গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের একটি অতি প্রচলিত রেওয়াজ- সবাই মিলে একসাথে তাদের গ্র্যাজুয়েশনের টুপি শূন্যে ছুঁড়ে মারা। কখনও কি ভেবে দেখেছেন, এর পেছনে আসল কারণ কী?

রেকর্ড সংখ্যক গ্র্যাজুয়েট নিয়ে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান, প্রতিবারই অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছাপিয়ে যায় আগের আয়োজনটিকে। আর এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে সমাবর্তনের আগে ও পরের কয়েকদিন ধরেই অনলাইন সরগরম থাকে। গ্র্যাজুয়েটদের বিভিন্ন রকম ছবিতে সয়লাব হয়ে যায় গোটা ফেসবুক। কেউ কেউ গ্র্যাজুয়েশনের গাউন-টুপি পরে নান সাজে, কেউ বা আবার নাগিন। 

কেউ এক গাউনের সাথে আরেক গাউনে গিট্টু পাকিয়ে রেলগাড়ি বানায় তো কেউ আবার ভালোবাসার মানুষের সাথে প্রকাশ্যে চুমু খেয়ে সেই ছবি ফেসবুকে দেয়। কেউ কেউ নিজের গাউন-টুপি খুলে পরিয়ে দেয় বাবা-মাকেও। এভাবে সমাবর্তন সম্পর্কিত প্রায় সব ছবিই ভাইরাল হয়। হাজার হাজার লাইক-শেয়ার হয়। তবে হঠাৎ করে যদি আপনাকে সমাবর্তনের কথা বলা হয়, কোন দৃশ্যটি ভেসে উঠবে আপনার মানসপটে? গত কয়েক বছর ধরে দেখা ছবিগুলোর একটি? নাকি অন্য কোনো ছবি?

সাম্প্রতিক সময় দেখা ছবিগুলোর মধ্যে কোনো একটি যদি আপনার হৃদয়ে খুব গভীরভাবে দাগ কেটে না থাকে, তাহলে শতকরা ৯০ ভাগ সম্ভাবনা যে সমাবর্তন সংস্লিষ্ট সবচেয়ে পরিচিত ছবিটিকেই আপনি কল্পনা করে নেবেন। কোন ছবি সেটি? সেটি হলো সকল গ্র্যাজুয়েট আনন্দোল্লাসের এক পর্যায়ে একসাথে তাদের মাথা থেকে টুপিটি নিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে মারছে। কখনও কি ভেবে দেখেছেন, কেন এই কাজটি করে তারা? কবে প্রথম এই কাজটির প্রচলন ঘটেছিল? আর কীভাবেই বা সেটি একটি অবশ্যপালনীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে? চলুন সেই কাহিনীই জানাই আপনাদের। 

প্রথম এই ঐতিহ্যের প্রচলন ঘটে ১৯১২ সালে, ইউএস নেভাল অ্যাকাডেমির গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে। ঠিক যে-বছর ডুবে গিয়েছিল আরএমএস টাইটানিক। তাই অনেকের মধ্যেই ভুল ধারণা জন্মে গিয়েছে যে, টাইটানিক ট্র্যাজেডিতে মৃতদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেই হয়ত সেদিনের গ্র্যাজুয়েটরা আকাশপানে ছুঁড়ে মেরেছিল তাদের টুপিগুলো। আসলে বিষয়টি তেমন কিছুই ছিল না। গোটা বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে আপনাদের আগে জানা থাকা লাগবে উনিশ শতকের শেষ ভাগে এবং বিংশ শতকের শুরুর দিকে ইউএস নেভিতে ব্যবহৃত পদবীগুলো সম্পর্কে।

১৮৮৩পর্যন্তর‍্যাংক: যারা নেভাল অ্যাকাডেমিতে পড়াশোনা করেছে অর্থাৎ নেভাল অ্যাকাডেমির শিক্ষার্থী যারা নেভাল অ্যাকাডেমিতে পড়াশোনা করেছে + দুই বছর 'সি সার্ভিস' এ কাজ করেছে = নেভাল ক্যাডেট

নেভাল ক্যাডেল + 'এনসাইন' হিসেবে নিয়োগের অপেক্ষায় আছে = জুনিয়র এনসাইন। 

১৮৮৪ সালে এনসাইন হিসেবে নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা পদটি বাতিল করা হয়, এবং জুনিয়র এনসাইনদের শুধু এনসাইনের পদমর্যাদা দেয়া হয়। জুনিয়র এনসাইনরা যে লেইস পরত, তা এবার নেভাল ক্যাডেটরা পরতে শুরু করে। ১৯০২ সালে এসে নেভাল ক্যাডেটদেরকে 'মিডশিপম্যান' বলে ডাকা শুরু হয়। ১৯১২ সালে দুই বছর ধরে 'সি সার্ভিস' করার পদটি বাতিল করা হয় এবং নেভাল অ্যাকাডেমিতে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদেরকেই 'মিডশিপম্যান'-এর মর্যাদা প্রদান করা হয়। বর্তমানেও শিক্ষার্থীদেরকেই 'মিডশিপম্যান' বলা হয় আর এর পরের পদমর্যাদাই হলো 'এনসাইন'। 

যাই হোক, ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। ১৯১২ সালে যখন 'সি সার্ভিস' পদমর্যাদাটির বিলুপ্তি ঘটল, শিক্ষার্থীদেরকে তাদের নতুন পদবীসহ নতুন টুপি প্রদান করা হলো। ইতিপূর্বে তাদেরকে পূর্বতন পদমর্যাদার টুপি সংরক্ষণ করে রাখতে হতো এবং পরবর্তীতে সি সার্ভিসে গিয়ে সেটি পরতে হতো। কিন্তু সি সার্ভিসই যখন আর থাকল না, তখন ওই পুরনো টুপিগুলোর প্রয়োজনীয়তাও ফুরোল।

সেজন্য ১৯১২ সালে অনুষ্ঠিত সেই গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে তারা তাদের পুরনো টুপিগুলো শূন্যে ছুঁড়ে মারল, এবং পরে আর সেগুলোকে সংগ্রহেরও প্রয়োজন বোধ করল না। তবে কেউ কেউ করল কী, টুপির ভিতর সামান্য কিছু টাকা আর তাদের নাম-ঠিকানাও লিখে রাখল। তাদের দেখাদেখি পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীরাও একই রীতি মেনে চলতে থাকে, এবং কালের বিবর্তনে এক পর্যায়ে এই ছেলেমানুষি রীতিটিই পরিণত হয় একটি ঐতিহ্যে। 

তবে এখানে মজার বিষয় হলো, ১৯১২ সালে নেভাল অ্যাকাডেমির শিক্ষার্থীরা শূন্যে টুপি ছুঁড়ে মেরে তাদের পুরনো পদবীকে বিদায় জানালেও, এখনকার সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীরা শূন্যে টুপি ছুঁড়ে মেরে আসলে নতুন প্রাপ্ত কোনো না কোনো পদবীকে অভ্যর্থনা জানায়। 

(ফিচার্ড ইমেজ কৃতজ্ঞতা : আফসার রাজু)

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা