গুগল ম্যাপ থেকে ফিলিস্তিনের মানচিত্র মুছে দেওয়া হয়েছে- সম্প্রতি এরকম একটা শোরগোল উঠেছে ইন্টারনেটে।

গুগল ম্যাপে গিয়ে 'Palestine' লিখে সার্চ দিলে দেখা যায়- কথা সত্য! আসলেই এই নামে কিছু নেই। কিন্তু ব্যাপারটা নতুন কিছু না। গুগল ম্যাপে আসলে এই নামে কিছু ছিলোই না কখনো! এটা নিয়ে এর আগেও, ২০১৫-১৬ এর দিকে একবার খুব লিখালিখি হচ্ছিলো, একটা হ্যাশট্যাগ #PalestineIsHere ভাইরাল হয় তখন। এমনকি গুগল নিজেও বিবৃতি দিয়ে স্বীকার করে নেয়- তারা এ নামে কিছু রাখেওনি কখনো!

অবশ্য এটা নিয়ে খুব একটা অবাক হবার কিছু নেইও। ইজরায়েল নামক যে ক্যান্সার মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির আগুন জ্বালছে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে, তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক তো পশ্চিমা দেশগুলোই! আর গুগল একটি মার্কিন কোম্পানি, তারা কখনই ইজরায়েলকে চটাতে চাইবে না।

জাতিসংঘের যে দেশগুলো এখনও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়নি, সবগুলো হয় পশ্চিমা বিশ্ব, অথবা তাদের দোসর- জাপান, নিউজিল্যান্ড, কোরিয়া, সুইজারল্যান্ডের মতো তথাকথিত সভ্য ও মানবিকতার ঝান্ডাধারীরা। তাই গুগলের মতো পশ্চিমা আধুনিক সভ্যতার অন্যতম বৃহত্তম উপকরণ নির্লজ্জভাবে ইজরায়েলের তাঁবেদারি করবে- সেটাই স্বাভাবিক। তার উপর এটা ট্রাম্পের আমল, ইজরায়েল-ফিলিস্তিন বিতর্কের আগুনে যে কিনা শুধু ঘিই ঢেলেছে!

যেমন- জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী ঘোষণা দিয়ে দূতাবাস সরিয়ে আনা!

ফিলিস্তিনের নাম নেই গুগল ম্যাপে

১৯৪৮ সালে প্রথম আরব-ইজরাইল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ইজরায়েল পশ্চিম জেরুজালেম দখল করে নেয়। ১৯৪৯ সালের দ্বিতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধেও পূর্ব জেরুজালেম ইজরায়েলের আওতামুক্ত থাকে। কিন্তু ১৯৬৭ সালের তৃতীয় ইজরায়েল-আরব যুদ্ধে সিরিয়া ও জর্ডানকে পরাজিত করে ইজরায়েল পশ্চিমতীর, পূর্ব জেরুজালেম, সিনাই উপত্যকা ও গোলান মরুভমি দখল করে নেয়। 

১৯৮০ সালে ইজরায়েল একতরফা ভাবে 'জেরুজালেম আইন' পাশ করলেও আন্তর্জাতিক মহল তা মেনে নেয়নি, এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ৪৭৮নং রেজ্যুলশন পাশ করে এই আইনটি বাতিল ঘোষণা করে।

কিন্তু ১৯৯৫ সালে হয়তো ইজরায়েলি লবিস্টদের চেষ্টাতেই 'জেরুজালেম অ্যাম্বাসি অ্যাক্ট' নামে একটা আইন পাস হয় যুক্ত্রাষ্ট্রের কংগ্রেসে। সিনেট আর হাউজ অফ রিপ্রেসেন্টেটিভ দুই জায়গাতেই এই আইন বিপুল ভোটে জয়ী হয়। এই আইন অনুযায়ী জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যুক্ত্রাষ্ট্রের ইজরায়েলী দূতাবাস সেখানে স্থানান্তরিত করা হবে! 

কিন্তু ট্রাম্পের আগ পর্যন্ত কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টই আইনটা কার্যকর করেনি! ৬মাস পর পর স্বাক্ষর করে শুধু পিছিয়েছে। কারণ সবাই জানতো- এই জেরুজালেম ইস্যুটা কত ভয়ংকর সেন্সিটিভ, এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে শান্তি প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটবে। জেরুজালেমকে নিজেদের বলে দাবী করে ইজরায়েল-ফিলিস্তিন দুই দেশই; ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় সব দিক থেকেই এই শহর, আল-আকসা মসজিদ এসব নিয়ে কোন দেশই বিন্দু মাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়! ১৯৯৩, ২০০০ সাল সহ যতবারই মার্কিন মধ্যস্ততায় ইজরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনা হয়েছে, জেরুজালেমকে সবাই আলাদাভাবেই বিবেচনা করেছে, একে পৃথকভাবে রাখা হয়েছে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায়।

কিন্তু ট্রাম্প সবাইকে হতভম্ভ করে ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঘোষণা করে জেরুজালেমই হবে ইজরায়েলের রাজধানী, তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে সরানো হয়!

এই হঠাকারিতা এতটাই জঘন্য ছিলো যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র বাদে বাকি ১৪ সদস্য (৪ টি স্থায়ী ও ১০টি অস্থায়ী) তীব্র ভাষায় নিন্দা জানায়। এমনকি তাদের দোসর ইউরোপীয় ইউনিয়নও এটা মানতে পারেনি। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন তার তোয়াক্কা করেনি। 

২০১৭ সালে জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ট্রাম্প  

এরচেয়েও হাস্যকর কাজ করেছে ট্রাম্প ২০১৯ এর জুনে। 'ডিল অফ দ্যা সেঞ্চুরি' নামক বাগাড়ম্বর করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সনদ হিসেবে এক পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন। এর ট্যাগ লাইন ছিলো- “শান্তি থেকে সমৃদ্ধি”

আসুন দেখে নেই এই পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনকে কীভাবে “স্বাধীনতা” দেওয়া হচ্ছে-

১) ফিলিস্তিন নামে কোনো রাষ্ট্রই থাকতে পারবে না- তাদের নতুন নাম হবে New Palestine!

২) ফিলিস্তিনের কোন সার্বভৌমত্ব থাকবে না, একক সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হবে ইজরায়েল!

৩) জেরুজালেম এককভাবে ইজরায়েলের রাজধানী হবে (আর বলতে!)

৪) New Palestine এর কোন সামরিক বাহিনীও থাকবে না- নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইজরায়েলকে অর্থ দিতে হবে (দুই মিনিট হাসুন)

৫) এই চুক্তি না মানলে ফিলিস্তিনকে সকল প্রকার আন্তর্জাতিক সাহায্য থেকে বঞ্চিত তো করা হবেই, ফিলিস্তিনি নেতাদের হত্যা করতে পারবে ইজরায়েল! ইজরায়েল ফিলিস্তিনের ক্ষমতাসীন PLO এবং হামাসের বিরুদ্ধে অল আউট যুদ্ধ শুরু করলে তাতে সরাসরি যোগ দিবে যুক্তরাষ্ট্রও!

এই হলো ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও শান্তি সম্প্রীতির নমুনা! সেই মার্কিন মূলুকের একটা কোম্পানির ম্যাপে আপনি যদি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র খুঁজে না পেয়ে হতাশ বা ক্রুদ্ধ হোন, দুঃখিত, আপনার জন্যই করুণা! আর কত ঘুমাবেন, এবার উঠুন!

-

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক  গ্রুুুুপে


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা