রাশমনি, সোমলতা এবং চৈতালি। একটি গয়নার বাক্সের আবর্তনে পরিচালক অপর্ণা সেন রাশমনির দৃঢ়তা, সোমলতার স্বনির্ভরতা এবং চৈতালির মুক্তমনা মনোভাবের এক আশ্চর্য চিত্রায়ন তুলে ধরেছেন পর্দায়...

'মিস ক্যালকাটা 1976' খ্যাত অভিনেত্রী অপর্ণা সেন পরিচালক হিসেবেও একইভাবে দর্শকদের চমৎকৃত করেছেন ‘পারমিতার একদিন’, 'দ্য জ্যাপানিজ ওয়াইফ', ‘ইতি মৃণালিনী’ র মত অনবদ্য সব চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত ‘গয়নার বাক্স’ চলচ্চিত্রটিও তার ব্যতিক্রম নয়। ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রে ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ এর প্রেক্ষাপটকে অবলম্বন করে অপর্ণা সেন তুলে ধরেছেন একটি গয়নার বাক্সকে ঘিরে তিন প্রজন্মের তিনজন নারীর জীবন উপাখ্যান এবং তৎকালীন সমাজ জীবনের চিত্রপট।

রাশমনি

রাশমনি, আদৌতে যিনি গয়নার বাক্সের প্রকৃত অধিকারী। আয়ুষ্কালে যিনি ১১ বছর বয়সে 'বিয়ে' নামক অনিবার্য সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং বিবাহিত জীবনের পূর্ণ অভিজ্ঞতা নেওয়ার আগেই ‘বৈধব্য’ শব্দটিকে আমৃত্যু সঙ্গী করে নেন। অনিন্দ্য রূপসী রাশমনি তৎকালীন সমাজের বাস্তবতার বেড়াজালে আটকে পড়ে জলাঞ্জলি দেন নিজের সকল চাহিদা, ইচ্ছা, আহ্লাদ এবং সর্বোপরি নিজের নারীত্ব। রাশমনির বলা সংলাপ থেকেই আন্দাজ করা যায় তার জীর্ণ জীবনের অভিজ্ঞতা, “শুটকি রান্না হইত আমাগো ফরিদপুরে। লবণ-মরিচ দিয়া, জ্বাল গড়গড়া কইরা। কত কাল খাইনা! স্বাইদি ভুইলা গেসি গিয়া”

রাশমনি

দৃশটি হাস্যরসাত্মক হলেও রাশমনির বলা বাক্যের গূঢ়ার্থে তার বৈধব্যের হাহাকার স্পষ্টই বটে। নিজের অর্থহীন জীবনের সব আকাঙ্ক্ষা এবং একমাত্র অবলম্বন খুঁজে পান একটি গয়নার বাক্সে। ৫০০ ভরির সোনার গহনায় পূর্ণ বাক্সের মোহ রাশমনি ছেড়ে যেতে পারেননি মৃত্যুর পরেও। তার কাছে জগৎের সবাই শঠ ও ভণ্ড। নিজেকে ছাড়া তিনি বিশ্বাস করেন না কাউকে। বাক্সটি যাতে বেহাত না হয়ে সেজন্য মৃত্যুর পরে ভূত হয়ে বাক্সটিকে আগলে রাখেন যক্ষের ধনের মতো। সাহায্য নেন ভাইয়ের নবপুত্রবধূর কিংবা বলা যায় একরকম ভয় দেখিয়ে বাধ্য করেন বাক্সটিকে আশেপাশের যত লোভী চোখগুলোর অগোচরে লুকিয়ে রাখতে।

সোমলতা

নবোঢ়া সোমলতা অত্যন্ত দরিদ্র এক ঘটি বাঙ্গালি বাড়ির মেয়ে। তার বিয়ে হয়েছে ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর ভারতে চলে আসা এক প্রাক্তন জমিদার পরিবারে। জমিদারির সব জমি পূর্ব বাংলায় ছেড়ে আসলেও তাদের রয়েছে পাকা দালান আর তুচ্ছ জমিদারি ঠাট। স্বামী, শ্বশুর, ভাসুর প্রত্যেকেই নিষ্কর্মা। বাড়ির আসবাবপত্র বিক্রি করে দিনকাল কাটাতেই তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ কাজ করা আর বংশের আভিজাত্যকে কলুষিত করা তাদের কাছে একই। আর নববধূ সোমলতা এই ঠুনকো দম্ভেই ভয়ে তটস্থ।

তার উপর স্বামীর পিসিমা মৃত্যুর পর ভূত হয়ে যখন একটি গয়নার বাক্সের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন তার ঘাড়ে, তখন সবার লুব্ধ দৃষ্টি এড়িয়ে সেটিকে লুকিয়ে রাখাও ছিল মহাঝঞ্ঝাট। অবশ্য সোমলতা কিন্তু গয়নার বাক্সের মোহে না পড়ে বরং তার একটি কার্যকরী উপযোগিতা খুঁজে বের করে। নিজের কিছু গয়নার সাথে পিসিমার বাক্সের একটি হার বন্ধক রেখে সে ব্যবসায় খাটানোর পুঁজির ব্যবস্থা করে। অকর্মা স্বামীকে কর্মঠ করার প্রয়াসে এবং শ্বশুরবাড়ির আর্থিক অচলাবস্থা দূর করতে গৃহিণী থেকে ব্যবসায়ী রুপে আবির্ভূত হয় সোমলতা।

সোমলতা

প্রাথমিক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নিজের শাড়ির দোকানের সুখ্যাতি বয়ে আনতে সফল হয় সে। এদিকে পিসিমা অর্থাৎ রাশমনি কিন্তু শুরুতে সোমলতাকে ভর্ৎসনা করলেও সোমলতার মাধ্যমেই খুঁজে পান নিজের স্বীকৃতি, আত্মপরিচয়। রাশমনির নামেই সোমলতা দোকানের নাম রাখে। জীবনকালে যা হয়নি মৃত্যুর পরেই সেই নিজের অযাচিত বোঝা না হওয়ার পরিচয় পান। এভাবেই বছর বেশ কয়েক পড়ে সোমলতার কোলে যখন চৈতালি আসে তখন আর পিসিমা দেখা দেন না সোমলতাকে। এখন তিনি চৈতালির সঙ্গী।

চৈতালি

চৈতালি আধুনিক, স্বাধীনচেতা এবং মোহ-মায়ার বেড়াজালের ঊর্ধে। তার চিন্তা পূর্ববাংলার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তার সবটা জুড়ে আছে তার কলেজ, বন্ধুবান্ধব আর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী বেনুদাদা। চৈতালি ১৯৭১- এর উত্তাল হাওয়ায় ১৮ বছর বয়সী এক তরুণী। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়, “স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি”।

চৈতালী

চৈতালি যেদিন ১৮ তে পা দেয়, সেদিন সোমলতা বাক্সটি তার মালিকানায় গোচ্ছিত রাখেন। অবশ্য চৈতালির তাতে কোনো আকর্ষণ না থাকলেও রাশমনির ইচ্ছাতেই সে গয়নার বাক্সটি তুলে দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। যার ফলশ্রুতিতে গয়নার বাক্সের সাথে রাশমনির আত্মা বন্ধনমুক্ত হওয়ার দৃশ্যায়নের মাধ্যমেই সমাপ্তি ঘটে ‘গয়নার বাক্স’র শেষ দৃশ্যের। 

রাশমনি, সোমলতা এবং চৈতালি। একটি গয়নার বাক্সের আবর্তনে পরিচালক অপর্ণা সেন রাশমনির দৃঢ়তা, সোমলতার স্বনির্ভরতা এবং চৈতালির মুক্তমনা মনোভাবের এক আশ্চর্য চিত্রায়ন তুলে ধরেছেন পর্দায়। তৎকালীন সময় তো বটেই, এই একুশ শতকেও তারা প্রত্যেকেই নিজস্ব আঙ্গিকে অতুলনীয় এবং প্রত্যেকেই একেকটি অনুপ্রেরণা।

*

প্রিয় পাঠক, এই লেখাটি একজন কন্ট্রিবিউটর লিখেছেন। চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা