বেসরকারী পাটকলগুলো যেখানে লাভের মুখ দেখছে, সেখানে কর্মচারীদের দুর্নীতি আর অযোগ্যতার কারণে সরকারী পাটকলগুলো প্রতি বছর লোকসান গুণেছে কোটি কোটি টাকা। পাটের বিশাল বাজারটা ধরার পরিবর্তে বাজার থেকেই হারিয়ে যাওয়ার পথে হাঁটছি আমরা...

খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের নাম শুনেছেন? শোনার কথা না, ২০০২ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো সেটা। একসময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কাগজের ফ্যাক্টরি ছিলো সেটা।

আদমজী পাটকলের নাম তো শুনেছেন অবশ্যই। ১৯৫১ সালে স্থাপিত এই পাটকল একসময় ছিলো পুরো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাটকল। সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হয় ২০০১ সালে। 

আপনি যদি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন যত মিল ফ্যাক্টরি আছে সব গুলোর খোঁজ নেন দেখবেন বছরের পর বছর লস দিয়ে কোনমতে ধুঁকে ধুঁকে চলছে এগুলো। এগুলোকে চালু রাখতে প্রচুর পরিমাণে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে। অথচ বেসরকারি খাতে একই পণ্যের ফ্যাক্টরিগুলো দেশের ও বাইরের চাহিদা মিটিয়ে মুনাফা তুলছে। তাহলে সমস্যা কোথায়?

সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সকল পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) এর অধীনে থাকা ২৫টি পাটকল গত ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই লোকসান গুনেছে, বর্তমানে তাদের পুঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা! অবস্থা এতটাই নাজুক যে ২৫ হাজার শ্রমিককে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে সব সরকারি পাটকল বন্ধ করে দেওয়াটাই এখন তূলনা মূলক ভালো অপশন মনে হচ্ছে সরকারের কাছে!

অথচ খেয়াল করুন কোন সময়ে হচ্ছে এটা! সারা দুনিয়াতে প্লাস্টিক বর্জ্য এখন প্রচন্ড আলোচিত একটা ইস্যু। প্রতিদিন প্রায় চার লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে সারা দুনিয়ায়। এসব দূষিত করছে আমাদের মাটি আর পানি। সারা পৃথিবীর সচেতন মানুষেরা ঝুঁকছে জৈব ও পঁচনশীল বিকল্পের দিকে। আর এ জায়গায় পাটের দারুন সুযোগ আছে আবার বিপুল বিক্রমে নিজের পূরানো জৌলুশ ফিরে পাওয়ার।

বর্তমানে প্লাস্টিকের বিকল্প পচনশীল জৈব দ্রব্যের বাজারের আয়তন প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলারের! যেটা ২০২৬ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ৬ বিলিয়ন ডলারে! এদিকে সারা দুনিয়াতে বর্তমানে যেখানে পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা প্রায় ৭.৫ লাখ টন তার ৬১.৩% ই অর্থাৎ ৪.৬ লাখ টনই উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে! অর্থাৎ বিশ্ব বাজারে চাহিদা আছে, কাঁচামালের উৎপাদনও আছে। তাহলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই পাটকল গুলো বছরের পর বছর লস দিচ্ছে কেন? যেখানে আকিজ জুট মিলসের মত বেসরকারি কারখানারা গুলো বিশাল অংকের লাভ গুনছে সেই পাট সুতা রপ্তানি করেই? অনুসন্ধানে নিচের পয়েন্ট গুলো আসে-

১) বিজেএমসির কর্মকর্তা, কর্মচারীদের চরম অবহেলা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতি। তারা কেউ পাটের ব্যবসা বুঝেনও না, চেষ্টাও করেন নি। নিজেরা পরাশুনা করেছেন বাংলা, ইতিহাস ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে। বছরের পর বছর শুধু কর্মপরিকল্পনা করে গেছেন খাতায় কলমে, বাস্তবায়ন হয়নি কিছু।

২) সরকারি পাটকলগুলো ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, সেগুলোর যন্ত্রপাতি সবই ৬০-৭০ বছরের পুরোনো। ফলে পাটকলের উৎপাদনক্ষমতা ৪০-৪৫ শতাংশে নেমে আসে। সে কারণে এক টন পণ্য উৎপাদনে বেসরকারি মিলে যেখানে ২৫-২৮ জন শ্রমিক লাগে, সেখানে সরকারি মিলে প্রয়োজন হয় ৬৫-৭০ জন! ফলে বাড়ে মজুরির ব্যয়, গুনতে হয় লোকসান।

লোকসান গুনতে গুনতে বন্ধ হয়ে গেছে রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলো

৩) যখন পাটের মৌসুম থাকে তখন তড়িৎ সিদ্ধান্তে সুলভ মূল্যে পাট না কিনে পরে অফ সিজনে অনেক বেশি দামে পাট কেনা হয় নানা রকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অন্যান্য কারণে। এতে ১ হাজার ২০০ টাকা মণের পাট অনেক সময় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় কেনা হতো।

৪) পণ্যের বৈচিত্রতার অভাব। সরকারি পাটকল গুলো শুধু বস্তা আর কার্পেটের নিচের অংশই বানায়। অথচ গত অর্থবছরের ৮৮ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানির মধ্যে পাটসুতাই ৫৬ কোটি ডলারের যা উৎপাদন করেছে মূলত বেসরকারি পাটকলগুলো।

৫) সরকারের পাটখাতে অনুদান গুলো পাটকলের আধুনিকায়নে ব্যয় না হয়ে ব্যয় হয় শুধুমাত্র বাড়তি শ্রমিকদের বেতন ভাতা বকেয়াতে। অথচ বেসরকারি কলগুলো আধুনিক মেশিনারিজ বসিয়ে অল্প সময়েই লাভ তুলছে!

অথচ পাট নিয়ে আশাবাদী হবার মত অনেক কিছু ছিলো। যে প্লাস্টিক পলিথিন এসে আমাদের এক সময়ের সর্বোচ্চ রপ্তানি খাতকে ধ্বংস করেদিয়েছিলো সেই প্লাস্টিক পলিথিনের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানীরা সোচ্চার, মানুষের মধ্যে বাড়ছে সচেতনতা! প্রয়াত বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম ও তাঁর দল ২০১০ সালে তোষা পাট ও ২০১২ সালে পাটের ক্ষতিকর ছত্রাকের জীবন রহস্য উন্মোচন করায় আশাবাদী হয়েছিলো জাতি, পাট উৎপাদনে নতুন দিগন্ত দেখবে বাংলাদেশে। আশার পালে আরো হাওয়া লাগে যখন ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুবারক আহমেদ খান ছয় বছরের গবেষণার পর “সোনালী ব্যাগ” নামে পাটের তৈরী একধরণের পলিমার আবিষ্কারের ঘোষণা দেন যা পলিথিন থেকে দেড়গুণ বেশি ভার বহনে সক্ষম হলেও মাটিতে পঁচে যাবে। অথচ এই সোনালী ব্যাগ দিয়ে শেষমেস আর বিশ্বের পলিথিনের বাজার ধরা হলো না। 

যাই হোক, সরকারি পাটকল গুলো বন্ধ ঘোষণার প্রেস ব্রিফিং এ জানানো হয়, সরকারি পাটকলগুলোকে আবার প্রতিযোগিতায় কীভাবে আনা যায় এবং কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, সে বিবেচনায় এখন পাটকলগুলো বন্ধ করার ঘোষণা করা হয়েছে, সংস্কার ও আধুনিকায়ন করে বেসরকারি কলগুলোর সাথে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার মত উপযোগী করে আবার চালু করা হবে, নিয়োগ দেওয়া হবে পুরানো শ্রমিকদেরই।

আমরাও আশাবাদী হতে চাই। আমরাও চাই প্রতিটি পাটকলের পুরানো মান্ধাতা আমলের যন্ত্রগুলো ফেলে দিয়ে অত্যাধুনিক ম্যাশিনারিজ দিয়ে কলগুলোকে আবার চালু করা হবে, চাকরি হারানো শ্রমিকেরা আবারো ফিরে পাবে তাদের চাকরি আর সরকারি পাটকলগুলো দেখবে লাভের মুখ! 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা