ভারতের উত্তরপ্রদেশ, যেখানে ধর্ষণ হয় মুড়িমুড়কির দরে, সেখানেই জন্ম নিয়েছে চার লাখ নারীর সংগঠন- গুলাবি গ্যাং। তাদের উদ্দেশ্য একটাই, অন্যায়কারীর শাস্তি নিশ্চিত করা। সেটা তারা কীভাবে করেন? কীভাবে জন্ম গুলাবি গ্যাং এর?

দেশে প্রত্যেকদিন যখন একটার পর একটা ধর্ষণের খবর শুনছি আমরা, আমরা বিপর্যস্ত হচ্ছি। আমরা কী করবো, আমরা জানি না। শ্বাপদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস থেকে নিজেদের কীভাবে রক্ষা করবো, সে প্রশ্নেরও উত্তর নেই৷ রাষ্ট্রযন্ত্রও ঠুটোঁ জগন্নাথ হয়ে বসে থাকছে। তার মুখেও রা নেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাঁড়ানোই নিয়ম। এক্ষেত্রেও সময় এসেছে প্রতিবাদের। তবে সে প্রতিবাদের ক্ষেত্রে আমরা অনুসরণ করবো কাদের? সে নিয়ে বলছি। আমাদের এ প্রতিবাদ হতে পারে ভারতের 'গুলাবি গ্যাং' এর মতন। যারা খুব কম সময়ের মধ্যে পরিণত হয়েছে নির্যাতিত মানুষদেরই আস্থার প্রতীকে।

ভারতে ধর্ষণের পরিসংখ্যান ঠিক কতটা মর্মান্তিক পর্যায়ে আছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দেবার আর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে বাংলাদেশের মতন ভারতও খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। কয়দিন আগেই উত্তর প্রদেশের দলিত সম্প্রদায়ের এক মেয়ে 'মনীষা বাল্মিকী'র ধর্ষণ ও তার লাশ তাড়াহুড়ো করে পুলিশের পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে সারা দেশ। নির্ভয়ার ঘটনার সময়ে পুরো দেশ যেভাবে একাট্টা হয়েছিলো, সেরকমই হয়তো তীব্র আন্দোলন হতে যাচ্ছে সামনে। এরকম এক টালমাটাল এবং সংক্ষুব্ধ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই।

যাই হোক, প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছি। মূল কথায় আসি। ভারতের উত্তরপ্রদেশ বরাবরই ধর্ষণের নন্দনকানন। শুধুমাত্র এই অঞ্চলে যে পরিমাণ ও যে মাত্রার ধর্ষণ হয়েছে, তা ভাবলে চমকিত হবেন যে কেউই। শুধুমাত্র গত বছরেই উত্তর প্রদেশে ১৯৬৩ জন ধর্ষণ, ৭৯১০ জন অপহরণ ও ২২৪৪ জন নারী যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যে অঞ্চলে ধর্ষণের এত রমরমা অবস্থা,  গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই অঞ্চলেই আবার জন্ম হয়েছে কিছু বিপ্লবীর। হয়তো সময়ের প্রয়োজনেই। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া বিপ্লবী ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মী বাঈ, ডাকাত ফুলন দেবী এবং সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর মতো নারীরা তাদের সময়ে তাদের মত করেই শাসন করেছেন তাদের অঞ্চলকে। ঠিক সেই অঞ্চলেই  জন্ম নিয়েছে 'গুলাবি গ্যাং' নামের এক সংগঠন। সাম্পাত দেবী পাল নামের এক মহিলার নেতৃত্বে।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে বরাবরই লাঠি হাতে প্রস্তুত তারা

গুলাবি গ্যাং এর জন্মঘটনা একটু অদ্ভুত। আশির দশক তখন। সাম্পাত দেবী পালের এক প্রতিবেশি তার স্ত্রী'কে তীব্রভাবে মারছিলেন। এটা দেখে সহ্য করতে না পেরে সাম্পাত গিয়ে লাঠি দিয়ে সেই লোকটিকে মারা শুরু করেন। লোকটি মাফ চেয়ে পার পায় সাম্পাতের আক্রমণ থেকে। তখনই সাম্পাতের মাথায় আসে, এভাবে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যদি দমন করা যায় এসব অত্যাচারীদের, তাহলে বেশ ভালো হয়। অবিচারের বিরুদ্ধে বেশ শক্তপোক্ত এক ভিত্তিভূমি হয়। তিনি গড়ে তুললেন 'গুলাবি গ্যাং'। স্থানীয় সব নারীকে যুক্ত করলেন তিনি সেখানে। গড়ে উঠলো নারী আন্দোলনের এক দুর্বার কেন্দ্র। এই গ্যাং ছড়িয়ে পড়লো আশেপাশের এগারোটি জেলায়।

এই সংগঠনের বর্তমান সংখ্যা চার লাখের বেশি

গুলাবি গ্যাং এর ইউনিফর্ম গোলাপি শাড়ি এবং অস্ত্র লাঠি। যখনই কোথাও তারা অন্যায়ের খবর পান, চলে যান লাঠি নিয়ে সেই অন্যায়কারীকে শায়েস্তা করার জন্যে৷ ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ সহ সব অপকর্মের বিরুদ্ধেই সোচ্চার তারা। তবে প্রথমেই তারা কাউকে মারতে যান না। শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসার চেষ্টা করেন প্রথমে। সমঝোতার চেষ্টা করা, মানববন্ধন-মিছিল-সমাবেশ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার চেষ্টা করেন। তাতেও কাজ না হলে তারা চরমপন্থা অবলম্বন করেন। মেরে ধরে অন্যায়কারীকে শুধরে দেন। গুলাবি গ্যাং'কে সমীহ করে রাজ্য সরকার এবং পুলিশও। তাদের সদস্য সংখ্যা এতই বেশি ও তারা এতই সাহসী, সমীহ করা ছাড়া উপায়ও নেই। এবং তারা বেআইনি কিছু করেনও না। তারা যা করেন, সেটা এলাকার সাম্যাবস্থার জন্যেই। মানুষের ভালোর জন্যেই।

যেসব নারী নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন, সেসব নারী হতে পারেন 'গুলাবি গ্যাং' এর সদস্য। সবমিলিয়ে এই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা চার লাখের বেশি। গুলাবি গ্যাং'কে কেন্দ্র করে সিনেমা, ডকুমেন্টারি হয়েছে। এ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে এই সংগঠন। তবে 'গুলাবি গ্যাং' থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষা দৃশ্যমান, একত্রিত হয়ে অন্যায়কে দমন করার শিক্ষা। নারী, যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই তারা দুর্বল, তাতেও সমস্যা নেই। অনেকগুলো নারী একত্রিত হয়ে যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, সাফল্য তখন আসবেই। আসতে বাধ্য। এবং এরকম গুলাবি গ্যাং গড়ে ওঠা উচিত প্রত্যেক পাড়া, প্রত্যেক মহল্লায়। যখন সরকার নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ, তখন নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্যে।

দেয়ালে পিঠ তো ঠেকেই গেছে। এবার ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। এটাই সময়।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা