এতদিন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের আক্রমনে মানুষের প্রধান করণীয় ছিল এই ভাইরাস থেকে পালিয়ে বেড়ানো, এখন সময় হয়েছে এই ভাইরাসকে মুখোমুখি আক্রমন করার।

গত ২৯ এপ্রিল আমেরিকান ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান জিলিয়াড (Gilead Sciences, Inc.) করোনা ভাইরাসজনিত রোগের চিকিৎসায় তাদের আবিষ্কৃত ওষুধ Remdesivir এর ফেজ-৩ এর গবেষনা শেষে পজিটিভ রিপোর্ট প্রকাশ করে এবং এর দুই দিনের মধ্যেই আমেরিকান ওষুধ নিয়ন্ত্রন সংস্থা FDA (Food & Drug Administration) গতকাল এই ওষুধটিকে জরুরী প্রয়োজনে করোনার চিকিৎসায় ব্যবহারের অনুমোদন প্রদান করে।

তবে আপাতত এই ওষুধটি বাজারজাত হচ্ছে না, (এর কারণ ব্যাখ্যা করবো কিছু পরে) হাসপাতালে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে শুধুমাত্র ক্রিটিক্যাল পেশেন্টদের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার করা হবে। এই ওষুধটি প্রয়োগ করা হবে ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশনের (সরাসরি শিরায় প্রয়োগের) মাধ্যমে, যার ডোজ এবং সময়কাল ডাক্তারদের নিয়ন্ত্রনে থাকবে। আমেরিকান হাসপাতালগুলোতে আগামী দুই এক দিনের মধ্যেই এই ওষুধ সরবরাহ করা হবে।

ওষুধটি জিলিয়াড ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান থেকে আবিষ্কৃত

Remdesivir এর বিস্তারিত 

Remdesivir ওষুধটি এখনো ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে আছে, এটি আবিস্কার করেছেন জিলিয়াড সায়েন্স এর বিজ্ঞানী Dr. Tomas Cihlar । এই ওষুধটি আসলে আবিস্কার করা হয়েছিল ইবোলা ভাইরাসজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য, কিন্তু পরবর্তীতে এই ওষুধের অন্য বেশ কয়েকটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা দেখা যায়। ফলে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের শুরু থেকেই জিলিয়াডের বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসটিকে করোনার বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর চেষ্টা শুরু করেন, এবং নানাবিধ ট্রায়াল এবং ডেভেলপমেন্টের পর এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয় গত ফেব্রুয়ারী মাস থেকে। বিভিন্ন ফেইজে এই ট্রায়াল শেষে এটি FDA কর্তৃক জরুরী অনুমোদন পায় পহেলা মে ২০২০ তারিখে।  

ফেজ-৩ ট্রায়াল কী?

ওষুধ ডেভেলপমেন্টের কিছু প্রক্রিয়া আছে, এগুলোকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমভাগ হচ্ছে ওষুধ আবিস্কার, দ্বিতীয় ভাগ হচ্ছে প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল- এই ট্রায়ালে বিভিন্ন প্রানীর উপর ওষুধ প্রয়োগ করে এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। তৃতীয় ভাগে হচ্ছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, এই ট্রায়ালে মানুষের উপর ওষুধ প্রয়োগ করে এর ফলাফল বের করা হয়।

ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল আবার চারটি ফেইজে ভাগ করা- প্রথম ভাগে সুস্থ মানুষের উপর প্রয়োগ করে এর নিরাপত্তা এবং ডোজ নিশ্চিত করা হয়, দ্বিতীয় ফেইজে অসুস্থ রোগীদের উপর সীমিত আকারে প্রয়োগ করে এর কার্যকারিতা নির্ণয় করা হয়, এবং তৃতীয় ফেইজে বিভিন্ন বয়স এবং জিওগ্রাফিক গ্রুপে এই ওষুধের কার্যকারীতা এবং সাইড এফেক্ট পরীক্ষা করা হয়, এর পরেই মূলত এপ্রুভালের জন্য এপ্লাই করে বাজারজাত করা হয়। চতুর্থ ফেইজের ট্রায়াল চলমান থাকে অনেক বছর ধরে, তখন এর কাস্টমার ফিডব্যাক গ্রহণ করে এর লং টার্ম সাইড এফেক্ট নির্নয় করা হয়।

Remdesivir এর ফেজ-৩ ট্রায়াল

আমেরিকাতে প্রায় ১০৬৩ করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর উপর এই ওষুধ এবং প্লাসিবো (ডামি ওষুধ-ওষুধের মতো দেখতে হলেও এটি ওষুধ নয়) প্রয়োগ করে এর ফেইজ-৩ ট্রায়াল চালানো হয়। এই ট্রায়ালে দুটো গ্রুপে ভাগ করা হয় প্রথম গ্রুপে ৫ দিনের জন্য ট্রিটমেন্ট প্রদান করা হয় এবং দ্বিতীয় গ্রুপে ১০ দিনের জন্য।

ট্রায়ালে ফলাফলে দেখা যায় উভয় ক্ষেত্রেই একই ফলাফল আসছে, তাই ট্রিটমেন্ট পিরিয়ড ৫ দিন ধরেই ট্রিটমেন্ট করা হবে। ট্রায়ালে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রথম গ্রুপের শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ রোগী চিকিৎসার ১৪ দিনের মাথায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। আরো দেখা গেছে যে আক্রান্তের ১০ দিনের মধ্যেই চিকিৎসা গ্রহনকারীদের মধ্যে সুস্থ হবার হার বেশী।

ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে বেশ কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথাও এসেছে, তবে বেশিরভাগই বমি বমি ভাব, এছাড়া খুব কম ক্ষেত্রে শ্বাসতন্ত্রের জটিলতার সমস্যা এবং মাত্র তিন জনের যকৃতে সমস্যা দেখা গেছে।

ট্রায়ালের একটি তুলনামূলক চিত্র

অপেক্ষা করতে হবে আরো। Remdesivir জরুরী ভিত্তিতে অনুমোদন দেয়া হলেও জিলিয়াড জানিয়েছে তাদের ওষুধ এখনো ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে আছে এবং এর দীর্ঘ মেয়াদী সাইড এফেক্টের ব্যাপারে তাঁরা এখনো নিশ্চিত নয়। এছাড়াও এর কেমিক্যাল সিন্থেসিস প্রক্রিয়া অনেক জটিল এবং সময়সাপেক্ষ বিধায় তাঁরা এর উৎপাদনক্ষমতা নিয়ে ততটা আশাবাদী নয়। 

এই মুহুর্তে তাদের হাতে ৩০ হাজার রোগীকে চিকিৎসা প্রদানের মতো ওষুধ আছে, মে মাসের মোট উৎপাদনে তাঁরা আরো ১ লক্ষ ৪০ হাজারকে চিকিৎসা দিতে পারবে। অক্টোবর মাসের মধ্যে ৫ লক্ষ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে পরিমান রোগী তাতে সবাইকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে না। তাই জিলিয়াড অনুরোধ করেছে শুধুমাত্র ক্রিটিকাল রোগীদেরকে হাসপাতালের ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দেয়ার জন্য। জিলিয়াড সাইন্স আমেরিকা ইউরোপ এবং এশিয়াতে তাদের কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এখন দেখা যাক এটা সব দেশে সুলভ হতে কতদিন লাগে।

আশাবাদী আমরা। করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় আশাবাদ জাগালেও সুস্থ হবার হার ৬৫% কিন্তু খুব বেশী নয়। এই অস্ত্র নিয়ে এরকম একটা সুপার স্প্রেডার ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা সুবিধের হয় না। তবে যাই হোক, প্রথম অস্ত্রটা তো হাতে এসেছে, এটাই কম কী! এমনিতে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর হার ৫%, এই ৫% এর মধ্যে অর্ধেককে বাঁচিয়ে নিয়ে আসাটাও কম কিছু নয়।

এছাড়াও আরো অনেক প্রতিষ্ঠান ভিন্ন প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ওষুধ নিয়ে গবেষনা করছে, এগুলোর মধ্যে দুই একটা কার্যকরী ওষুধ চলে আসলেই করোনাভীতি অনেকটাই কমে যাবে। সর্বোপরি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিন নিয়েও ট্রায়াল চলছে, দীর্ঘ মেয়াদে (৭ মাস পর্যন্ত) এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে ফলাফল আশানুরুপ হলে এটা বাজারে চলে আসবে। তখনো হয়তো করোনা নির্মুল হবে না, তবে এটা সাধারন ফ্লু ভাইরাসের কাতারে চলে আসবে।

তথ্যসুত্র: gilead.com, nypost.com


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা