আমাদের আম্মা আব্বাদের যুগে যে বাচ্চাদের সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করতো, রুটি বেলা বেলুন, ঝাটা স্যান্ডেল দিয়ে পিটাতো, এগুলোতে আমি খারাপ কিছুই দেখি না।

তখন বেজায় রাগ লাগতো বটে, কিন্তু এখন টের পাই, পিটাক-চিল্লাক যাই করুক, দিনের বড় একটা সময় তারা সন্তানকে দিতেন। রাতে বুকে নিয়ে ঘুমাতেন। নিজ হাতে খাবার তুলে খাওয়াতেন। না খেলে আবার চিল্লাপাল্লা করতেন। বই পড়ে শুনাতেন। বেড়াতে নিয়ে যেতেন। সামর্থ্য কম ছিল। তাই নিজের চাহিদা না মিটিয়ে সন্তানের বইপত্র কিনতে সব ব্যয় করতেন। 

জামা কাপড়ের বাহার ছিল না। খেলনা-মেলনা বেশি ছিল না। কিন্তু বাবা-মায়ের প্রচুর সান্নিধ্য ছিল। তাই আমাদের প্যারেন্টদের প্যারেন্টিং আমার খারাপ লাগে না। শুধু তাঁরা নিজেদের ঝগড়াঝাটিটা আমাদের সামনে না করলেই একশতে একশ পেতেন। সেই যুগের বাবা-মা বাচ্চাদের সামনে নিজেদের ভেতরের ভালবাসা না দেখালেও রাগারাগিটা ঠিকই করতেন।

আমার বাচ্চা মানুষ করার পদ্ধতিও বেশ সনাতন। আমি বলি না যে আমি খুব ভাল প্যারেন্ট। শুধু আমি এটা জানি যে আমার বাচ্চা মোটামুটি সুখি একটা বাচ্চা। আমার প্যারেন্টিংয়ের মূল উদ্দেশ্য বাচ্চাকে নানাভাবে আনন্দে রাখা, তবে সেটা দামি দামি জিনিসপাতি দিয়ে না।

সকালে অতন যখন ব্রেকফাস্ট খাওয়া নিয়ে অবধারিতভাবে দুষ্টামি করতে থাকে, আমি তখন তাকে পেপা পিগের বই এনে দিই। পড়তে পড়তে খেয়ে ফেলো। সে শিখছে পড়তে পড়তে খেলে খাওয়াটা আনন্দময় হয়, তেমন গায়ে লাগে না। 

ভাল প্যারেন্ট কিনা জানি না, শুধু জানি আমার বাচ্চাটা সুখী একটা বাচ্চা

আমি জিন্দেগিতে টিভি দেখতে দেখতে খাওয়া আর মোবাইল ট্যাব নেয়া অ্যালাউ করি নাই। এইসব ক্ষেত্রে কড়া নির্দেশ আছে, সেই নির্দেশ ভঙ্গ করার সাহস আমার মেয়ের নাই। আর নির্দেশ মানতে গিয়েই তার অভ্যাস হয়েছে বইপড়ার, মোবাইল বা টিভি না দেখার।

সে যখন খায়, আমি একটু পরই পরই তার খোঁজ নিই। আমি না নিলে তার বাবা নেয়। ঢাকায় থাকতে তার নানা নানু নিত। আদর করে আসি। চুমু দেই। বুকে জড়িয়ে ধরি। আমার মেয়ে জানে, মা বকবেই, মা নির্দেশ দেবেই, কারণ এটা মা। এতে মন খারাপ না করে বরং মায়ের কথা শুনলেই বাবুদের ভাল হয়। 

আমার বাসায় বাচ্চাকে আদর-শাসনের একটা অলিখিত ব্যালেন্স আছে। আমি বকলে তার বাবা আদর দিয়ে ব্যালান্স করে। আর বাবা কোন কারণে তার সাথে ক্ষেপলে আমি তার বাবার সাথে চ্যাচাই। পুরো ব্যাপারটাই শেষে একটা যৌথ পারিবারিক হাসিখুশি আন্দোলনের মতো হয়ে যায়, এবং অতন বকা খেয়েও শেষ পর্যন্ত হাসতে থাকে।

আদর-শাসনে বাবা-মায়ের ব্যালেন্সিং ভীষণ জরুরি  

পড়ালেখার কোন চাপ আমরা তাকে দিই নাই। দেই না। দেবও না কোনদিন। মনের আনন্দে যত ইচ্ছা খেলে বেড়াও, যত পারো স্পোর্টস কর, ছবি আঁকো, গান গাও, নাচো, সাইকেল চালাও, সোফায় উঠে লাফাও, বিড়াল কুকুর ধর, বারান্দায় গড়াগড়ি যাও, দৌড়াও, তবে স্কুলে মনোযোগী থাকো এবং অবশ্যই অবশ্যই প্রতিদিন বই পড়। 

এর মধ্যে টিভিও দেখ। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট স্ক্রিণ টাইমের পর তোমাকে অবশ্যই টিভি অফ করতে হবে, পানি খেয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে অন্য কাজে যেতে হবে। এটা মায়ের নির্দেশ। মা যেহেতু তোমার যা ভাল লাগে, সবকিছুতে সাথে থাকে, তাই মায়ের ভাল লাগার দামও তোমাকে দিতে হবে- এই বার্তাটুকু তার শিশু মাথায় আমরা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছি। এখন বাকিটা সে চরে খাবে। এই আশা রাখি।

বাচ্চার সাথে প্রতিদিন প্রচুর কথা বলা, তাকে সময় দেয়া, বুকের ভেতরে জড়িয়ে রাখা, চুমু খাওয়া, আদর করা, তার সাথে হাসি ঠাট্টা করা, দরকারে পশ্চাতদেশে দুইটা পিটুনি দেয়া- সবই খুব জরুরি।

বাচ্চার সাথে সময় কাটানোটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  

একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত বাচ্চাকে প্রচুর সময় দেয়া লাগে। সেটা নানাভাবেই দেয়া যায়। তার যেকোন সমস্যায় আমি তার পাশে আছি- এই বোধ ঢুকিয়ে দেয়াটাও সময় দেবার অংশ। আবার বাচ্চাকে সব কথায় হ্যাঁ বলতে হবে, এর কোন কারণ নাই। যে কাজটা ঠিক না, তার জন্য ক্ষতিকর, সেটাতে খুব সহজ ভাষায় স্পষ্ট করে ‘না’ বলে দেয়াটা মাস্ট। তবে সেই ‘না’ বলার আগে বাচ্চাকে সেই বোধটা দেন যে, মা-বাবা যখন ‘না’ বলে, তার পেছনে যুুক্তি আছে, কারণ আছে এবং অবশ্যই সেটা তার ভালভাবে বেড়ে ওঠার জন্য। 

বাচ্চাকে শিশু ভেবে সে কিছুই বুঝবে না- এটা ভাবার কোন কারণ নাই। বরং তারা সবই বোঝে, যদি আপনি ঠিকমত বুঝাতে পারেন। তাই ছোটকাল থেকেই তার সাথে স্পষ্ট করে যৌক্তিক আলোচনা করেন। তার মাথায় একদিন না একদিন ঢুকবেই।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা