হায়া সোফিয়া থেকে রাম মন্দির: ধর্মান্ধদের আচরণ সব জায়গায় একই!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

হায়া সোফিয়ায় আজান দেয়ার খবর শুনে আপনি যতোই সুবহানাল্লাহ বলেন না কেন, এই আজান কিংবা অযোধ্যার রাম মন্দিরের আরতি- কোনটাই স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। কারণ ধর্মের নামে ঘৃণা আর অত্যাচারের বিষবাস্প জুড়ে দেয়া আছে এখানকার ইতিহাসে...
এক
তুরস্কের হায়া সোফিয়া নামের জাদুঘরটাকে মসজিদে রূপান্তর করা হচ্ছে, আদালতের আদেশ চলে এসেছে। দেড় হাজার বছরের পুরনো হাইয়া সোফিয়া এক সময় ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় গির্জা, পরে তা পরিণত হয় মসজিদে, তারও পর একে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। এবার এরদোয়ানের সরকার ইসলামপন্থীদের চাপে এটাকে আবার মসজিদে রূপান্তর করছে। ইউনেস্কোর বৈশ্বিক ঐতিহ্যের একটি হিসেবে ঘোষিত এই ঐতিহাসিক স্থানটি পরিণত হচ্ছে ধর্মীয় উপাসনালয়ে।
দুই
বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাগুলোর অনলাইন ভার্সনে গতকাল থেকে খবর প্রকাশিত হচ্ছে হায়া সোফিয়ার মসজিদে রূপান্তরিত হবার খবরটা প্রকাশ করছে, ৮৬ বছর পরে সেখানে আজানের ধ্বনি শোনা গেছে- এরকম শিরোনাম চোখে পড়েছে বেশ কয়েকটা। কমেন্টবক্সে লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ বলে জিকির করছে। সেসব কমেন্ট দেখে মনে হলো, কিছুদিন আগেই যখন ভারতে বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের রায় দিয়েছিল ভারতীয় আদালত, তখন সেটাকে মুসলিম উম্মাহ'র ওপর আঘাত হিসেবে দেখেছিল এই লোকগুলোই! নিজের ধর্মের ওপর আঘাত এলে আস্তাগফিরুল্লাহ, আর নিজেরা অন্য ধর্মের ওপর আঘাত করলে সুবহানাল্লাহ- এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড কেন?
তিন
হাইয়া সোফিয়ার ইতিহাস জানতে হলে আমাদেরকে যেতে হবে প্রায় পনেরশো বছর পেছনে, ইসলামের শেষ নবী মহানবী (সা) এর জন্মেরও আগের কথা। হাইয়া সোফিয়ার ইতিহাসের সূচনা ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে, যখন বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান ইস্তাম্বুলের গোল্ডেন হর্ন নামে এক জায়গায় একটি বিশাল গির্জা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই সময় বিশাল গম্বুজের এই গির্জাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গির্জা এবং দালান বলে মনে করা হতো। ১২০৪ সালে ক্রসেডারদের হামলার ঘটনা বাদে কয়েক শতাব্দী ধরে হায়া সোফিয়া বাইজেন্টাইন সম্রাটদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

অটোমান (ওসমান) বংশীয় সুলতান তৃতীয় মেহমুদ ১৪৫৩ সালে বাইজান্টাইন শাসকদের হাত থেকে ইস্তাম্বুল দখল করে নেন। তার আগ পর্যন্ত শহরটির নাম ছিল কনস্টান্টিনোপল। ইস্তাম্বুল দখলের পর বিজয়ী মুসলিম বাহিনী প্রথমবারের মতো গির্জার ভেতরে নামাজ আদায় করে। অটোমান শাসকেরা এরপর হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করেন। মসজিদের চারপাশে চারটি মিনার তৈরি করেন। গির্জার সব খ্রিস্টান প্রতিকৃতি এবং সোনালি মোজাইকগুলো কোরানের বাণী দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এভাবেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় গির্জাটিকে জোরপূর্বক মসজিদে পরিণত করা হয়েছিল। এর পরের কয়েকশো বছর ধরে হায়া সোফিয়া ছিল অটোমান মুসলমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু।
১৯৩৪ সালে কামাল আতাতুর্কের সময়ে তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতা চালু করার প্রক্রিয়ায় মসজিদটিকে জাদুঘরে পরিণত করা হয়। হায়া সোফিয়া এখন তুরস্কের সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান বলে স্বীকৃত। প্রতিবছর প্রায় ৩৭ লক্ষ পর্যটক এটি দেখতে আসেন। তুরস্কের আদালত অবশ্য বলেছে, মসজিদ হিসেবে ব্যবহার হলেও, হায়া সোফিয়ার প্রাঙ্গনে সব ধর্মের মানুষ বেড়াতে যেতে পারবে। তবে সেটার জন্য কিছু নিয়ম-কানুন বেঁধে দেয়া হবে, একটা কমিটিও গঠন করা হবে। ট্যুরিস্টদের পোষাক এবং আচরণেও কিছু বিধিনিষেধ যুক্ত করা হবে।
চার
হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের চেষ্টাটা অনেকদিন ধরেই করে আসছে এরদোয়ানের সরকার। আদালতে মামলা চলেছে বছরের পর বছর ধরে। মূলত তুরস্কের ইসলামপন্থীরাই বহুকাল ধরেই চাইছিলেন এটিকে আবার মসজিদে পরিণত করতে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধীদলীয় এমপিরা এর বিরোধিতা করে আসছিলেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের দিক থেকে হায়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে পরিণত করার সমালোচনা হচ্ছিল। কিন্ত ক্ষমতায় যেহেতু এরদোয়ান, এবং ধর্মীয় কট্টরপন্থার বড় ভক্ত তিনি, তাই ইসলামিস্টদের মন জয়ের মিশন নিয়েই হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করার চাল চেলেছেন তিনি, যাতে ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত হয় তার।

পাঁচ
এই লেখাটা পড়ে অনেকের মনে হতে পারে ইসলামবিরোধী কথাবার্তা বলা হচ্ছে বুঝি, কিংবা জাদুঘরকে মসজিদে রূপান্তরিত করায় আমাদের গায়ে আগুন ধরে গেছে কিনা- ব্যাপারটা মোটেও সেরকম কিছু নয়। আল্লাহ'র দুনিয়ায় মসজিদ বানানোর অজস্র জায়গা আছে, যে কোন পাক-পবিত্র জায়গায় দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লেই সেটা আল্লাহ কবুল করে নেবেন, এমনটাই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। সেটার জন্য অন্য ধর্মের প্রার্থনাস্থলকে স্ট্যান্টবাজীর উদ্দেশ্যে মসজিদ বানানোর দরকার পড়ে না। হায়া সোফিয়ার সঙ্গে অটোম্যান সম্রাটরা যেটা করেছে, সেটা ছিল জুলুম। এখন এরদোয়ান যা করছেন, সেটাও জুলুমই।
অযোধ্যার বাবরি মসজিদের কথাই ভাবুন। শত শত বছর ধরে এখানে মসজিদটা টিকে ছিল, হুট করেই গোঁড়া হিন্দুদের কারো কারো মনে হলো, এই জায়গায় নাকি হাজার বছর আগেকার একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ লুকিয়ে আছে! অতএব এই জায়গায় কোনভাবেই মসজিদ থাকতে পারে না, এখানে মন্দির বানাও। বিশেষজ্ঞ আর ইতিহাসবিদদের মতামতের তোয়াক্কা না করেই বাবরি মসজিদ ভাঙা হলো প্ররোচনা দিয়ে, দাঙ্গা হলো, হাজারো মানুষ মারা হলো ধর্মের নামে। অথচ এত ঝামেলা না করে মন্দিরটা অন্য কোথাও বানালেই হতো। তাতে প্রভু রাম অসন্তুষ্ট হতেন না এক বিন্দুও। কিন্ত ধর্মান্ধদের সেসব কে বোঝাবে!
আমাদের বার্তাটা পরিস্কার। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় নির্মিত হতে যাওয়া রাম মন্দির যেমন জোর-জবরদস্তির একটা জ্বলন্ত নিদর্শন, তেমনই তুরস্কের হায়া সোফিয়াও ধর্মের নামে জুলুম আর স্ট্যান্টবাজির একটা নমুনা হয়ে টিকে থাকবে ইতিহাসে। যতোই আপনি সেখানে আজান দেয়ার খবর শুনে সুবহানাল্লাহ বলেন না কেন, হায়া সোফিয়ার এই আজান কিংবা অযোধ্যার মন্দিরের আরতি- কোনটাই স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। কারণ ধর্মের নামে ঘৃণা আর অত্যাচারের বিষবাস্প জুড়ে দেয়া আছে এখানকার ইতিহাসে...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন