বউয়ের জন্য ঘর ভর্তি বাচ্চা আর ব্যাংক ব্যালেন্স রেখে যাওয়াকে ভালোবাসা বলে না।
রমজান আলী: আপনার স্ত্রী কি পড়াশোনা করে? নাকি ‘বিয়ে হয়ে গেছে, এখন আর পড়ে কী হবে’, এই মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছেন? নাকি আপনি তাকে নিষেধ করেছেন, তোমার আর পড়াশোনার দরকার নেই। আমি টাকা কামাবো, তুমি ঘর সামালাবা। নাকি পরিবারের মুরুব্বি বা আশপাশের মানুষের মুখের কথা, মেয়ে মানুষের এত পড়ালেখার দরকার কী? যতই পড়ালেখা করুক, ঘুরে ফিরে চুলার দুয়ারে ঠিকই আসতে হবে, এমন দর্শনতত্ত্বে আপনি সহমত ভাই বলে সায় দিয়ে ফেলেছেন?
ধরুন, সংসারে আপনি এক বাচ্চার বাপ। আপনি সারাদিন খাটেন, রাতে বাসায় গিয়ে এসএসসি পাশ করা বউয়ের হাতের রান্না খান। রান্না ভালো হলে প্রশংসা করেন, খারাপ হলে কিছু বলেন না। বউকে ভালোবাসেন আপনি, তাই তাকে খারাপ কথা বলতে ইচ্ছে করে না। রান্না ভালো না হলেও হাসিমুখে ভালো হয়েছে বলে প্রশংসা করেন। খাওয়া শেষে জামাই বউ দু’জনে মিলে এক বছর বয়সী বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকেন। স্বপ্ন আঁকতে আঁকতে আপনারা পরিকল্পনা করেন, এই বাচ্চাটির তৃতীয় জন্মদিনের কাছাকাছি সময়ে আপনারা তাকে একটি ভাই/বোন উপহার দিবেন। সুখ উপচে উপচে পড়ে আপনাদের দু’জনের মনের গামলায়। আহা! বড়ই সুখের সংসার আপনার!
একদিন এক সন্ধ্যায় আপনি কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছেন। এমন সময় একটা ট্রাক এসে আপনাকে ডলা দিয়ে চলে গেল। বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে আজকাল অহরহ ডলাডলির ঘটনা ঘটছে। আপনি কি গ্যারান্টি দিতে পারেন, একদিন আপনার মগজের ডালগুলো যে রাস্তায় ছড়িয়ে থাকবে না?
ফিরে যাই আবার। ট্রাক আপনাকে ডলা দেয়ার পর আপনি চিরকালের জন্য পংগু হয়ে গেলেন। আপনার আর কাজ করার ক্ষমতা রইলো না। আপনার বউয়ের হাতে আড়াই বছরের ছানা, পেটে আছে পাঁচ মাসের একটা পোনা। জমানো টাকাগুলো আপনার চিকিৎসার পেছনে শেষ হয়ে গেছে। এখন এর ওর কাছ থেকে ঋণ করতে হয়েছে। আপনি যদি একেবারে মরে যেতেন, তাহলে আপনার এই বউকে তার গার্ডিয়ানরা আরেকটা বিয়ে শাদী দেয়ার চেষ্টা করতো। কিন্তু আপনি বেঁচে থেকেই ঝামেলা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। এরপর সেই পোনাও একদিন ছানা হয়ে এল।
এবার?
এদের খাওয়াবে কে? আপনাকে খাওয়াবে কে? আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব অবশ্যই সাহায্য সহযোগিতা করে। কিন্তু সারাজীবন কে করবে? আপনার এসএসসি পাশ বউটি এবার মুখ খোলে। “আমি চাকরি করবো।” আপনি বাঁধা দিয়ে ওঠেন, না! না! তা কী করে হয়! বউ রক্তচোখে আপনার দিকে তাকিয়ে বলে, তাহলে বাচ্চাগুলোকে এতিমখানায় বা কোন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে দিয়ে দিই। আমি ফ্যানের সাথে দড়ি বাঁধি, তোমার ওই হুইল চেয়ারে আমার পা রাখার জায়গা করে দিবা, আমি ওয়ান টু থ্রি বললে, তুমি হুইল চেয়ার নিয়ে তিন হাত সামনে চলে যাবা।
এরপর আপনার স্ত্রী সংসারের হাল ধরেন। তিনি যে কোন একটি কাজে ঢুকতে বাধ্য হন।
এবার আপনি বলুন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, সার্টিফিকেট না থাকলে ভালো বেতনে কোথাও চাকুরি কি আদৌ পাওয়া সম্ভব? এইচএসসি পাশ করা একজন মানুষের সর্বোচ্চ বেতন ১৫ হাজারের বেশি হয় না। তাও শুরুতে থাকে আট-নয় হাজার। দেশে আজকাল এতে কী হয়?
বিয়ের পর, আপনার স্ত্রী বাইরে কাজ করবে কি করবে না, সেটা একান্তই আপনাদের দু’জনের ব্যাপার। তবে তার পড়ালেখাটা বন্ধ করবেন না। সে যতদূর পড়তে চায়, তাকে পড়ান। সে যদি পড়তে নাও চায়, তাহলে তাকে কানে ধরে পড়ান। পড়ালেখার কোন বিকল্প নেই। তাকে পড়ালেখার প্রতি উৎসাহ দিন। তার এই শিক্ষা আর সার্টিফিকেট একদিন তারই সবচেয়ে বেশি কাজে লাগবে। তাকে ঠিক ততটুকু পর্যন্ত পড়ালেখা করে যেতে বলুন, যতটুকু পড়লে একজন নারীকে সমাজে মাথা নিচু করে চলতে হয় না।
বউয়ের জন্য ঘর ভর্তি বাচ্চা আর ব্যাংক ব্যালেন্স রেখে যাওয়াকে ভালোবাসা বলে না। বসে বসে খেতে থাকলে খুব অল্প দিনেই এক ভালোবাসা আরেক ভালোবাসাকে খেয়ে শেষ করে ফেলবে। তাকে তার নিজের জন্য আর সন্তানদের জন্য আত্মবিশ্বাসের সাথে তৈরি হতে বলুন। আর তার এই তৈরি হবার গল্পে আপনি হোন তার সবচেয়ে বড় সাহস।
আরও পড়ুন-