'১০ হাজার টাকা দামের বঁটি কোনোদিন চোখেও দেখি নাই'
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
রান্নাঘরে যে বঁটি দিয়ে আমরা মাছ-তরকারি কাটি সেটার দাম ১০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। ফেসবুকে একজন লিখেছেন, বিল গেটসের বাড়িতেও তো দশ হাজার টাকা দামের বঁটি দিয়ে কাটাকুটি হয় না!
সরকারী প্রকল্পের টাকা নিয়ে প্রচুর নয়ছয় হয়, এটা নতুন কোন ঘটনা না। একটা কাজে সত্যিকারের ব্যয় যা হয়, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি বাজেট দেখিয়ে কিছু অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের পকেট ভারী করেন, কখনও অপ্রয়োজনীয় কারণে অযথাই বিদেশ ভ্রমণ করেন, এসবও আমাদের খুব একটা বিচলিত করে না। তারা সরকারী অফিসার, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তারা পরাক্রমশালী, সংবিধানে দেশের মালিক হিসেবে জনগনের নাম লেখা থাকলেও, বাস্তবতা হচ্ছে, এদেশের সত্যিকারের মালিক রাজনীতিবিদ আর সরকারী কর্মকর্তারাই।
কিন্ত এই লোকগুলোর কাছে আমাদের একটা প্রত্যাশা থাকে, চুরির স্ক্রিপ্টটা যাতে বাস্তবসম্মত হয়। তামিল-তেলুগু সিনেমার মতো অবাস্তব চিত্রনাট্য সাজিয়ে চুরি করতে গেলে তা চোখে পড়বেই, সেটা নিয়ে সমালোচনাও হবেই। সেটা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বালিশ বা কেটলি কেনার ঘটনাই হোক, আইসিইউ'র জন্য লাখ টাকায় পর্দা কেনার ঘটনাই হোক, কিংবা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের জন্য দশ হাজার টাকায় বটি কেনার ঘটনাই হোক- এমন আকাশ-পাতাল অসঙ্গতি দেখলে লোকে তো আঙুল তুলবেই, তাই না?
খবরে দেখলাম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক প্রকল্পে রান্নাঘরে যে বটি দিয়ে আমরা মাছ-তরকারি কাটি সেটার দাম ১০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। আমাদের মায়েরা যে বয়ামে মশলা রাখে সেই বয়ামের দাম রাখা হয়েছে দুই হাজার টাকা, যে চামচ দিয়ে শরবত বা চা গুলে খাই, পাতিল থেকে তরকারী নিই, সেগুলোর একেকটার দাম ধরা হয়েছে পাঁচশো-এক হাজার টাকা!
গোটা ব্যাপারটা একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলাম। বটির দাম দশ হাজার টাকা, এই বটিতে কি স্বর্ণের কোন প্রলেপ লাগানো আছে কিনা কে জানে! চামচগুলো হয়তো রূপা দিয়ে তৈরী, নইলে তো এত দাম হবার কথা নয়। আগেকার দিনে রাজা বাদশারা সোনার থালায়, রূপার চামচে খেতেন। আমাদের দেশের সরকারী কর্মকর্তাদের কেউ কেউ নিজেদের রাজা-বাদশা মনে করতেই পারেন, তাই হয়তো জিনিসগুলোর এত দাম।
ফেসবুকে একজন লিখেছেন, বিল গেটসের বাড়িতেও তো দশ হাজার টাকা দামের বটি দিয়ে কাটাকুটি হয় না! ওই ভদ্রলোক বোধহয় জানেন না, বিল গেটস। বিলিওনিয়ার-ট্রিলিওনিয়ার হতে পারেন, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হতে পারেন, কিন্ত রাজা-বাদশাহ তো আর নন। বিল গেটস যেসব টিশার্ট পরে ঘুরে বেড়ায়, সেগুলো বঙ্গবাজারে একশো টাকা পিস হিসেবে কিনতে পাওয়া যায়। বিল গেটস যেভাবে বার্গার কেনার জন্য লাইনে দাঁড়ান, সেভাবে আমাদের এই রাজা বাদশাহরা জীবনে দাঁড়াবেন? কল্পনা করতেও তো কষ্ট হয় দৃশ্যটা!
এই বাদশাহদের খাওয়ার জন্য ৭২০টা থালা-বাসন কেনা হবে, সেগুলোর দাম ধরা হয়েছে সাত লাখ বিশ হাজার টাকা, প্রতিটার দাম দশ হাজার করে। রাইস ডিশ প্রতিটা ৩ হাজার, তরকারি ডিশ ২ হাজার, নন-স্টিক ফ্রাই প্যান ৫ হাজার, বড় চামচ ১ হাজার এবং মাঝারি চামচ প্রতিটি ৫০০ টাকা করে ধরা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি ছুরি ২ হাজার, বড় তরকারি কাটার কাচি প্রতিটি ২ হাজার, দুই চুলার গ্যাস স্টোভ ১০ হাজার, শীল কড়ই কাঠের রুটি মেকার ৫ হাজার, শিলপাটা ৫ হাজার টাকা করে প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে।
১৪" সাইজের ল্যাপটপের দাম ধরা হয়েছে ১ লাখ ত্রিশ হাজার টাকা করে, অথচ বাজারে এই স্পেসিফিকেশনের ল্যাপটপ ৫০/৬০ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। এসির দাম ধরা হয়েছে প্রতিটা দুই লাখ টাকা করে, অথচ দুই টনের সবচেয়ে দামী এসিটার দামও বাংলাদেশে এক লাখ টাকার বেশি না!
এমন অদ্ভুত দামে বাংলাদেশের কোন বাজারে জিনিস বিক্রি হয়, সেটা আমাদের জানা নেই। জানেন না নিউমার্কেটের কিচেন মার্কেটের ব্যবসায়ীরাও। তারা বলেছেন, নন-স্টিক ফ্রাই প্যান ২০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৫০০ টাকা পর্যন্ত আছে। এছাড়া সর্বোচ্চ ৩০ টাকায় চা চামচ, ১৫০ টাকায় মাঝারি চামচ ও আড়াইশ টাকায় বড় চামচ পাওয়া যায় বলেও জানান তারা। এদিকে বটির দাম সর্বোচ্চ ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার হতে পারে বলে জানিয়েছেন কাওরান বাজারের লোহার জিনিসের ব্যবসায়ী রইসুল। তিনি আরেকটা মজার কথা বলেছেন- "এতদিন ধরে ব্যবসা করলেও, ১০ হাজার টাকা দামের বঁটি কোনোদিন চোখে দেখি নাই।"
আরেকটা মজার জিনিস শুনবেন? এই মূল্যতালিকা কিন্ত প্রস্তাব করা হয়নি, এটা ইতিমধ্যেই পাশ হয়ে গেছে, এই ভুতুড়ে দামেই সরকারী টাকার অপচয় করে কেনা হবে জিনিসপত্র। পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান প্রকল্পের জিনিস কেনায় এই ভুতুড়ে দামের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ে বলেছেন, তাই নাকি! আমরা অবশ্য মন্ত্রীর মতো আকাশ থেকে পড়িনি, আমরা জানি, কিছু লোক দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে, খাবে, খাতটা স্বাস্থ্য হোক, প্রযুক্তি হোক, কিংবা হোক কৃষি- লুটপাটের এই মহোৎসব বন্ধ হবে না।
রিজেন্ট শাহেদ কিংবা জেকেজির সাবরিনারা ধরা পড়ে বলে আলোচনা হয়, বটির দাম দশ হাজার টাকা বানানো রাজা-বাদশাহরা কখনও ধরা পড়বেন না, বড়জোর এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে বদলি হবেন, নতুন করে চালাবেন লুটপাটের আসর, আমরা দেখব নতুন বোতলে পুরনো মদ- এইতো!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন