দারিদ্রের কষাঘাতে ঠিক বয়সে পড়াশোনা হয়নি। মদের কারখানা, বিশ্বযুদ্ধ, রেলের চাকরী সবকিছু শেষের পর জীবন সায়াহ্নে এসে আবার শুরু করেছিলেন পড়াশোনা। সফল হতে কী পেরেছিলেন? সেটা নিয়েই তো গল্প!

ছোটবেলায় রুল-টানা খাতার পেছনে কিছু নীতিবাক্য আমরা সবসময়েই পড়তাম। তার মধ্যে একটা নীতিবাক্য ছিলো খুব প্রচলিত-

শিক্ষার কোনো বয়স নাই
চলো সবাই পড়তে যাই

কিন্তু এই নীতিবাক্যতেই সমস্যা মনেহয় সবচেয়ে বেশি। কারণ বয়স্ক শিক্ষার্থীদের এমনিতেই আমরা খুব একটা ভালো চোখে দেখিনা। একটা নির্দিষ্ট বয়সে পরে মানুষও তাই পড়াশোনার আগ্রহটি হারিয়ে ফেলে পুরোপুরি। এরকম একটি অভিজ্ঞতা আমার ক্লাসেও হয়েছিলো। আমাদের ক্লাসে একবার পড়তে আসে আমাদের চেয়েও দ্বিগুণ বয়সের এক ছেলে। ছেলেমেয়েরা ঠাট্টা-তামাশা শুরু করে এই মানুষটিকে নিয়ে, আদুভাই আদুভাই বলে খ্যাপায়। পরে একসময়ে আবিষ্কার করি- লোকটি আর ক্লাসে আসছেনা। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিচ্ছিন্ন বিষয়টি মন থেকেই হারিয়ে গিয়েছিলো। আজ আবার মনে পড়লো ঘটনাটি। মনে পড়ার কারণও আছে৷

আজকে যে মানুষের গল্প বলবো, তার নাম গিসেপ্পে প্যাতার্নো। সিসিলির মানুষ। তার জীবন-গল্প অদ্ভুত। ছোটবেলা থেকে এই ভদ্রলোকের শখ পড়াশোনা করবেন ভালোমতো। কিন্তু বিধাতার বেশ অদ্ভুত এক খেয়াল হচ্ছে- মানুষ যা চায়, তিনি সবসময় তা দেননা। কেমন যেন দোনোমোনো করেন। প্যাতার্নোর ক্ষেত্রেও সেটাই দেখি আমরা। দারিদ্রের কষাঘাতে বিপর্যন্ত হয়ে পড়াশোনাটাই তার আর হয়ে ওঠেনা।

পরিবারে ছিলো সাত ভাই-বোন। তিনি ছিলেন আবার সবার বড়। দরিদ্র পরিবারের বড় ছেলে হওয়ার কারণে যেটা হলো, খুব অল্পবয়সেই রোজগারের সন্ধানে বের হয়ে যেতে হলো তাকে। বাবা কাজ করতেন মদ তৈরীর কারখানায়। সেখানেই কাজ শুরু করেন প্যাতার্নো। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের ছোঁয়া এসে লাগে সিসিলিতেও। প্যাতার্নো যোগ যেন যুদ্ধে।

যুদ্ধের পরে কিছুদিন কাজছাড়া থাকতে হয়। এরপর একটা চাকরী পেয়ে যান সরকারি রেলওয়েতে। খুব খাটতে হতো সেখানে। চাকরীতে শান্তি নেই যেন একবিন্দুও। তাও করে গিয়েছেন তিনি চাকরী। কারণ সবে বিয়ে করেছেন। নতুন সংসার। চাকরী খুবই দরকারি ছিলো তখন।

চাকরী করছেন, পরিবারের জন্যে টাকা আয় করছেন। কিন্তু তাও ভেতরে ভেতরে কোথায় যেন রয়ে গিয়েছে পড়াশোনার জন্যে সেই টান। ৩১ বছর বয়সে এসে নাইটস্কুলে ভর্তি হন তিনি। সারাদিন রেলের কঠোর কাজকর্ম শেষে সন্ধ্যায় স্কুলে যেতেন। রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে আবার পরদিন কাজ। এভাবেই হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে স্কুলের চৌহদ্দি পার হন তিনি। হাইস্কুল পাশ করে ফেলেন। গড়পড়তা মানুষ হলে এখানেই হয়তো ইতি টানতো। কিন্তু প্যাতার্নো বলেন, তিনি পড়াশোনা শেষ করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়'কে করেন পাখির চোখ।

এরপর মাঝখানে আবার কিছুদিন অবসর। নানা কাজ, পারিবারিক নানা সমস্যার কারণে আবার পড়াশোনায় ইস্তফা। ২০১৭ সালে এসে ভর্তি হন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইউনিভার্সিটি অব পালেরমোতে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। প্রত্যেকদিন কাকভাঙ্গা ভোরে উঠে পড়তে বসতেন, মাঝখানে খাওয়া আর বিশ্রামের সামান্য সময়টুকু বাদ দিয়ে সারাদিন বই নিয়েই লেগে থাকতেন। মাঝরাত পর্যন্ত চলতো তার এই পড়াশোনা। পাড়া-প্রতিবেশী, ঘরের সবাই মিলে বুঝতে পারছিলেন, এই বয়স্ক মানুষটি অযথাই বেশি চাপ নিচ্ছেন। এভাবে পড়াশোনা করতে থাকলে খুব বেশিদিন তিনি বাঁচবেন না৷ কিন্তু প্যাতার্নো এসব কে থোড়াই কেয়ার করতেন সবসময়েই।

ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। কয়েকটা পরীক্ষা হয়েও গিয়েছিলো। এরপরেই মহামারী করোনার আবির্ভাব। পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। মুষড়ে পড়েন প্যাতার্নো। কারণ এই মহামারি কবে শেষ হবে, কবে তিনি পরীক্ষা দেবেন, ততদিন বাঁচবেন কী না... অনেক চিন্তা। তবে এরমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনলাইন এক্সামের ব্যবস্থা করেন। প্যাতার্নো বাকি পরীক্ষাগুলো অনলাইনে দিয়েই কোর্স সম্পন্ন করেন।

সেই পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো সম্প্রতি। মজার ব্যাপার কী জানেন? তার ক্লাসে তিনিই সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেয়ে পাশ করেছেন। উতরে গিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিও। এতদিন ধরে যে স্বপ্ন লালনপালন করে এসেছেন সত্যি হয়েছে সেটিও। আফসোস একটিই, তার স্ত্রী তার এই সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার চৌদ্দ দিন আগেই মারা গেছেন প্যাতার্নোর স্ত্রী।

যাই হোক, নিজের ফলাফলে খুব খুশি গিসেপ্পে প্যাতার্নো। এবার তার ইচ্ছে, মাস্টার্স সম্পন্ন করবেন তিনি। নিজের সারাজীবনের আরাধ্য স্বপ্নকে সত্যি তো করেই ফেলেছেন তিনি। এবার সেই স্বপ্নকেই আরেকটু সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পালা।

আশা করি, তিনি সফল হবেন। তার যে অদম্য মানসিকতা, সফল হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি যে হাল ছাড়বেন না, তা বলাই বাহুল্য।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা