ইতিহাস তাঁকে জনপ্রিয় করেনি, তবে মনে রেখেছে ভালো করেই। ক্ষণজন্মা মানুষকে আর যেই ভুলে যাক ইতিহাস তো ভুলতে পারে না। তাঁর হাত ধরে বাংলায় এসেছিল প্রথম কম্পিউটার; তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার...

১৯৪৭- এর দেশ বিভাগের পর সোনার বাংলাকে শোষণ করতে করতে শ্মশানে রূপ দেয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। ক্রান্তিকালে সকলে চুপ করে বসে থাকেন না। কেউ সম্মুখ সমরে প্রতিবাদের তলোয়ার তুলে নেয় কেউ আবার নিরবে প্রতিবাদ ও প্রতিশোধ নিয়ে যথোপযুক্ত জবাব দেন। আজ তেমনই একজন খাঁটি দেশপ্রেমিককে নিয়ে বলব।

না, আমরা শতকরা ২০ জনও বোধহয় তাঁকে চিনি না। ইতিহাস তাঁকে জনপ্রিয় করেনি তবে মনে রেখেছে ভালো করেই। ক্ষণজন্মা মানুষকে আর যেই ভুলে যাক ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেবেই। যাঁর হাত ধরে বাংলায় এসেছে প্রথম কম্পিউটার; যিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রোগ্রামার—তিনিও ইতিহাসের অংশ বৈকি।

পাকিস্তানের প্রথম কম্পিউটার বাংলাদেশে

১৯৬৪ সালে বিশাল আকারের ‘আইবিএম মেইনফ্রেম ১৬২০’ কম্পিউটার তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানকে উপহার দেয় বন্ধুরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র।

আইবিএম মেইনফ্রেম ১৬২০

এতই বড়ো আকার যে আসবে তা জাহাজে চড়ে। কম্পিউটারে জটিল সমস্যা সমাধান হলেও তার বিপরীতে পাকিস্তানের কর্তারা আরও কঠিন সমস্যায় পড়ে গেলেন। কে নিয়ন্ত্রণ করবে সুবিশাল এই গণনাযন্ত্র? সেটি তো আর মানুষের কথা বুঝে না! সেখানে জানা কেউ নেই এমন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পূর্ব পাকিস্তানে একজনকে পাওয়া গেল। যিনি অ্যানালগ এবং ডিজিটাল কম্পিউটারের প্রোগ্রামিংয়ে অভিজ্ঞ তথা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। অগত্যা সেই ব্যক্তির ডাক পড়ল লাহোর শহরে, দেওয়া হবে সব সুযোগ-সুবিধা।

কিন্তু তিনি যাবেন না, সরাসরি না করে দিলেন। ১২০০ কিলোমিটারের পথে ১২ পা রাস্তাও মারাবেন না। যদি কম্পিউটার নামের জটিল যন্ত্র চালাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতেই হয় তবে ঢাকাতেই হবে। তাঁর জেদের কাছে পরাস্ত হয়ে অবশেষে কম্পিউটার বহনকারী জাহাজটি করাচি বন্দরে না ভিড়ে নোঙর স্থাপন করে চট্টগ্রাম বন্দরে। সেখান থেকে ঢাকায় প্রবেশ করল বাংলাদেশের প্রথম গণনাযন্ত্র। যন্ত্রটির স্থান হয়েছিল বর্তমান রাজধানীর আণবিক শক্তি কমিশনে; কথা ছিল পাকিস্তানের লাহোরে পরমাণু শক্তি কমিশনে থাকবে। সেই একমাত্র প্রোগ্রামারের হাতে চালু হলো আইবিএম কম্পিউটার। আর তিনি হলেন মো. হানিফউদ্দিন মিয়া।

সংক্ষিপ্ত জীবনীতে আলোর পথযাত্রী

মো. হানিফউদ্দিন মিয়া ১৯২৯ সালের ১লা নভেম্বর রাজশাহী বিভাগের নাটোর জেলার শিংলা উপজেলায় অবস্থিত হুলহুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

সময়ক্রমে কর্মজীবন

১৯৫২— তাঁর প্রধান গবেষণার বিষয় ছিল গণিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে স্বর্ণপদক সহ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন।

১৯৬০— কম্পিউটার বিজ্ঞানেও বেশ দক্ষ ছিলেন হানিফউদ্দিন মিয়া। তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন থিওরি অ্যান্ড অটোমেশনে প্রশিক্ষণ নেন। আবার চেকোস্লোভাক অ্যাকাডেমি অব সাইন্স থেকে অ্যানালগ ও ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে প্রশিক্ষণ নেন।

১৯৬৪— যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (MIT) কম্পিউটার সেন্টার থেকে সিস্টেম অ্যানালিসিস, নিউমারাল ম্যাথমেটিকস, অ্যাডভান্স কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের প্রশিক্ষণও নেন।

১৯৭৫— অপারেটিং সিস্টেম ও সিস্টেম প্রোগ্রামিংয়ে লন্ডনের আইবিএম সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

১৯৭৫-১৯৮০— আন্তর্জাতিক পরমাণুশক্তি সংস্থায় (IAEC) সিস্টেম অ্যানালিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৮— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন।

এবং কর্মজীবনের বড়ো একটি সময় বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের কম্পিউটার সার্ভিস বিভাগের পরিচালক ছিলেন।

পরিবারের সদস্যদের সাথে হানিফউদ্দিন মিয়া

টেলিভিশনে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার ধরা পড়ে ১৯৯৭ সালে ‘কম্পিউটার’ অনুষ্ঠানে। সেইবারই প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎকারের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে পরিচয় করি দেন উপস্থাপক বর্তমান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এরপরও তিনি নিভৃতেই রয়ে গেছেন। ১১শ মার্চ ২০০৭ সালে মারা যান এই মহান মনের মানুষ।

সম্মাননা

তাঁকে তেমন স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বললেই হয়। বেঁচে থাকতে তো নয়ই। তবে ২০১৫ সালে কম্পিউটার আসার ৫০ বছর পূর্তিতে সরকারের তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ ও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি জাতীয়ভাবে সম্মানিত করে তাঁকে। ১৭ জুন পরিবারের সদস্যের হাতে তুলে দেওয়া হয় সেই জাতীয় পুরস্কার।

তিনি পাকিস্তান যেতে অনীহা প্রকাশ না করলে বাংলায় পরবর্তী কবে গণনাযন্ত্র আসতো বা আসতই কি না তা সহজেই বোধগম্য।

এ সম্পর্কে সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে মোস্তফা জব্বার বলেন,

“আমরা আর কিছু করতে না পারি সেই প্রথম বাংলাদেশি মানুষটি যিনি কম্পিউটারে হাত রেখেছেন তাকে সম্মান তো জানাতে পারি, তার কথা লিখতে পারি, বলতে পারি। তিনি দেশ ছেড়ে গেলেন না বলেই তো আমরা এখন গর্ব করতে পারছি।”

তিনি আমাদের ইতিহাসেরই অংশ। তিনি সামনে চলে আসা মানে প্রথম কম্পিউটারের ইতিহাস সামনে চলে আসা— যোগ করেছিলেন মোস্তাফা জব্বার।

তাকে নিয়ে বানানো স্মারক ডাকটিকেট

প্রথম কম্পিউটার দর্শনের জন্য সংরক্ষিত আছে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর, ঢাকায়। মনে চাইলে একবার দেখেও আসতে পারেন। এরপর যতবার কম্পিউটার বিষয়ে ভাববেন ততোবার বাংলার প্রথম কম্পিউটার ও এর পেছনের মানুষটিকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারবেন না।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা