
'গুগল' নামটাও এসেছে এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে। যাত্রা শুরু বন্ধুর গ্যারেজ থেকে। অফিশিয়ালি শুরু হওয়ার পরে বন্ধ হওয়ারও সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিলো। বিক্রি করার কথাবার্তাও চলছিলো। কিন্তু এরপরের গল্প পুরোটাই পৃথিবী বদলে দেয়ার...
যেকোনো জিনিসের, ঘটনার বা বিপ্লবের একটা শুরু থাকে। কোনো একটি বিষয় সাফল্য পাওয়ার পরে যতটা চকচকে হয়, একেবারে শুরুর দিকে সেটি থাকে একেবারেই বর্ণহীন। এই যেমন টেক জায়ান্ট গুগলের কথাই ধরুন না কেন, আমাদের এমনও কী দিন গিয়েছে, যেদিন আমরা গুগলের শরণাপন্ন হইনি? কিন্তু গুগলের গোড়ার দিককার গল্প কী আমরা জানি? সুন্দর পিচাইয়ের গল্প হয়তো আপনি জানেন, পারিসা তাব্রিজের গল্পও শুনেছেন হয়তো কেউ কেউ। কিন্তু গুগলেরও যে জন্ম আইফোনের মত একটা সস্তার গ্যারেজ থেকে, সে গল্প জানেন কয়জন? যদি না জেনে থাকেন তাহলে ঘুরে আসা যাক গুগলের অন্যরকম এই জার্নি থেকে।
গুগলের গল্প বলতে গেলে দুইজন মানুষের কথা বলতেই হবে। ল্যারি পেইজ ও সার্গেই ব্রিন। এই দুইজন মানুষের হাত ধরেই গুগলের জন্ম। ১৯৯৫ সালের দিকে প্রথমবারের মতন মুখোমুখি হন ল্যারি পেইজ ও সার্গেই ব্রিন। সার্গেই ব্রিন ছিলেন স্টানফোর্ডের কম্পিউটার সায়েন্সের সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। তখনই একটা অনুষ্ঠানে তার দেখা হয় ল্যারি পেইজের সাথে, যিনি ছিলেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। দুইজনের দেখা হওয়া যেন আদিম গুহামানবের দুই পাথরের ঘর্ষণে আগুন জ্বালানোর মত বিষয়। ল্যারি পেইজ এবং সার্গেই ব্রিন আলাপ শুরুর পর দেখলেন, তারা যেন গুপি গাইন, বাঘা বাইন। একজন ছাড়া আরেকজন অচল। দুইজনের আগ্রহও একেবারেই এক। ভাবলেন, দুইজন মিলে একটা রিসার্চ প্রজেক্ট করলে কেমন হয়! যা ভাবা তা কাজ। ঐ বছরেই একটা রিসার্চ প্রজেক্টে কাজ করা শুরু করেন তাঁরা।
তবে এই ঘটনার পেছনে আরেকটু ইতিহাস ঘাঁটার দরকার আছে। ল্যারি পেইজের বাবা ছিলেন মিশিগান স্টেটের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। তিনি পেইজকে একবার বলেছিলেন- একটা সাকসেসফুল থিসিস তোমার জীবন পরিবর্তন করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই এমন কিছু ভাবো, যেটা তোমার জন্যে চ্যালেঞ্জিং ও সে সাথে ক্যারিয়ারের জন্যে ভালো হয়। ল্যারি পেইজ বাবার এ উপদেশকে বেদবাক্য হিসেবে মেনে নেন এবং নিজের মত করে কী করা যায়, ভাবতে থাকেন। তিনি বুঝলেন- নেক্সট জেনারেশনটা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের হবে৷ তিনি দেখলেন, পৃথিবীতে যত কম্পিউটার, যত ওয়েবসাইট, যত ডিভাইস থাকুক না কেন, তা আসলে জালের মত একটি আরেকটির সাথে যুক্ত। মাকড়সার এই জালের সংযোগপ্রান্ত খুঁজে বের করতে হবে। এটাই চ্যালেঞ্জ।
তিনি তখন অনলাইনে যে ওয়েবসাইটগুলো আছে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করা শুরু করলেন। দেখলেন, প্রত্যেকটা ওয়েব পেইজ নির্দিষ্ট একটা সাইটের সাথে যুক্ত। তিনি চাইলেন সবগুলো সাইটকে জালের মত একত্রে রাখতে। তিনি ভাবলেন, সবগুলো সাইটকে যদি একত্রে ধরে কোথাও রাখা যায়, তাহলে একসাথেই পাওয়া যাবে সব সাইটের তথ্য। সেখান থেকেই BackRub এর ধারণা আসে। এই শব্দটির একটা অর্থও আছে। একটা বড় ওয়েবসাইটের ব্যাকে যেহেতু এতগুলো তথ্য থাকবে, তাই নাম দেয়া হলো ব্যাকরাব. তবে এ প্রযুক্তিতে অঙ্কের খেলা ছিলো প্রচুর। এলগরিদম নিয়ে প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট করতে হতো। এই কাজে তখন যুক্ত হলেন সার্গেই ব্রিন। ব্রিন নিজে ছিলেন নাসার অঙ্কবিদ বিজ্ঞানীর সন্তান। ছোটবেলা থেকেই ব্রিন জটিল জটিল এলগরিদম নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন। গ্রাজুয়েশন শেষ করে শখের বশেই এসেছিলেন স্টানফোর্ডে। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন রকম কাজকর্মেও যুক্ত হচ্ছিলেন। তখনই পেইজের সাথে পরিচয়। পেইজের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু। অঙ্কের কাজ, এলগরিদমের কাজ। ব্যাকরাব এর জটিল সমীকরণেরই কাজ করতেন ব্রিন। তিনি যোগ্য সমর্থন দিতে লাগলেন ল্যারি পেইজকে।
কাজ যত এগোচ্ছিলো, তত চ্যালেঞ্জ আসছিলো। সেগুলোকে উতরানোও যাচ্ছিলো নিয়মিত বিরতিতে৷ কোন সাইটকে বেশি প্রায়োরিটি আর কোন সাইটকে কম প্রায়োরিটি দেয়া হবে, তা নিয়ে ঝামেলা বাড়ছিলো। এ্যালগরিদম ব্যবহার করে সার্গেই ব্রিন একটা নতুন সিস্টেম চালু করলেন, নাম- পেইজর্যাঙ্ক। প্রায়োরিটির সমস্যা দূর হলো।
এরমধ্যে 'BackRub' নাম পরিবর্তন করে 'Google' করা হয়েছে। এখানেও রয়েছে এক মজার ইতিহাস। ল্যারি পেইজ ও সার্গেই ব্রিন দুইজনেই ওয়ার্ডপ্লে খুব পছন্দ করতেন হয়তো। নাম নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা করছিলেন তারা। তখন তাদের এক সহকর্মী শন এ্যান্ডারসন একটা নাম নিয়ে আসেন; Googolplex। এই Googolplex থেকে Googol নামটা পছন্দ হয় পেইজের। কেন পছন্দ হয়, সেটাই বলি এবার। Googol বা গুগোলের কিন্তু একটা অর্থ রয়েছে। এটি একটি সংখ্যা নির্দেশক শব্দ।এক লিখে তার পরে একশটি শূণ্য বসালে যে বৃহৎ সংখ্যাটি পাওয়া যায় তা-ই এক গুগল। অঙ্ক করার ক্ষেত্রে এই বিষয়টির ভূমিকা খুব সামান্য। না জানলেও চলে। কিন্তু এটি আসলে মেটাফোরের মতন; অনেক বড় এবং বিস্তৃত কিছুকে বোঝাতে এটিকে ব্যবহার করা হয়। এন্ডলেস এক্সপেরিয়েন্স বোঝানোর জন্যেই এই নামটা পছন্দ হয় পেইজের।

এবার তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে জিনিসটির নাম Google হলো কেন? নাম তো Googol হওয়ার কথা। নামটি চেঞ্জ হওয়ার কারণ; সোজা বাংলায়- দুর্ঘটনা। ডোমেইন নাম কেনার সময়ে ভুলে Google.com লিখে সার্চ করা হয় এবং এই নামটি আসার পর ক্লিক করে রেজিস্ট্রেশন করে ফেলা হয়। পরে দেখা যায়, Googol আসেনি। এসেছি Google.
যাই হোক, ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতন গুগল আত্মপ্রকাশ করে স্টানফোর্ডের ওয়েবসাইটে। এবং সেটি প্রথম ধাক্কাতেই প্রবল জনপ্রিয় হয়ে যায়। এবং তখন প্রথমবারের মতন ল্যারি পেইজ এবং সার্গেই ব্রিন বুঝতে পারেন, গুগলকে সামলাতে তাদের অনেক টাকাপয়সা দরকার। কিন্তু তাদের কাছে টাকাও নেই। গুগলকে অপারেট করার মতম জায়গাও নেই।
তাও তারা কাজ শুরু করেন। ল্যারি পেইজের ডর্মে কাজ শুরু হলো, সিপিইউ সহ কিছু যন্ত্রপাতি কেনা হলো, স্টানফোর্ড থেকে সাহায্য আসতে লাগলো। কাজ এগোলো। কিন্তু হুট করেই তারা ভাবলেন, গুগলকে বিক্রি করে দেবেন। তখন সবচেয়ে বড় সার্চ ইঞ্জিন কোম্পানি ছিল ‘ইয়াহু!’ ১৯৯৭ সালে তারা ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে গুগলকে কেনার জন্য ইয়াহুকে অফারও দেন। কিন্তু ইয়াহু ফিরিয়ে দেয়। মজার ব্যাপার, ২০০২ সালেও তারা ইয়াহুর কাছে গুগলকে বিক্রি করার চেষ্টা করেন। তখনও তারা ফিরিয়ে দেয়!
যাই হোক, ১৯৯৮ সালের দিকে স্টানফোর্ডের বাইরে গ্লোবালি অফিশিয়ালি আত্মপ্রকাশ করলো গুগল। মেইন অফিস কোথায় জানেন? ক্যালিফোর্নিয়ার এক গ্যারেজে। ল্যারির বন্ধু সুসান ওজস্কির গ্যারেজ ছিলো সেটা। সেখানেই রীতিমতো প্রফেশনাল কায়দায় অপারেশন শুরু হলো।

প্রথমদিক গুগল কোনোরকমের বিজ্ঞাপন নিতো না তাদের সাইটে। কিন্তু সময় যত গড়ালো বিশ্বব্যাপী তাদের এই ওয়েবসাইটের জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগলো। এবং অন্যান্য সাইটের চেয়েও এখানে বেশি ও অথেন্টিক তথ্য পাওয়া যেতো। তাই মানুষজন বেশি আগ্রহী হলো গুগল নিয়ে। গুগল তখন এ্যাড নেয়া শুরু করে। প্রচুর টাকাপয়সা আসতে শুরু করে তখন। এরপরের বছরেই গুগল গ্যারেজের অফিস থেকে মুক্ত হয়। টেক জায়ান্টদের 'নন্দনকানন' সিলিকন ভ্যালিতে স্থানান্তরিত হয় তাদের অফিস। ঠিকানা হয়- ১৬৫ ইউনিভার্সিটি এ্যাভিনিউ, পালো অল্টো। পালো আল্টোর এক সাইকেলের দোকানের উপরের তলায় নতুন কার্যালয় নেয়া হয়। এর সাত মাস পরই মাউন্টেন ভিউয়ে নতুন কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মাউন্টেন ভিউয়ে গুগলের মূল কার্যালয়কে বর্তমানে ‘গুগল প্লেক্স’ বলে ডাকা হয়। এ্যাম্ফিথিয়েটার পার্কওয়ের যেই জায়গাটিতে এখনো আছে গুগল।

যাই হোক, সময় যত গড়াচ্ছিলো আপডেট ও ডেভেলপমেন্ট ততই আসছিলো গুগলের। ২০০০ সালের দিকে এসে গুগলের ইউজার ইন্টারফেস হয়ে যায় খুবই মিনিমালিস্টিক। সিম্পল ও ক্লাসি ডিজাইনে চলে আসে তারা। সাইট লোডিং স্পিড বাড়ানো হয়। লক্ষ্য দেয়া হয় ইনফরমেশন ম্যানেজিং এর ক্ষেত্রেও। গুগল বরাবরই ছিলো বড় দৌড়ের ঘোড়া। সেটিই আমরা লক্ষ্য করি এই সময়ে এসে৷ মানের ব্যাপারে তাদের কোনো আপোষই দেখা যায় না কখনো।
তারা এক্সপেরিমেন্ট করেছে বিভিন্ন বিষয় নিয়েই। ২০০৪ সালের দিকে তারা নিয়ে আসে সোশ্যাল মিডিয়া সাইট; অরকুট। এছাড়াও জিমেইলও আসে সেবছরেই। যে জিনিসটি আমাদের জীবনকে দখল করে নিয়েছে পুরোপুরিভাবেই। সোশ্যাল মিডিয়া অরকুট প্রথমদিকে বেশ সাড়া তুললেও লম্বা রেসে টিকে থাকতে পারেনি। কিন্তু জিমেইল রয়ে গিয়েছে অপ্রতিরোধ্য হয়ে। এরপরের বছরেই গুগল চালু করে গুগল ম্যাপস, গুগল আর্থ ও টকব্যাক। এ্যান্ডয়েডকেও তারা কিনে নেয় সে বছরেই। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প জানিয়ে রাখা ভালো- ল্যারি পেইজের বরাবরই ইচ্ছে ছিলো, গুগল'কে শুধুমাত্র 'সার্চ ইঞ্জিন' হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক হবেনা। তখন সে নিজের উদ্যোগেই এ্যান্ড্রয়ডকে কিনে নেয়। এরপর অপারেটিং সিস্টেম সহ বাকিসব জিনিসপত্র নিয়ে গবেষণা করে এ্যান্ড্রয়েড'কে একটা ভালো ভিত্তি এনে দেন। গুগল এরপর করে আরেকটা অসাধারণ বিষয়। আগে তো শুধু টেক্সট সার্চ করতো তারা, এরপর তারা ইমেজ, ম্যাপ, ভিডিও সব সার্চ করা শুরু করে। মানে, যেসব জায়গায় ঘাটতি ছিলো সেগুলোও পূরণের চেষ্টা করে। মানুষজনের মুখে তখন একটাই শব্দ। গুগল। বড়সড় এক বিপ্লব ঘটিয়ে গুগল তখন শক্তপোক্ত অবস্থানে।
এরপর গুগলের আরেক অস্ত্র আসে ২০০৮ সালের দিকে। গুগল ক্রোম। যেটি বর্তমানে হয়তো কিছু সমালোচনা দেখছে, কিন্তু তাও গুগল ক্রোমে আস্থা রেখেছেন অনেকেই, সেই একেবারে প্রথম থেকেই। গুগল ক্রোমের পরে আসে গুগল প্লাস। এরপর নানা রকমের আপডেট, এ্যাপ, প্রোডাক্ট তো ক্রমাগতই আসছে।
গুগল গ্লাস, ক্রোমকাস্ট, নেক্সাস বাজারে ছাড়া, হিটাচি কে কিনে নেওয়া সহ গুগল করেছে অনেক কিছুই। ২০১৮ সালের দিকে এসে গুগলের বার্ষিক বিক্রি দাঁড়িয়েছে ১০০ বিলিয়নেরও বেশি। যে সংখ্যা ক্রমশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে সবকিছুকে।
প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫.৫ বিলিয়ন সার্চ হয় গুগলে। ল্যারি পেইজ এবং সার্গেই ব্রিন এর 'ব্রেইন-চাইল্ড' এই বিস্ময়টি এখন গোটা পৃথিবীরই আস্থার প্রতীক। প্রত্যেকদিন পৃথিবীর অগুনতি মানুষ বিভিন্ন কারণে ব্যবহার করেন গুগল'কে। আলাদিনের চেরাগ ঘষে বের হওয়া 'হুকুম করুন, মালিক' দৈত্যের মতন সে সঙ্গ দিয়েছে পৃথিবীতে বসবাসকারী নাগরিকদের, প্রতিদিন দিচ্ছেও। এ অগ্রযাত্রা সামনেও চলবে, কামনা রইলো। প্রতিষ্ঠার ২৪ বছর পার করলো গুগল। সামনে আরো যে চমক তারা দেখাবে সে তো পুরোপুরিই নিশ্চিত। সেজন্যেই অপেক্ষা।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন