বিশ্বনেতারা যখন উদাসীন, তখন কিশোরী একটা মেয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, লড়ে যাচ্ছে পরিবেশ রক্ষায়। এক মিলিয়ন ইউরো পুরস্কার জিতে পুরোটাই সে দান করে দিয়েছে বন্যা আর জলবায়ু পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য, সেই টাকার একটা অংশ আসছে বাংলাদেশেও...
গত বছরের শেষদিকে একটি এনভায়রনমেন্টাল অটাম স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। এর আগেও পেপারে পরিবেশগত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নিয়মিত লিখেছি। এই লেখাগুলো লিখতে লিখতে এবং এই অটাম স্কুলে গিয়ে আমার যে উপলব্ধিটি পাকাপোক্ত হয়েছে, সেটা হচ্ছে, আমরা সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল প্রকৃতির ওপরে। এবং আমরা সবচেয়ে বেশি উদাসীনও প্রকৃতি নিয়ে। আমাদের চারপাশে এত এত সব প্রত্যক্ষ সমস্যা রয়েছে যে, যার কারণে পরিবেশের পরোক্ষ ভূমিকাটাই আমরা বেমালুম ভুলে যাই।
তবুও এটা ঠিক, গত বেশ কয়েক বছর ধরে মানুষ সচেতন হচ্ছে এনভায়রনমেন্ট, ক্লাইমেট চেঞ্জ, এনভায়রনমেন্টাল পল্যুশন এসব নিয়ে। কথাবার্তা হচ্ছে প্রচুর। তাছাড়া বেশ কিছু পাবলিক ফিগারও আমরা পেয়েছি এই সংক্রান্ত। তবে এসব জনপ্রতিনিধির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বোধহয় একটি নাম- গ্রেটা থুনবার্গ। যার বয়স মাত্র ১৭ বছর!
গ্রেটা ২০১৮ সাল থেকেই গ্লোবাল ফিগার। আল জাজিরা, রয়টার্স, গার্ডিয়ান, বিবিসি'তে নিয়মিত ও জনপ্রিয় মুখ এই ছোট্ট মানুষটি। অবশ্য তার এরকম জনপ্রিয়তার পেছনে কারণও আছে। ২০০৩ সালে জন্ম নেয়া গ্রেটা ৮ বছর বয়সে থাকাকালীন সময়ে জানতে পারে পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতার কথা। গ্লেসিয়ার গলে যাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, ওজোনস্তর ফুটো হয়ে যাচ্ছে, বাতাসে বাড়ছে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন... গ্রেটা যতই এসব নিয়ে ভাবছিলো, ততই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলো। এভাবে ভাবতে ভাবতে মানসিকভাবেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলো মানুষটি।
এগারো বছর বয়সে এসে খাওয়াদাওয়া এবং কথা বন্ধ হয়ে যায় তার। ওজন কমতে থাকে পাউন্ডের পর পাউন্ড এবং কথার পরিমান দাঁড়ায় ঠিক যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু। ডাক্তার দেখানো হয়। ডাক্তারও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা সমস্যা। বাবা-মা'ও মেয়েকে নিয়ে হয়ে পড়েন উদ্বিগ্ন। গ্রেটা পরবর্তীতে এসে জানান, পরিবেশের ও জলবায়ুর সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদ না করতে পারার জন্যে ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছিলো সে। তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। দেখা দেয় বিভিন্ন রকমের ডিজঅর্ডার।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে এসে প্রথমবারের মত সে প্রতিবাদ করে পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে। ২০১৮ এর আগস্টে গ্রেটা ব্যক্তিগতভাবে এই প্রতিবাদ শুরু করেন এবং সেটি সে সময় মিডিয়াতে প্রচুর সাড়া ফেলে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে স্কুলে অবরোধের ডাক দেয় সে।। ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ ১১২টি দেশের আনুমানিক ১.৪ মিলিয়ন শিক্ষার্থী তার ডাকে সাড়া দিয়ে জলবায়ু প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলনেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এরপরেই গ্রেটা ক্রমশ সুইডেনের গন্ডি পেরিয়ে হয়ে ওঠে গ্লোবাল গ্রেটা।
২০১৮ সালে প্রকাশিত গ্রেটার Scener ur hjärtat অথবা 'সিনস ফ্রম দ্য হার্ট' বইয়ের থেকে জানা যায়- জলবায়ু পরিবর্তন রোধে গ্রেটা তার পরিবারকেও শুধরেছে তার মত করে। গ্রেটা'র মা সঙ্গীতশিল্পী। তাকে মাঝেমধ্যেই বিমানে করে এখান থেকে ওখানে যেতে হতো পারফর্ম করার জন্যে। কিন্তু বিমান থেকে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরিত হয়, সেটা পরিবেশের জন্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। তাই গ্রেটা মা'কে বিমানে উঠতে নিষেধ করে। যে পথ বিমানে যেতে লাগতো আধাঘন্টা, সে পথ অন্য বাহনে যাওয়ার কারণে যেতে লাগে দেড়-দুই দিন। তবে গ্রেটার সাফ কথা, সময় যাই লাগুক, পরিবেশের ক্ষতি করা যাবেনা মোটেও। বাবাকেও উঠতে দেয়না বিমানে, নিজেও ওঠেনা। গ্রেটার মা'কে শেষপর্যন্ত গান গাওয়াই ছাড়তে হলো। সময় মত পারছিলেন না কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী জায়গাগুলোতে যেতে।
এখানেই থেমে নেই গ্রেটার কাজ। পরিবারের সবাইকে সে নিরামিষাশী হতেও বাধ্য করেছে। কার্বন নিঃস্বরন না করার জন্যে যা যা করা দরকার, সবই করিয়েছে পরিবারকে দিয়ে।
গ্রেটা তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ২০১৯ সালের মার্চে নরওয়ের তিন জন সংসদ সদস্য তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে। এছাড়াও ফ্রিট অর্ডার পুরষ্কার (২০১৯), রাহেল কারসন পুরষ্কার (২০১৯), Ambassador of Conscience Award (২০১৯), রাইট লাইভলিভির পুরষ্কার (২০১৯),টাইম বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব (২০১৯) সহ অজস্র পুরষ্কারে সম্মানিত হয়েছে। এবং তার কাজ থেমে নেই মোটেও। বিভিন্ন সভা-সেমিনার, জাতিসংঘের অধিবেশনে নিয়মিত কথা বলছেন তিনি। এনভায়রমেন্ট নিয়ে তার চিন্তাভাবনাও চলছে সে সাথে।
২০২০ এর ২০শে জুলাই গ্রেটা ‘গুলবেনক্যিয়া প্রাইজ ফর হিউম্যানিটি’ পুরস্কারে ভূষিত হন। যার অর্থমূল্য ১ মিলিয়ন ইউরো। এই টাকার পুরোটাই সে দান করে গ্লোবাল সাউথের বন্যা পরিস্থিতি, জলবায়ু পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যে। 'গ্রেটা থুনবার্গ ফাউন্ডেশন' এর উদ্যোগে গ্লোবাল সাউথে ব্যয়কৃত এই টাকা থেকে এক লাখ ইউরো পাবে বাংলাদেশ ও ভারতও।
এটাই অবাক লাগে আসলে। অনেক হোমড়াচোমরা মানুষেরও হয়তো বৈশ্বিক এ বিষয়গুলো নিয়ে খেয়াল নেই। তারা দেদারসে ভাঁওতাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন কাজকর্মে পরিবেশকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে খাদের কিনারে। অথচ একই সে পৃথিবীতে গ্রেটা থুনবার্গের মতন একরত্তি শিশু দাঁড়িয়ে যাচ্ছে পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে, সোচ্চার হচ্ছে, কথা বলছে নিয়মিত।
কী বৈপরীত্য আশেপাশে! সাদা-কালোর কী বিমূর্ত ক্যানভাস আমাদের চারপাশেই!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন