোথায়- এই ভেবে যখন হিমশিম খাচ্ছে মসজিদ কর্তৃপক্ষ, তখন সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলো ক্রুজবার্গ এর মার্থা লুথেরান চার্চ। তারা বললো, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ চাইলে তাদের গির্জায় জুমার নামাজ আদায় করতে পারবেন।
সেভাবেই চার্চে নামাজের জন্যে জায়গা প্রস্তুত করা হয়েছিল। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা চার্চে এলে বেঞ্চে বসে প্রার্থনা করেন, কিন্ত মুসলমানরা নামাজ পড়েন দাঁড়িয়ে। তাই গীর্জার স্বেচ্ছাসেবকরা নিজেদের উদ্যোগেই নামাজের সময় হবার আগে বেঞ্চগুলো সরিয়েছেন, পরিস্কার কাপড় বিছিয়ে দিয়েছেন মেঝেতে। যদিও মুসল্লীদের বেশিরভাগই নিজস্ব জায়নামাজ নিয়ে এসেছিলেন। নামাজ শেষ হবার পরে দুই ধর্মের লোকেরা মিলে বেঞ্চগুলো আবার গীর্জার প্রার্থনা কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, জায়গাটাকে ফিরিয়ে এনেছেন আগের রূপে।
শুরুতে গোটা ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লেগেছে মুসল্লীদের কাছে। গীর্জায় কখনও নামাজ পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল না কারোরই। তার ওপরে গীর্জার দেয়ালে ছবি টানানো, যীশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি শোভা পাচ্ছে সামনে- সবকিছু মিলিয়ে একটা নতুনত্বই উপহার পেয়েছে নামাজ পড়তে আসা মুসল্লীরা। তবে তারা সেসব অগ্রাহ্য করেছেন, মেনে নিয়েছেন যে মসজিদে না হলেও, ঈশ্বরেরই আরেক ঘরে দাঁড়িয়ে তারা প্রার্থনা করছেন। আর আল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন, পুরো পৃথিবীই তার ইবাদতের জায়গা।
করোনাভাইরাসের কারণে গোটা বিশ্বই স্বাভাবিক নেই এখন, এসব নতুনত্বকে তাই মেনে নিতে হবে- এমনটাই ভাবছেন মুসল্লীরা। তারা বরং আপ্লুত হয়েছেন গীর্জা কর্তৃপক্ষের এমন মহানুভবতায়। স্থানীয় মসজিদের ঈমাম বলছিলেন, এই মহামারী আমাদের মধ্যেকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাড়িয়েছে, ধর্মের ভেদাভেদকে দূর করে দিয়েছে। গীর্জার যাজক মনিকা ম্যাথিয়াসের কণ্ঠেও শোনা গেছে একই সুর, তিনি বলেছেন, "একে অপরের প্রতি এই শ্রদ্ধাবোধটা খুবই সুন্দর, এটা বজায় থাকুক চিরকাল!"
দুই ধর্মের দুই উপাসকের কথা শুনে আমি বাংলাদেশের অবস্থাটা কল্পনা করার চেষ্টা করি। এখানে অনেক জায়গায় অন্য ধর্মের মানুষ তো দূরের কথা, অসহায় মুসলমানের আশ্রয়ও মেলে না মসজিদে, নিজের চোখে দেখা নজির। মসজিদকে বলা হয় আল্লাহ'র ঘর, অথচ সেই ঘরে কে আশ্রয় পাবে, কাকে বিপদের দিনে একটা রাত থাকতে দেয়া হবে- এসব ঠিক করে দেয় মসজিদ কমিটির লোকজন! আল্লাহর রহিম-রহিমান নাম দুটোর মহিমা তারা ভুলে যায়, বিপদগ্রস্ত বান্দাকে তারা স্রষ্টার ঘরের সামনে থেকে দূর দূর করে তাড়ায়- নিজের চোখে দেখেছি।
কখনও হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় আচার পালনের জন্যে কোন মসজিদ বা মসজিদের প্রাঙ্গন উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে- এমন নজির বাংলাদেশে অন্তত দেখবেন না কখনও। কারণ এদেশে ধার্মিকের চেয়ে ধর্মান্ধের সংখ্যা বহু গুণে বেশি। কেউ যদি অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিপদের সময় সাহস করে এমন উদ্যোগ নেয়ও- পরদিনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধে যাবে, ধর্ম অবমাননার দায়ে তাকে ধর্মদ্রোহী, নাস্তিক ইত্যাদি ঘোষণা করা হবে, তার কল্লা কেটে নেয়ার মিশনে ঝাঁপিয়ে পড়বে অনেকে, অনলাইনে শুরু হবে নোংরামি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো।
এদেশের 'ফেসবুক মুমিন'রা তাই জার্মানীর গীর্জায় জুম্মার নামাজের খবর শুনলে 'সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ!' রব তুলবে, আর নিজের দেশে পূজার সময়ে মূর্তি ভাঙবে, সেটাকে জাস্টিফাই করবে অনলাইনে। জার্মানীর মতো এমন চমৎকার কোন উদ্যোগ নেয়া হলে খঞ্জর নিয়ে রাজপথে নেমে সেটাকে প্রতিহিত করবে যেকোন মূল্যে, এটাই বড় কষ্টের।