মি. হাচিকোর ব্যাপারে জানেন কি? লোকে বলে ভালোবাসার শক্তি অনেক। সেই অনেকটার পরিমাণ আসলে কত? যতটা হলে একটা কুকুর তার মনিবের জন্যে দশটা বছর অপেক্ষা করতে পারে!

“মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়”- মুনীর চৌধুরী লিখেছিলেন অর্ধশতাব্দী আগে। তবে কুকুরদের কথা আলাদা। প্রভুভক্তি বা বিশ্বস্ততায় এই প্রাণীটির নেই কোন তুলনা। সময় বদলায়, বদলায় না ওদের স্বভাব। ওরা বিশ্বাসঘাতকতা শেখে না মানুষের মতো, দোপেয়ে মনিবদের মতো করে পেছন থেকে ছুরি মারতে জানে না। মানুষের জন্যে নিজের জীবন দেয়ার অনেক উদাহরণ আছে এই প্রাণীটির।

তবে আজ এক অন্যরকম কুকুরের গল্প শোনাবো, মনিব মারা যাবার পরেও যে কিনা তাঁর ফিরে আসার অপেক্ষা করেছে দীর্ঘ দশ বছর ধরে! জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিদেসাবুরো উয়েনো। ১৯২৪ সালে আকিতা জাতের একটি কুকুরছানাকে শিবুয়া রেলস্টেশনে কুড়িয়ে পান তিনি। ছানাটির মা কিংবা মালিক- কেউই নেই আশেপাশে। উয়েনোর খুব মায়া হলো দেখে, কিন্ত করার কিছুই নেই। কার না কার কুকুর কে জানে! কিন্ত উয়েনো হাঁটা শুরু করতেই তাঁকে অবাক করে দিয়ে কুঁইকুঁই করে পেছন পেছন আসতে লাগলো বাচ্চাটি। উয়েনো ঘরে নিয়ে এলেন সেটিকে, বেশ অসুস্থ ছিল সে, আদর যত্ন করে সারিয়ে তোলা হলো তাকে। উয়েনো কুকুরছানাটির নাম রাখলেন হাচিকো, জাপানী ভাষায় যার মানে চারপেয়ে রাজপুত্র। 

চারপেয়ে রাজপুত্র- হাচিকো

শুরু হলো উয়েনোর সঙ্গে হাচিকোর অন্যরকম এক বন্ধুত্বের। নিয়মিত তাঁর সঙ্গে বেরুতো হাচিকো, অধ্যাপক তাঁর কর্মক্ষেত্র টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতেন ট্রেনে চড়ে। শিবুয়া স্টেশন থেকেই ট্রেনে উঠতেন তিনি, দুজনের সম্পর্কটাও শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই। হাচিকো রোজ সকালবেলা উয়েনোর সঙ্গে হেঁটে হেঁটে চলে যেতো রেলস্টেশনে; যেমন খুব আপন কাউকে আমরা এগিয়ে দিতে যাই, ঠিক সেভাবে।

আবার উয়েনোর ফেরার সময় হলেই সে বাড়ী থেকে চলে আসতো স্টেশনে। মনিবকে নিয়েই ঘরে ফিরতে সে, যেন ও না গেলে হারিয়ে যাবেন উয়েনো! রোদ-ঝড়-বৃষ্টি কিংবা তুষারপাত যাই হোক, একদিনও ব্যতিক্রম ঘটতো না এই ঘটনার, হাচিকোর মাথায় যেন অটোমেটিক কোন টাইমার সেট করা ছিল! প্রতিদিন একই রুটিন, সপ্তাহান্তে দুজনে বাইরে ঘুরতে যাওয়া তো ছিলোই। প্রবীণ উয়েনোর একঘেয়ে জীবনে দারুণ এক মাত্রা যোগ করেছিল হাচিকো। 

তবে গল্পটায় ছেদ পড়লো ১৯২৫ সালের ২১শে মে। প্রতিদিনের মতো উয়েনোকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এলো হাচিকো, যথারীতি বিকেলে সময় মেনে আবার স্টেশনে হাজির হলো সে। কিন্ত উয়েনোকে খুঁজে পেল না। পাবার কথাও নয়, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরনজনিত কারণে কর্মক্ষেত্রেই মৃত্যু হয়েছে অধ্যাপকের। কিন্ত সেটা তো আর হাচিকোকে কেউ বলে দিয়ে যায়নি। অন্য এক পথে উয়েনোর মরদেহ পৌঁছে যায় তাঁর বাড়ীতে।

হাচিকো আর উয়েনোর দ্বিপাক্ষিক ভালোবাসার গল্পটা এখানেই শেষ। এরপরের গল্পটা একতরফা ভালোবাসার, অনিঃশেষ অপেক্ষার। মানুষের সঙ্গে কুকুরের মায়ার বন্ধনের এক অসাধারণ নমুনা হয়ে আছে হাচিকো। 

সেদিন, তার পর দিন, তারও পর দিন... এমন করে মাস যায়, বছর যায়। শীত গিয়ে গ্রীষ্ম আসে, বসন্তের ফুল ফোটে জাপানজুড়ে; কখনও বৃষ্টি নামে আকাশ কালো করে, আবার কখনোবা সমস্ত কিছু ধূসর সাদা করে দিয়ে চলে তুষারঝড়। শুধু একটা জিনিস অপরিবর্তিত থেকে গেল, শিবুয়া রেলস্টেশনে অধ্যাপক উয়েনোর জন্যে হাচিকোর অপেক্ষা! প্রতিদিন বিকেলে টোকিও থেকে ফেরার ট্রেনটা থামতো শিবুয়া স্টেশনে, প্ল্যাটফর্মে ইতিউতি উঁকি দিয়ে হাচিকো খুঁজত তার মনিবকে, যদি উয়েনো ফিরে আসেন!

উয়েনোর পরিবার তাকে বেশ কয়েকবার নিয়ে গিয়েছে স্টেশন থেকে, কিন্ত ধরা রাখা যায়নি হাচিকোকে, সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মনিবকে ফিরে পাবার সে আবার ছুটে এসেছে স্টেশনে! উয়েনো ফেরেননি, না ফেরার দেশে তো তিনি চলেই গিয়েছেন। ফুরোয়নি হাচিকোর অপেক্ষার প্রহরও। রোজ বিকেল হলেই সে বাড়ী থেকে হেঁটে চলে আসতো রেলস্টেশনে।

উয়েনোর পরিবার ক’বছর পরে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল, যায়নি হাচিকো। হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন- “মৃত মানুষদের জন্য আমরা অপেক্ষা করি না। আমাদের যত অপেক্ষা সব জীবিতদের জন্যে”। কথাটা শুধু মানুষের জন্যেই ঠিক, হাচিকোর জন্যে নয়। মানুষ মরে গেলে তাকে ভুলতে অন্যদের এক মাসও লাগে না। তার জন্যে আমরা কেউ অপেক্ষাও করি না। দু-চারদিনে শোক কাটিয়ে আমাদের সবকিছুই চলতে থাকে স্বাভাবিক নিয়মে, বিপুলা পৃথিবীর ব্যস্ততায় নিজেদের ডুবিয়ে দেই আমরা। অথচ হাচিকো কোনকিছুর প্রত্যাশা থেকে নয়, শুধু বিশুদ্ধ ভালোবাসার খাতিরেই স্টেশন চত্বরে অর্ধহারে অনাহারে মনিবের ফেরার অপেক্ষায় কাটিয়েছিল দশটি বছর! 

স্টেশনে তাকে দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতো

অধ্যাপকের মৃত্যুর সাত বছর পরে তাঁর এক ছাত্র খোঁজ পায় হাচিকোর, জানতে পারে হাচিকোর এই অপেক্ষা সম্পর্কে, রোজ বিকেলে স্টেশনে এসে বসে থাকা হাচিকোকে দেখতে ছুটে আসে সে। আশেপাশের লোকজন এবং স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞেস করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, হাচিকো তো ওদের কাছে একদম চেনামুখ। মনিবের জন্যে কুকুরটার এতগুলো বছরের অপেক্ষার সাক্ষী ছিলেন ওরা সবাই। হাচিকোকে অনুসরণ করে ছাত্রটি গেলেন অধ্যাপক যে বাড়ীতে থাকতেন সেখানে, পেয়ে যান একজনকে, ওই লোক উয়েনোর বাগানে মালীর কাজ করতেন আগে। 

হাচিকোকে নিয়ে জানাশোনার পরিধিটা আরো বাড়ে তাঁর। সেই ছাত্রের উদ্যোগেই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় হাচিকোর কাহিনী, দেশের মানুষ জানতে পারে হাচিকোর সম্পর্কে, ওর অপেক্ষার কষ্টটা কাঁদায় জাপানের সাধারণ মানুষদেরও। ১৯৩৪ সালে শিবুয়া স্টেশনে হাচিকোর একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি বানানো হয়, সেটির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হাজির ছিল হাচিকো নিজেও! 

হাচিকোর অপেক্ষার অবসান ঘটে ১৯৩৫ সালের ৮ই মার্চ, হাচিকোর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। শিবুয়া রেলস্টেশনের পাশেই ওকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় এক সকালে। ওকে দাহ করে ভস্মগুলো দাফন করা হয় উয়েনোর কবরের পাশেই। হাচিকো চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছে তার মনিবের পাশেই, যার অপেক্ষায় সে কাটিয়েছিল দশটি বছর। হাচিকোর শরীরের লোমগুলো সংরক্ষিত আছে জাপানের ন্যাশনাল সায়েন্স মিউজিয়ামে। ২০১১ সালে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে রায় দেন, ক্যান্সার ও কৃমিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল হাচিকো।

ওর জন্যে প্রতিবছর ৮ই এপ্রিল শিবুয়াতে পালন করা হয় শোক দিবস। পুরো দেশ থেকেই কুকুরপ্রেমীরা হাজির হন শিবুয়া রেলস্টেশনে, স্মরণ করেন হাচিকোকে। হাচিকো আর উয়েনোর এই ভালোবাসার সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা হয়েছে বই, নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রও; এরমধ্যে রিচার্ড গিয়ার অভিনীত Hachi- A Dog’s Story’ উল্লেখযোগ্য। 

২০১৫ সালে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি নির্মাণ করে, যেখানে দেখা যায় পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন অধ্যাপক উয়েনো, তাঁর আদরের হাচিকোর সঙ্গে দেখা করতে। অন্য কোন ভুবনে সত্যিই হয়তো দুজনে এখন হেঁটে বেড়াচ্ছেন, ঘুরে ফিরছেন আগেকার দিনগুলোর মতোই!

অধ্যাপক উয়েনো ও তাঁর আদরের হাচিকোর সে ব্রোঞ্জের মূর্তি

উয়েনো বেঁচে নেই, বেঁচে নেই হাচিকোও। আছে শুধু ওদের মায়াময় ভালোবাসার গল্পটা, যে গল্প আমাদের আরো বেশী ভালোবাসতে শেখায়, প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হবার বার্তা দেয়। লোকে বলে ভালোবাসার শক্তি অনেক। সেই অনেকটার পরিমাণ আসলে কত? যতটা হলে একটা কুকুর তার মনিবের জন্যে দশটা বছর অপেক্ষা করতে পারে?

ইমেজ সোর্স: All That's Interesting

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা