কলকাতার 'দুর্গা পূজা' শুধু পূজার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা এখন আর। সেখানে উঠে আসে প্রতিবাদ, সচেতনতা, ইতিবাচক নানা প্রসঙ্গ, ঘটে নীরব বিপ্লব। এবারেও যেমন আলোচনায় এলো কলকাতার এক পূজামণ্ডপ...

শহর কলকাতা দুটি কারনে বেশ বিখ্যাত। দুর্গাপূজা ও রসগোল্লা। পূজা যখন আসবো আসবো করছে, উত্তর কলকাতার প্রাচীন বাড়িগুলোর রেডিও'র গরাদ গলে ভেসে আসছে বীরেন্দকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া পাঠ, সকালের জমাট বাতাসে শিশিরের ভ্রুক্ষেপ আর শিউলির দীর্ঘশ্বাস... বুঝতে পারা যায়, আর মাত্র ক'দিন। ঢাকে কাঠি পড়লো বলে! কলকাতার পূজা এমনিতেও এক এলাহি ব্যাপার। রাস্তার মাথায় মাথায় গজিয়ে উঠবে একেকটা পূজামণ্ডপ। মানুষজনের ভীড়, ফুচকা, ঝালমুড়ির ভাসমান দোকানের হট্টগোল, পাটভাঙা জামাকাপড় পড়ে বাঙালীর দিন-রাত উজাড় করে দেবীদর্শন,  নানা ধাঁচের, নানা বৈচিত্র‍্যের সজ্জা একেকটা পূজামণ্ডপে। বাঙালীর আবহমান ঐতিহ্য যেন পূর্ণতা পায় এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই।

বেশ কিছু বছর ধরে কলকাতার বাঙ্গালীরা দুর্গাপূজাকে শুধু দেবী-আরাধনা বা ধর্মীয় সংস্কারের একটি অংশ হিসেবেই রেখে দেন নি, থিম পূজার মাধ্যমে সমাজ-রাষ্ট্র-পৃথিবীর বিভিন্ন অসঙ্গতি'কে তারা তুলে আনছেন মানুষের সামনে। দেবী প্রতিমা'র মাধ্যমে যেন তারা নীরব বিপ্লব করছেন, নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সেটা হতে পারে পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে, হতে পারে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে, সেটি হতে পারে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যেও। অর্থাৎ পূজা শুধু পূজা'তে আর সীমাবদ্ধ নেই। এটির গণ্ডি হয়ে গিয়েছে বৃহৎ ও ব্যাপক।

এবারেও পূজার একটি থিম নিয়ে বেশ জোর আলোচনা হচ্ছে৷ বেহালার বড়িশা ক্লাবের পুজো মণ্ডপে এবার 'মা দুর্গা' রূপে দেখা যাবে সন্তান কোলে থাকা এক মাকে৷ মূলত একজন পরিযায়ী শ্রমিকের আদলেই নির্মিত হয়েছে এ প্রতিমা। দেবী দুর্গার পাশাপাশি স্বরস্বতী, লক্ষ্মী এবং কার্তিককেও দেখানো হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের থিমের অনুকরণে। বেহালার বড়িশা ক্লাবের এই থিম এরমধ্যেই বেশ আলোড়ন তুলেছে। কৃষ্ণনগরের প্রতিমা শিল্পী পল্লব ভৌমিকের নির্মান করা এই প্রতিমাতে দেবীর মধ্যে ঐশ্বরিক ভাবের তুলনায় আটপৌরে, সাধারণ ভাবটাই যেন ফুটে উঠেছে পুরোপুরিভাবে। এটাই মানুষকে করেছে আকৃষ্ট। হচ্ছে ইতিবাচক আলোচনা।

দেবী দুর্গাকে 'পরিযায়ী শ্রমিক' এর আদল দিয়ে যেন নীরব প্রতিবাদই করলো শহর কলকাতা! 

এই যে এক মা কোলে দুধের সন্তান আর দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন নিজ গন্তব্যে, পূজা মন্ডপের এ দৃশ্যটা দেখতে প্রতিকী মনে হলেও এবারের লকডাউনে ভারতে এটা ছিলো খুবই সাধারণ এক চিত্র। লকডাউনের পর যখন আস্তে আস্তে সব কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো, হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক মায়েরা ঠিক এভাবেই সন্তান কোলে নিয়ে চলে গিয়েছেন তাদের গন্তব্যে, যেখান থেকে শহর কলকাতায় জীবিকার সন্ধানে আসা তাদের৷ এক অঞ্চল থেকে কাজের সন্ধানে অন্য অঞ্চলে যাওয়া মানুষগুলোকেই মাইগ্রেন্ট লেবার বা পরিযায়ী শ্রমিক বলা হয়। এসব পরিযায়ী শ্রমিক মায়েদের এবং তাদের পরিবারের কী অবস্থা, জানা নেই কারো। তারা মোটেও ভালো আছেন কী না, সংসারের জাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে নাভিশ্বাস উঠছে কী না তাদের, তাও আমরা জানি না। তবে এই মানুষদের কথা ভেবে যে পূজার থিম করা হয়েছে, এটা নিঃসন্দেহেই এক স্বস্তির বিষয়।

একটা পরিসংখ্যান জানিয়ে রাখি। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশের মোট পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা চার কোটি। যার মধ্যে এক কোটির বেশি পরিযায়ী মানুষ এই লকডাউনে হারিয়েছেন জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন। যাদের মধ্যে পরিযায়ী নারীরাই সংখ্যায় বেশি। সেই নারীরা বাড়িতে ফিরেও যে খুব শান্তিতে আছেন, বিষয়টা সেরকমও না। ঘরেও তারা স্বামীর হাতে নির্যাতিত হচ্ছেন, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বেড়েছে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভয়ঙ্কর  মারাত্মক আকারে। সেরকম এক টালমাটাল পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে প্রতিমা শিল্পীর এই সাহসী কাজ শুধু যে সচেতনতাই বাড়াচ্ছে, তা না। এই নিপীড়িত মানুষগুলোর অক্লান্ত কাজ ও শ্রমকে স্বীকৃতিও দিচ্ছে।  সে সাথে এটাও বোঝাচ্ছে, এই নারীরাও মা দূর্গা। মা দূর্গা প্রকাশিত হন এদের অবয়বেই। প্রতিদিন। নিয়মিত।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা