গোলাহাট গণহত্যা: পাকিস্তানীদের নির্মম প্রতারণা ও সাড়ে চারশো লাশের করুণ কাব্য
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বিহারী রাজাকারদের বিশ্বাস করে সাড়ে চারশোর বেশি মানুষ উঠে বসেছিলেন ট্রেনে। যে ট্রেন তাদের সৈয়দপুর থেকে ভারতের নিরাপদ অঞ্চলে নিয়ে যাবে। কেউ জানতো না, কি বীভৎস পরিণতি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য, হিংস্র শ্বাপদেরা ওৎ পেতে আছে সামনেই...
দেশভাগ, সাতচল্লিশ, দাঙ্গা নিয়ে উপমহাদেশের অনেক লেখক অনেক বই লিখেছেন। এদের মধ্যেও যশোবন্ত সিং, খুশবন্ত সিং, কৃষণ চন্দর, সাদাত হোসেন মান্টোর বইগুলো যুদ্ধকে দেখিয়েছে ভিন্ন চোখে। মান্টো আর দুই সিং এর সাথে আমার পরিচয় বড়বেলায় এসে। তবে আমি যখন খুব ছোট, তখন পাকেচক্রে আমার হাতে আসে কৃষণ চন্দরের 'পেশোয়ার এক্সপ্রেস' বইটি। ব্রিটিশ শাসন, দাঙ্গা, যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতা... এগুলো তখনো বোঝার বয়স হয়নি আমার। তবুও এ বই আমার পড়া 'গা শিউরে ওঠা' বইগুলোর মধ্যে অন্যতম। বড় হয়েও এই বইটা আবার পড়েছি। ততদিনে উপমহাদেশের মানচিত্র, ইতিহাস, সমকাল... আমার কাছে অনেকটাই স্পষ্ট। 'পেশোয়ার এক্সপ্রেস' পড়ে আমি ঠিক সেই ছোটবেলার মতনই শিউরে উঠেছিলাম তখনও। এতটা নৃশংস হওয়া সম্ভব! এতটা বীভৎস হয় হত্যা!
অবশ্য যুদ্ধ মানেই তো এসব। রুয়ান্ডা হত্যাকান্ড নিয়ে দেখেছিলাম 'হোটেল রুয়ান্ডা।' সে সিনেমার এক দৃশ্য ছিলো এরকম- ঘোলাটে কুয়াশার মধ্য দিয়ে গাড়ি যেতে যেতে আটকে যায় হঠাৎ। সম্ভবত গাড়ির চাকায় কিছু আটকেছে। দেখা গেলো, চাকায় লাশ আটকেছে। এবং আরেকটু ভালো করে তাকাতেই দেখা যায়- সামনের রাস্তার মাইলের পর মাইল জুড়ে হাজারে হাজারে লাশ, স্তুপ করে সারি দিয়ে রাখা হয়েছে।
যুদ্ধ এরকমই বীভৎস। উদাহরণ খুঁজতে বাইরে যেতে হবে কেন! আমাদের মুক্তিযুদ্ধও তো কম না মোটেও। ২৫শে মার্চ রাত থেকে শুরু হয়ে যে গনহত্যা চলেছে নয় মাস ধরে, সে ইতিহাস তো আমাদের কারোরই অজানা না। তবে জানা গল্পের মধ্যেও আছে এক অজানা বীভৎস, পাশবিক গনহত্যার ঘটনা। যে ঘটনাটি 'অপারেশন খরচাখাতা' অথবা 'গোলাহাট গণহত্যা' নামে চিহ্নিত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। দগদগে ঘা এর মতন জ্বলজ্বলে হয়ে যা এখনো প্রাসঙ্গিক এক ঘটনা।
ঘটনার প্রেক্ষাপট বুঝতে যেতে হবে একটু পেছনে। তখনও বাংলাদেশ হয়নি। ভারতবর্ষের মানচিত্রেও পড়েনি আঁকিবুঁকি দাগ। ব্রিটিশ আমল চলছে। সে সময়ে ব্রিটিশরা ব্যবসার সুবিধার জন্যে সৈয়দপুরে রেল কারখানা স্থাপন করেন। সে সাথে বেশ কিছু ব্যবসার উদ্যোগও নেয়া হয় এখানে। এই সময়ে বেশ কিছু মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ী চলে আসেন সৈয়দপুরে। তারা পাটসহ বেশ কিছু ব্যবসার পসার সাজিয়ে বসেন এই ব-দ্বীপে।
বছরের পর বছর কেটে যায়। আস্তে আস্তে মারোয়াড়িদের একটি কমিউনিটি তৈরী হয় সৈয়দপুরে। সৈয়দপুরের যে অংশে তারা বাস করতেন, সে অংশের নাম হয়ে যায় 'মারোয়াড়ি পট্টি।' বংশপরম্পরায় সেখানেই বাস করতে থাকেন মারোয়াড়িরা। সাথে চলতে থাকে তাদের ব্যবসা। যুগের পর যুগ ধরে।
এরই মধ্যে ইতিহাসের নাগরদোলা চালু হয়ে গিয়েছে। সাতচল্লিশ চলে এসেছে। পালাবদল ঘটেছে বহুকিছুর। বিহার থেকে বেশ কিছু উদ্বাস্তু এসে থিতু হয়েছে সৈয়দপুর সহ সারাদেশে। স্থানীয় মানুষজনের কাছে তারা 'বিহারী' নামে পরিচিত। তারা সৈয়দপুরে এসেছে মাড়োয়াড়িদের অনেক পরে, কিন্তু আসার পর থেকেই তাদের দাপটে তটস্থ পুরো এলাকার মানুষজন। বিহারীরা পাকিস্তানের স্বপক্ষে গোটা এলাকাতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করাও তখন শুরু করেছে ধীরে ধীরে।
সময় যত গড়ায়, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ঠোকাঠুকি বাড়তে থাকে। একাত্তরের সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়, সামনে বড়সড় কোনো গণ্ডগোল আসবে। মাড়োয়াড়িরা ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। দেশে ফেরার জন্যে মরিয়া হয়ে যান। কিন্তু সুযোগ আসছিলো না কোনো। এরইমধ্যে চলে আসে ২৫শে মার্চ। সারাদেশের বাঙ্গালীদের উপরে গণহত্যা চালানো হয়। বাদ যায় না সৈয়দপুরও। সেখানে বাঙ্গালীদের পাশাপাশি আক্রমণের শিকার হন মাড়োয়াড়িরাও। দেশে ফেরার ইচ্ছে আরো প্রবল হয় তাদের।
এরইমধ্যে ঘটে এক কাহিনী। জুন মাসের দিকে পাকিস্তানী সেনা আর স্থানীয় রাজাকারেরা মিলে সৈয়দপুরের মাড়োয়াড়িদের সাথে যোগাযোগ করেন। তাদের প্রবোধ দেন। বলেন, মাড়োয়াড়িরা ঠিকমত যাতে দেশে ফিরতে পারে, সেজন্যে পাকিস্তান সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। আগামী ১৩ই জুন ভোর ভোর সময়ে একটি স্পেশাল ট্রেন পাকিস্তান থেকে যাবে ভারতে। মাড়োয়াড়িদের জন্যেই এই স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো এলাকায় মাইকিংও করা হয় জোরেসোরে। স্পেশাল ট্রেনের কথা জানানো হয়। মাড়োয়াড়িরা তখন হতাশার মধ্যে একটুখানি আশার আলো খুঁজে পেয়েছেন। বাক্সপ্যাটরা গোছগাছ করা হচ্ছে। এই অস্থায়ী আবাসকে বিদায় দিয়ে নিজভূমে আবার প্রত্যাবর্তন করা হবে। বানের জলে ভেসে যেতে যেতে অকস্মাৎ যেন দ্বীপের দেখা পেয়েছে সবাই। সবাই খুশি। আবার ভীতও। ঠিকমত যাওয়া হবে তো? পথে কোনো সমস্যা হবে না তো!
কোনো মাড়োয়াড়ি হয়তো ঘূনাক্ষরেও কল্পনা করেনি, যে ট্রেনের কথা বলছে বিহারী ও পাকিস্তানিরা, সেই ট্রেনে কখনও ঘরে ফেরা হবে না তাদের। সেই ট্রেনে এমন জায়গায় তাদের নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা এঁটেছে পিশাচেরা, সে জায়গা থেকে ফেরার কোনো টিকেট নেই আর। মাড়োয়াড়িরা তখন মুক্তির আনন্দে বুঁদ হয়ে আছে। পিশাচেরা তখন অন্তরালে হাসছে বিষাক্ত ক্লেদিত হাসি। এই জটিল নাটক মঞ্চস্থ করে বিধাতাও উপর থেকে ক্রুর হাসি হেসেছেন কী না, তা জানা নেই আমাদের৷
বারোই জুন রাত থেকে সেই বিশেষ ট্রেনে ওঠা শুরু করলেন সবাই। এরইমধ্যে হলো আরেক ঘটনা। তেরো তারিখ ভোরে, ট্রেন ছাড়ার আগ মুহুর্তে এক জিপগাড়ি এসে ট্রেনে জড়ো হওয়া মাড়োয়াড়িদের পরিবার থেকে বেছে বেছে বিশটি যুবতী মেয়েকে তুলে নিয়ে চলে গেলো সৈয়দপুর সেনানিবাসে। সবাই তখন স্থানু। কেউ কিছুই বলছে না। সবাই ভালোয় ভালোয় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পৌঁছাতে চাইছে। কেউই আর ঝামেলায় যেতে চাইছে না। সবাই তাই মুখে কুলুপ এঁটেই বসে রইলো তাই। শুধু মেয়েগুলোর পরিবারেরা ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে রইলো বাইরে। উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে।
এর কিছুক্ষণ পরেই ট্রেন ছাড়লো। চারটি বগি ছিলো সেই ট্রেনের। এবং চার বগি ভর্তি ভীত সব মানুষজন বসে ছিলো অশরীরী প্রেতাত্মার মতন। ভীতসন্ত্রস্ত মানুষজন একসাথে আটার দলা হয়ে যেন বসে ছিলো ট্রেনের পেটের খুপরিতে। কেউ একটা শব্দও উচ্চারণ করছিলো না। যেন কথা বললেই ভেঙ্গে যাবে এই সুখস্বপ্ন। আর বাড়ি ফেরা হবে না। শ্মশানের নীরবতায় তারা বসে ছিলেন সবাই। ওদিকে ঘড়ঘড় শব্দ তুলে খুব আস্তে আস্তে এগোনো শুরু করেছিলো সেই বিশেষ ট্রেনও।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ট্রেন দুই কিলোমিটারও যায়নি তখনো। গোলাহাট এলাকায় এসে হঠাৎ করে থেমে যায় ট্রেন। ট্রেনের দরজা-জানালা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়। যতটুকু নজরে আসে, বোঝা যায়- রেললাইনের দুইপাশে অজস্র বিহারী আর পাকিস্তানী হানাদার, সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার হাতে ছুরি, চাকু, রামদা, ভোজালি, বেয়নেট। মাড়োয়াড়িরা বুঝতে পারে- হিংস্র জানোয়ারদের বিশ্বাস করেছিলো তারা। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে। শ্বাপদের ধারালো দাঁত, ঘাড়ের খুব কাছাকাছি তখন!
এক এক করে মাড়োয়াড়িদের গাড়ি থেকে নামানো হয়, কুপিয়ে খুন করা হয়। লাশ, মাংস, মগজে, চিৎকারে পুরো এলাকা কসাইখানা হয়ে যায় যেন। টেনেহিঁচড়ে নামানো হচ্ছিলো একেকজন মানুষকে। বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো হচ্ছিলো, রামদা দিয়ে কোপানো হচ্ছিলো, জিনিসপত্র লুট করা হচ্ছিলো। আর চিৎকার করে বলা হচ্ছিলো-
গুলি করে মারা হবে না তোদের। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলি অনেক দামী। তোদের কুপিয়ে মারা হবে। তোদের এভাবেই শেষ করা হবে।
বিহারীরা সে সাথে আরেকটি কথাও উচ্চারণ করছিলো বারেবারে-
খরচাখাতা, খরচাখাতা, খরচাখাতা...
বীভৎসতায় সবকিছুকে হার মানায় এ ঘটনা। একখণ্ড নরক যেন নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। দশ-বারোজন মাড়োয়াড়ি সেদিন পালাতে পেরেছিলো এই হত্যাযজ্ঞে বলি হওয়া থেকে। বাকিরা নৃশংস হত্যার শিকার হয়। হত্যার পর রেল লাইনের দুপাশে গর্ত খুঁড়ে মৃতদেহগুলোকে ফেলে রাখে বিহারীরা। পরবর্তী বেশ কিছুদিন লাশের গন্ধে ভারী হয়ে থাকে ঐ এলাকা। কুকুর, শেয়ালের মহোৎসবের আখড়া হয়ে ওঠে রেল লাইনের দুপাশ।
অনেকের মতে, এই গণহত্যায় চার হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেলেও সরকারি হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে মাত্র ৪৪৮ জন শহীদ মাড়োয়াড়ির নাম। বাকিরা হয়ে গেছেন বেমালুম হাওয়া। ভোজবাজির মতন মিলিয়ে গিয়েছেন। পরবর্তীতে বহু সরকার এসেছেন, গিয়েছেন। গণহত্যার এই স্থানটিকে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ এর জন্যে কোনো সরকারই সেরকম কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেন নি। সামাজিক কিছু সংস্থা আর স্থানীয় প্রশাসন মিলে একটা স্মৃতিসৌধ বানালেও, তা শুধু বানানো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়ে গিয়েছে। আশাব্যঞ্জক কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি, প্রয়াতদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্যে। বোকাসোকা সেই মাড়োয়ারিদের স্মৃতি আজও তাই অচ্ছুৎ এক ইতিহাস হয়ে আটকে আছে 'অপারেশন খরচাখাতা'র অন্তরালে। যারা বেঁচে থাকতেও ছিলেন বিস্মৃত। মরার পরেও তাদের খবর নেয় নি আর কেউ।
নিয়তির অদ্ভুত প্রহসনে 'অপারেশন খরচাখাতা'র শহীদেরা আমাদের ইতিহাসে হয়ে গিয়েছে একপশলা দীর্ঘশ্বাস। যে দীর্ঘশ্বাসে বুক ভারী হয়। কিন্তু যে দীর্ঘশ্বাস প্রমাণ করা যায় না, চোখে দেখা যায় না, কাউকে দেখানো যায় না।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন