হানিফ সংকেত: বোকাবাক্সের জাদুকর, অথবা একজন সব্যসাচী
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আমরা ভাগ্যবান এক জেনারেশন, যারা বড় হয়েছি হানিফ সংকেতের সময়ে। মানুষটার ছন্দময় বাচনভঙ্গি কানে লাগে না শুধু, ধাক্কা দেয় হৃদয়কে। আজ তার জন্মদিন...
নিজের জায়গায় তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, কিংবা বলা চলে পথপ্রদর্শক। একটামাত্র ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নির্মাণ করেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহন করেছেন এই মানুষটা, পেয়েছেন কোটি দর্শকের ভালোবাসা। এই বঙ্গে যখন বিটিভি নামে একটামাত্র টিভি চ্যানেল ছিল, তখন তার অনুষ্ঠান সম্প্রচারের রাতে লোকে কাজকর্ম ফেলে রেখে বসে যেতো টিভি সেটের সামনে! আর যাই হোক, এই অনুষ্ঠান মিস দেয়া যাবে না! এখন সময় পাল্টেছে, অথচ খুব একটা আবেদন কমেনি সেই অনুষ্ঠানের, কারণ মানের সঙ্গে আপোষ তিনি কখনোই করেননি।
বরাবরই তিনি ভিন্ন স্বাদের কিছু দর্শককে উপহার দিয়ে চেয়েছেন, একঘেয়েমী যেন পেয়ে না বসে সেই বিষয়ে থেকেছেন সচেষ্ট। মানুষটার নাম হানিফ সংকেত। বিটিভির সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির জন্ম তার হাত ধরে, এটির পরিচালক এবং সঞ্চালকও তিনিই!
আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে জন্মেছি, তারা একদিক দিয়ে বেশ ভাগ্যবান। বয়স পঁচিশ ছোঁয়ার আগেই তিনটে দশক আর দু'টো শতাব্দীর সাক্ষী হতে পেরেছি। আমাদের বেড়ে ওঠার সময়টায় বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যমগুলোর একটি ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। কারণ এই শতকের শুরুর সময়টাতেও মফস্বল শহরগুলোতে কেবল সংযোগ অনেকটা বিলাসিতার নামান্তরই ছিল। সেই বিটিভির পর্দায় ইত্যাদি অনুষ্ঠানটা দেখার উত্তেজনা ছিল ভিন্ন একটা পর্যায়ের।
দলবেঁধে পরিবারের সবাইকে নিয়ে টিভি সেটের সামনে বসে থাকা, ইত্যাদির থিম সং 'কেউ কেউ অবিরাম চুপি চুপি' শোনা গেলেই পড়ার টেবিল ছেড়ে ছুটে আসা কিংবা রাত দশটার সংবাদের পরেও ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়ে টিভির সামনে থেকে উঠতে মা চাওয়া- সবটুকু আবেদন জড়িয়ে ছিল ইত্যাদি অনুষ্ঠানের সঙ্গে। পুরো পরিবারের শিশু থেকে বুড়ো- একসঙ্গে সবার মনোরঞ্জন করার মতো অনুষ্ঠান তো আমাদের দেশে খুব বেশী তৈরী হয়নি, যে ক'টা হয়েছে তাদের মধ্যে 'ইত্যাদি' অবিসংবাদিতভাবে সেরা, আর সেই সেরার আসনটা দখল করা সম্ভব হয়েছে হানিফ সংকেত নামের মানুষটার কারণেই।
আরেক কিংবদন্তী উপস্থাপক ফজলে লোহানীর জনপ্রিয় অনুষ্ঠান 'যদি কিছু মনে না করেন' দিয়ে টিভি পর্দায় তার যাত্রা শুরু। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নিয়ে এলেন 'ইত্যাদি'। এই অনুষ্ঠানের নির্মাতা তিনি, পরিকল্পনাকারীও। সেইসঙ্গে উপস্থাপনার গুরুভারটাও নিজের কাঁধেই রাখলেন হানিফ সংকেত। নিজের এই ব্রেইনচাইল্ডটিকে সুস্থ বিনোদনের উৎস হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন সবসময়, তাই একের পর এক ব্যতিক্রমধর্মী উপাদান সংযুক্ত করেছেন। নানা-নাতী, মামা-ভাগ্নে কিংবা বিদেশীদের দিয়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরা অথবা ভীনদেশী সিনেমা বা ভিডিও ক্লিপকে বাংলায় মজাদারভাবে ডাবিং করে পর্দায় দর্শকের সামনে উপস্থাপন আর হিন্দি-ইংরেজী গানের সুরটা অবিকল রেখে বাংলায় প্যারোডি বানানো- সবকিছুই তার ভাবনা থেকে বেরিয়েছে। টিভির সামনে বসে থাকা দর্শক সবকিছুই আপন করে নিয়েছেন, এসব ব্যতিক্রমী আয়োজন তাদের পছন্দ হয়েছে বরাবরই।
নব্বইয়ের দশকটায় বিটিভি ছিল তার স্বর্ণযুগে, কি দারুণ সব নাটক উপহার দিয়েছেন বিখ্যাত সব নাট্যকার আর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। সেসবের ভীড়েও নিজের মেধা আর স্বকীয়তায় ইত্যাদির আলাদা একটা অবস্থান, আর দর্শকদের মধ্যে অন্যরকম একটা চাহিদা অর্জন করে নিয়েছিলেন হানিফ সংকেত।
দর্শককে আনন্দ দেয়ার নামে পর্দায় ভাঁড়ামী করার বিপক্ষে ছিলেন তিনি, সেটা নিজের অনুষ্ঠানে এক দেড় মিনিটের নাটিকাগুলোতে অভিনেতাদের মাধ্যমে দেখিয়েও দিয়েছেন। সমাজের চলমান অনিয়ম আর দুর্নীতিকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন বরাবরই, পরিবেশ আর পৃথিবীকে রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন ছোট ছোট মজাদার কোন কৌতুকের মাধ্যমে। বিনোদন ছাপিয়ে তার হাত ধরে ইত্যাদি পৌঁছে গিয়েছে অন্য একটা উচ্চতায়, যেখানে শুধু হাস্যরস সৃষ্টি করে মানুষকে আনন্দ দেয়াই নয়, দুনিয়াকে, নিজের শহরকে বা আশেপাশের পরিবেশকে বাসযোগ্য আর শান্তিপূর্ণ করে গড়ে তোলার একটা সুন্দর বার্তাও 'ইত্যাদি' থেকে পেতেন দর্শকেরা।
মানুষজন চিঠি লিখে পাঠাতেন তাদের এলাকা বা দেশের সামগ্রিক নানা সমস্যার কথা জানিয়ে, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেসব বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতেন হানিফ সংকেত, এখনও করেন। তাতে দৃষ্টি আকর্ষণ বা সমস্যার সমাধান কতটুকু হয় সেটা জানি না, তবে ইত্যাদি আর হানিফ সংকেতকে দেখে 'সচেতন নাগরিক' হিসেবে নিজেদের দায়িত্বটা পালনের পাঠ যে কেউ পেতে পারেন।
ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইত্যাদিকে তিনি পরিণত করেছেন একটা সামাজিক আন্দোলনে! আঠারো হাজার তালগাছ লাগানো নওগাঁর বৃক্ষপ্রেমিক গওহর আলী, বইপ্রেমি পলান সরকার কিংবা বরগুণার জয়দেব দত্ত, সিডরের সময় সাইকেলে চড়ে সবাইকে সতর্ক করেছিলেন যিনি- এই মানুষগুলোকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন ইত্যাদির মঞ্চে। দেশের মানুষ জেনেছে ওদের মহৎ কার্যক্রম সম্পর্কে, প্রচারের আলোর বাইরে থাকা এই মানুষগুলোকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সবার সঙ্গে, পুরষ্কৃত করেছিলেন নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে। পরে সরকারও এগিয়ে এসেছে এদেরকে সাহায্য করতে।
এছাড়াও অনেক ব্যতিক্রমী প্রতিভা বা অসহায় মানুষকে তিনি সাহায্য করেছেন 'ইত্যাদি'র মাধ্যমে, রিক্সাচালক আকবরের গায়ক প্রতিভাকে উন্মোচিত করেছেন, ফোকসম্রাজ্ঞী মমতাজও তো তারই আবিষ্কার। টেলিভিশনে ভাষা বিকৃতি কিংবা এমন সমসাময়িক ইস্যুগুলো নিয়ে বরাবরই সোচ্চার থেকেছেন ইত্যাদিতে, হাস্যরসের মাধ্যমে ব্যঙ্গ করেছেন এগুলোকে।
আমি এমন একজন মানুষকে চিনি ব্যক্তিগতভাবে, যাকে জীবিকার তাগিদে অনেক আগে দেশের বাইরে যেতে হয়েছিল। দেশ ছাড়ার সময় ক্লাস এইট পাশ সেই মানুষটার অল্প ক'টা আক্ষেপের মধ্যে অন্যতম ছিল, বিদেশে গিয়ে তিনি ইত্যাদি দেখতে পারবেন না! পরে অবশ্য বাংলাদেশ টেলিভিশন 'বিটিভি ওয়ার্ল্ড' নামে বিশ্বব্যাপী সম্প্রচারে গিয়ে তার মতো লাখো মানুষের চাহিদা পূরণ করেছে। একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা এই ছোট্ট ঘটনাটা থেকেও অনুমেয়!
এখনও, এই ক্যাবল টিভি আর ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার যুগেও প্রতিমাসে ইত্যাদির নতুন পর্ব দেখার জন্যে ভীড় করে মানুষ, ইত্যাদি'র ইউটিউব চ্যানেলে একেকটা পর্বের ভিউ দেখে বোঝা যায়, কত অসংখ্য মানুষ এই অনুষ্ঠানটাকে নিয়মিত উপভোগ করেন! এখনও মফস্বল শহর কিংবা গ্রামগুলোতে ঈদের সময় পরিবারের সবাই যখন একত্র হয়, রাতের বেলা পারিবারিক মিলনমেলার উৎস হয়ে ওঠে ইত্যাদি!
একটা অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা কিভাবে তিন দশক ধরে একইরকমভাবে বজায় রাখা যায়? প্রশ্ন ছিল হানিফ সংকেতের কাছে। তিনি বলেছিলেন ইত্যাদির পেছনের গল্পগুলো। একটা ক্রিয়েটিভ টিম আছে তাদের, তিনি নিজে ওদের নিয়ে প্রচুর সময় দেন ভিন্নধর্মী কন্টেন্ট খুঁজ্র বের করার কাজে। নিজস্ব স্বকীয়তা ধরে রাখতে চান, আর চান বাঙালী আর বাংলাদেশী ঐতিহ্যকে সামনে নিয়ে আসতে। এমনকি প্যারোডি গান কিংবা বিদেশী ভিডিও'র বাংলা সংলাপগুলোতে তিনি নিজেই কণ্ঠ দিয়ে থাকেন। তার কথায়-
"দর্শক সময় খরচ করে আমার অনুষ্ঠান দেখছে, তাই দর্শককে সঠিকভাবে আনন্দ দেয়াটা আমার দায়িত্ব, সেই দায়িত্বটা আমি পালন করার চেষ্টা করি।"
তিনি নিজেও প্রচারের আলোর বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। খ্যাতির তুঙ্গে থাকা এই ভদ্রলোক পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলকে সাক্ষাত দেন না বললেই চলে, তাই তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কানাঘুষো করার সুযোগও খুব কমই পাওয়া যায়। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ হলেও, তিনি একুশে পদক পেয়েছেন 'সামাজিক ক্ষেত্রে' অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ। বন্যা আর করোনায় দুর্গত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছেন, বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। সমাজের উন্নয়ন আর সমাজ থেকে ক্লেদ, হিংসা ও অনিয়মের বীজ দূর করতে তিনি কাজ করে চলেছেন অক্লান্ত, তার ইত্যাদি'কে হাতিয়ার বানিয়ে।
এই অনুষ্ঠানে সরাসরি দর্শকদের অংশগ্রহনে করা হয় দর্শকপর্ব, সেখানে বিজয়ীদের পুরষ্কার হিসেবে দেয়া হয় গাছ, বই কিংবা কম্পিউটারের মতো শিক্ষা, গবেষণা আর পরিবেশের উন্নয়নের কাজে লাগে এমন পণ্যগুলোই। এছাড়াও জাতীয় পরিবেশ পদকেও ভূষিত হয়েছেন তিনি। হানিফ সংকেত আর তার অনুষ্ঠান ইত্যাদিকে নিয়ে ফিচার করেছে বিদেশী বিভিন্ন বিখ্যাত পত্রপত্রিকা, জাপানের চ্যানেলে ইত্যাদিকে নিয়ে বানানো হয়েছে ডকুমেন্টরী। বিবিসির জরিপে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের খেতাব পেয়েছে ইত্যাদি। এছাড়াও টিভির জন্য নাটক লেখা ও পরিচালনা করেছেন তিনি, সেখানেও সামাজিক সচেতনতা আর ভালোবাসার বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন বরাবরই।
সব্যসাচী এই মানুষটার জন্ম হয়েছিল ১৯৫৭ সালের আজকের এই দিনে, বরিশাল জেলায়। শুভ জন্মদিন হানিফ সংকেত, কোটি কোটি বাংলাদেশীর পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ, আমাদের সুস্থ বিনোদনের সংজ্ঞা শিখিয়ে দেয়ার জন্যে। আরও শতবর্ষ আয়ু হোক আপনার, বিনোদনের নামে ভাঁড়ামীগুলো দূর করতে হলে তো একজন হানিফ সংকেতের খুব দরকার!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন